আয়কর নির্ধারণে কর কর্মকর্তাদের ‘অবাধ’ ক্ষমতা থাকছে না

করজাল সম্প্রসারণ ও রাজস্ব বাড়াতে কার্যকর ভূমিকা রাখুক

আয়কর নির্ধারণের ক্ষেত্রে কর কর্মকর্তারা এখন থেকে আগের মতো ‘অবাধ’ ক্ষমতা প্রয়োগ করে নিজের ইচ্ছেমতো কর বাড়াতে বা কমাতে পারবেন না—এমন বিধান রেখে আয়কর আইন ২০২৩-এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি আয়কর বিবরণী দাখিলের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কমিয়ে সেগুলো সহজ করার প্রস্তাব করা হয়েছে প্রস্তাবিত নতুন এ আইনে। সরকারের রাজস্ব আহরণ বাড়াতে ব্যবসায়ীদের আস্থা অর্জন এবং হয়রানি হ্রাসে এমন পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা। কর-জিডিপি অনুপাত কমে যাওয়া এবং করজালের আওতায় জনগণের না আসার কারণ হিসেবে কর কর্মকর্তাদের হয়রানির বিষয়টি একাধিক গবেষণায় উঠে এসেছে। সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টারাও কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা হ্রাসের প্রস্তাব করেছিলেন। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলায় কর আইন প্রণয়ন এবং কর কর্মকর্তা কর্তৃক হয়রানি কমাতে আলোচ্য উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে, এ প্রত্যাশা সবার। ডিসক্রিশনারি পাওয়ারের বিষয়ে অন্তত ২০টি ক্ষেত্রে, আগে অফিসারের নিজের ক্ষমতাবলে, তিনি যেটা যৌক্তিক মনে করবেন সেভাবে করতেন। এখন গাণিতিক ফর্মুলা দেয়া হয়েছে। ওই ফর্মুলায় যে রেজাল্ট আসবে, সেটাই হবে নির্ধারিত ট্যাক্স। অফিসার নিজে ইচ্ছা করলেই কর বাড়াতে বা কমাতে পারবেন না। আয়কর আইনে এটি ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত হবে। তবে একই সঙ্গে দৃষ্টি রাখতে হবে এর সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীরা কর ফাঁকি বাড়িয়ে না দেন।

ব্যক্তির ওপর কত ট্যাক্স ধার্য হবে, আগে আয়কর কর্মকর্তা সেটা কিছুটা নির্ধারণ করতেন। আয়কর কর্মকর্তার কাছে যেটা যৌক্তিক বলে মনে হতো, তিনি সেটি করতে পারতেন। এতে আপিলের সংখ্যা বেড়ে যেত। সংশোধনীর ফলে কর্মকর্তার সাবজেক্টিভ জাজমেন্টের ওপর নয়, বরং একটা ফর্মুলা করা হয়েছে সেখানে অবজেক্টিভ ইনফরমