সময়ের ভাবনা

সোশ্যাল মিডিয়া বাকস্বাধীনতার হননপর্ব?

আহমেদ দীন রুমি

দেশের সবচেয়ে বড় বিপ্লবী মারা গেছেন। শোকের ছায়া চারদিকে। লোকজন কালো ব্যাজ পরে ঘোরাঘুরি করছে। ব্যাপারটা দেখে কাঁদতে লাগলেন কবির। জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘তুমি কাঁদছ কোন দুঃখে?’ কবির বললেন, ‘কালো কাপড়ের টুকরাগুলো যদি একসঙ্গে জুড়ে নেয়া যেত, হাজার হাজার লোক শরীর ঢাকতে পারত।’ জবাব শুনে কালো ব্যাজ পরা লোকেরা পেটাতে শুরু করল কবিরকে। ‘তুই ব্যাটা কমিউনিস্ট, ফিফথ কলামিস্ট। পাকিস্তানের শত্রু।’ কবির হাসতে লাগলেন। ‘কিন্তু বন্ধু, আমার হাতে তো কোনো ব্যাজ নেই’। লেখাটুকু সাদাত হাসান মান্টোর ‘দেখ কাবিরা রোয়া’ গল্পের। চিত্রিত হয়েছে ভিন্ন মতের প্রতি আচরণ। কবিরের বড় ভুল ছিল প্রশ্ন করা। যেন প্রশ্ন করাটা অপরাধ। যেন সামান্য সমালোচনা মানেই শত্রুপক্ষ। মান্টোর সময় সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। থাকলে গল্পটি আরেকটু সামনে এগোতে পারত। তবে ‘আকলমান্দ কে লিয়ে ইশারা কাফি হ্যায়’। 

একুশ শতকের গোড়াতেই বিপ্লব হয়ে ঝাঁকুনি দেয় সোশ্যাল মিডিয়া। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠা ২০০৪ সালে, টুইটারের ২০০৬ সালে। মুহূর্তেই ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’ গল্পের ইঁদুরের মতো ঝাঁক বেঁধে মানুষ লাফিয়ে পড়তে থাকল সেদিকে। বর্তমানে ফেসবুকের সক্রিয় ব্যবহারকারী ২৯৬ কোটি অতিক্রম করছে। টুইটার ব্যবহারকারীও প্রায় ৩৭ কোটি। আদার ব্যাপারী থেকে জাহাজের কাপ্তান, রূপোপজীবিনী থেকে রাষ্ট্রনায়ক; যে যার মতো করে উপযোগিতা খুঁজে পেয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। মিছিলে যুক্ত হয়েছে ইনস্টাগ্রাম, লাইকি ও লিংকডইনের মতো জনপ্রিয় নাম। সোশ্যাল মিডিয়া যেন স্বতন্ত্র একটি দেশ। ২০১৯ সালের অক্টোবরে জর্জটাউন ইউনিভার্সিটিতে দাঁড়িয়ে জাকারবার্গ জানিয়েছিলেন, ফেসবুক সৃষ্টির পেছনে তার উদ্দেশ্য মূলত দুটি। প্রথমত, মানুষকে কথা বলার স্বাধীনতা দেয়া ও দ্বিতীয়ত, মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা। বাকি সোশ্যাল মিডিয়াগুলো থেকেও ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে একই কথা আসে। ভবিষ্যতেও যে আসবে, সেটা নিশ্চিত। কিন্তু সত্যিই কি সোশ্যাল মিডিয়া স্বাধীনতা দিচ্ছে? এ কথা সত্য, মানবজাতির ইতিহাস নিজের দৃষ্টিভঙ্গিকে জানান দেয়ার। সবার সামনে কথা বলতে চাওয়ার। সোশ্যাল মিডিয়ার সংযোজন সেটাকে সহজ করেছে নাকি কঠিন? কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার নজির হিসেবে অনেকেই আরব বসন্তের তিউনিসিয়া, মিসর ও লিবিয়া প্রসঙ্গ আনবে। সোশ্যাল মিডিয়া সেখানে বিপ্লবের জন্য সহায়ক ছিল, কথাটি একেবারে মিথ্যা নয়। শতকরা ৮৫ ভাগ মিসরীয় ও ৮৬ ভাগ তিউনিসীয় নাগরিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেছে তথ্যের প্রচারে। গণতন্ত্রকে পুনরায় একনায়কতন্ত্রে ফেরানোর উদাহরণ হিসেবেও রয়েছে মিসরের নাম। নিয়তির নির্মম পরিহাস। পুঁজিবাদের সমালোচনাই নাকি পুঁজিবাদকে দীর্ঘস্থায়ী বানানোর রাস্তা চিনিয়েছে। আরব বসন্তের ফলাফল বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের পথ বলে দিয়েছে মসনদ ধরে রাখার। সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে পৃথিবী তাকিয়েছে ভিন্ন চোখে। যেন কোনো এক কলম্বাস এতদিনে আবিষ্কার করলেন নতুন দুনিয়া। টুইটারে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণা ও হোয়াটসঅ্যাপে বিজেপির তত্পরতা সে গল্পের ভূমিকা মাত্র। 

টেসিয়ানের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ৯০ শতাংশ মানুষই ব্যক্তিগত তথ্য দেয়। ৫৯ শতাংশ মানুষ সন্তানদের নাম ও ছবি আপলোড করে। ৩৮ শতাংশ প্রকাশ করে জন্মদিন উদযাপনের ছবি। চাকরি পাওয়ার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়ে দেয় ৯৩ শতাংশ ব্যবহারকারী। ৪২ শতাংশ মানুষ প্রতিদিন কমপক্ষে একটা পোস্ট দেয়। ২৬ শতাংশ মানুষ জানিয়ে দেয় তাদের ক্লায়েন্টের তথ্য। অথচ এসবের বড় একটা অংশই গোপনীয়তা প্রত্যাশা করে। তার চেয়ে বিস্ময়কর কথা হলো সোশ্যাল মিডিয়ার ৫৫ শতাংশ মানুষ প্রাইভেসি সেটিং বিষয়েই সচেতন নয়। ফলে তথ্য হাতিয়ে নেয়া সহজলভ্য হয়ে পড়ছে না শুধু, সহজ হয়েছে সে তথ্যকে ব্যবহার করে যে কাউকে বেকায়দায় ফেলা। নারীদের হয়রানির ভয়, অপ্রাপ্তবয়স্কদের আবেগ ব্যবহূত হওয়ার ভয় কিংবা সমাজে সফল ব্যক্তিদের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের ভয়ের কথা না হয় বাদ থাক। ব্যবহারকারী কোন কোন পোস্ট করছে, তা ফিল্টার করার ক্ষমতা রাখে খোদ সোশ্যাল মিডিয়া। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিংবা পেছন থেকে কাজ করা মানুষেরা সেসব কনটেন্ট পর্যবেক্ষণ করে। তারপর বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে অনুমোদন দেয় বা রিমুভ করে। এমনকি সীমা লঙ্ঘনের ইস্যুতে ব্লক করে দিতে পারে ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্ট। একদিকে আপনার তথ্য নিয়ে আপনার নিউজ ফিড নিয়ন্ত্রণ করছে তারা। বিপরীতে তথাকথিত নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে চালিয়ে যাচ্ছে গতিবিধি পর্যবেক্ষণ। সীমা লঙ্ঘনের খসড়া দেখিয়ে মুখোমুখি করছে নানা কিসিমের ট্রায়ালের। ফলে প্রশ্ন থেকে যায়, আপনার অনলাইন কার্যক্রম আদতে কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করছে। গল্প এখানেই শেষ নয়। কোনো ব্যবহারকারীর কোনো পোস্টে অন্য ব্যবহারকারী অভিযোগ জানাতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই কোনো বিশেষ দল টার্গেট করে কোনো ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্টের রিচ কমিয়ে দিতে পারে। বিভিন্ন মাত্রার রেস্ট্রিকশনে ফেলতে পারে। কোনো একটা অ্যাকাউন্টকে চিরদিনের জন্য ব্লক করতে পারে। পুরো বিষয়টাতে নানা রকম ফাঁকফোকর রয়েছে। ফলে ‘বিশেষ কোনো দল’ চাইলে সোশ্যাল মিডিয়া কর্তৃপক্ষের বাইরেও ব্যবহারকারীর নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় নামতে পারে। ফ্রিডম অব স্পিচ বা রাইট অব এক্সপ্রেশন বলে আমরা যে সাইবার-ইউটোপিয়ার পিলার তৈরি করেছি, তার সঙ্গে বাস্তবতার ফারাক ঢের।

অ্যাভগেনি মরোজোভ ২০১১ সালে লিখেছিলেন ‘দ্য নেট ডিল্যুশন: দ্য ডার্ক সাইড অব ইন্টারনেট ফ্রিডম’। পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ‘সাইবার-ইউটোপিয়ানিজম’ ধারণার সঙ্গে। আধুনিক জীবনের মুক্তি বলতে মানুষ ক্রমেই ইন্টারনেট-কেন্দ্রিকতা বুঝে নিচ্ছে। অথচ বাস্তবতা হলো সোশ্যাল মিডিয়া সমাধান হয়ে আসেনি আধুনিক মানুষের কাছে। বরং পালন করছে একনায়ক দেশগুলোর হাতে তুলে দেয়া নতুন অস্ত্রের ভূমিকা। অগণতান্ত্রিক দেশগুলোয় বিদ্রোহী গ্রুপ চিহ্নিত করতে ব্যবহূত হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া। নিরাপত্তার অজুহাতে লঙ্ঘন করা হচ্ছে গোপনীয়তা। গোপন তথ্যের চেয়ে বড় কোনো অস্ত্র নেই। সেটাকেই কাজে লাগানো হচ্ছে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা রাখতে। অথচ গোপনীয়তা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। সরকারগুলো কিন্তু এখানেই দমে যায়নি। তারা সোশ্যাল মিডিয়াকে পরিণত করেছে নিজেদের পক্ষের প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর মেশিনে। রাশিয়ার ‘স্কুল অব ট্রলস’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিদিন হাজার হাজার পোস্ট করে পশ্চিমা দেশ ও বিরোধী দলের নেতাদের সমালোচনায়। চীনের ‘৫০ সেন্ট আর্মি’-এর সদস্যরা টাকার বিনিময়ে সরকারের পক্ষে নিয়মিত চালায় প্রচারণা। ভারতে এনআরসি ও কাশ্মীর ইস্যুতে দেখা গেছে সরকারদলীয় সোশ্যাল মিডিয়ার দৌরাত্ম্য। হাতিয়ে নেয়া তথ্য ব্যবহার করে বড় বড় কোম্পানি ব্যবহারকারীকে বিজ্ঞাপনের টার্গেট বানায়। একই তথ্য ব্যবহার করে সরকারগুলো কাজে লাগায় নিজেদের ইমেজ তৈরিতে। সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে সরকার কোনো রকম সমঝোতায় পৌঁছতে পারলে তো কথাই নেই। ভিন্নমতকে বিধ্বস্ত করা তখন জলবৎ তরলং। দেশের নানা রকম পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিরপেক্ষ অবস্থান হারায়। নিজে পিছপা না হলে তো ব্লক করার ক্ষমতা সরকারের রয়েছেই। আধুনিকতার নাম করে উত্তর কোরিয়ার সরকার নাগরিকদের মধ্যে ১০ লাখ সেলফোন বিতরণ করেছে। ব্যবহারকারীরা প্রতিদিন সকালে কিম জং-উনের প্রশংসা খুদে বার্তা আকারে পায়। আইডিয়াটা চমৎকার বটে। ওদিকে চীনে ওয়েইবো ও রাশিয়ায় ভিকনটাকটের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে দেশগুলোর জন্যও সুবিধা হয়েছে। দেশীয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঙ্গে সরকারের সমঝোতা তুলনামূলকভাবে সহজ। ব্যবহারকারীর প্রতিটি ক্লিক খুব মনোযোগ দিয়ে নিরীক্ষা করছে কোনো না কোনো অদৃশ্য কর্তৃপক্ষ। যেন মনে করিয়ে দেয় ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত জর্জ অরওয়েলের ক্ল্যাসিক উপন্যাস ‘নাইন্টিন এইটি ফোর’-এর কথা, ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ’।

কোনো অগণতান্ত্রিক সরকারকে কয়েকভাবে সেবা দেয় সোশ্যাল মিডিয়া। প্রথমত, শাসকগোষ্ঠীই নির্ধারণ করে দেয় জনগণ ঠিক কোন ডিসকোর্স নিয়ে মগ্ন থাকবে। নেতিবাচক কোনো ঘটনাকে নতুন কোনো ঘটনা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হবে প্রয়োজনে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দীর্ঘ সময় নিয়ে আলোচনার কোনো জায়গা না। ফলে এ কাজটা খুব সহজেই করা যায়। দ্বিতীয়ত, কোনো একটা বিষয়কে জনগণ কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবে, তার ফ্রেম তৈরি করে দেয় শাসকগোষ্ঠীই। রেজিমের পক্ষের ভিতই তাতে করে শক্ত হয়। ভিন্নমত যেন পাত্তাই পায় না। তৃতীয়ত, নির্বাচন চলাকালে সোশ্যাল মিডিয়ার কার্যক্রম আরো বেশি স্পষ্ট। শাসকগোষ্ঠী তৈরি করে সাইবার ফোর্স। যত যা-ই হোক, দিন শেষে সোশ্যাল মিডিয়াকে মানুষ তথ্যের উৎস হিসেবে ভাবতে পছন্দ করে। স্থানীয় এলিটরা এ সুযোগ নেয়; নিজেদের পক্ষে দাঁড় করায় তাত্ত্বিক পাটাতন। অগণতান্ত্রিক শাসকরা একজনের থেকে আরেকজন শিক্ষা নেয়। তথ্যের অবাধ প্রবাহ শাসকের পুঞ্জীভূত ক্ষমতার জন্য হুমকি। স্বাভাবিকভাবেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় তার ওপর। মসনদ দখলে রাখার মূলনীতি এটি।

১৯৩৩ সালে নািস শাসিত জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘রাইখ কালচার চেম্বার’। জার্মান জাতিকে বিশুদ্ধকরণের দোহাই দিয়ে খড়্গ চলতে থাকে শিল্প ও সংস্কৃতির ওপর। ‘ডিজেনারেট আর্ট’ তকমা দিয়ে বাতিল করা হয় আধুনিক ধারার স্থাপত্য, চিত্রকলা, সংগীত, নাটক ও চলচ্চিত্র। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি চিত্রকর্মও সে তালিকায় পড়েছিল। নািস যুগ ফুরালেও চেপে ধরার সংস্কৃতি ফুরায়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে এ নিয়ন্ত্রণ আরো পরিব্যাপ্ত হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার কর্তৃপক্ষ, বিশেষ কোনো দল ও অগণতান্ত্রিক সরকারের নজরদারিতে জীবনযাপনকে কোনোভাবেই স্বাধীন বলা যেতে পারে না। সোশ্যাল মিডিয়ার অন্ধকার এ দিক সম্পর্কে সচেতন না হলে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ কথাটি কেবল অর্থহীন পোয়েটিক ধ্বনিগুচ্ছে পরিণত হবে।


আহমেদ দীন রুমি: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন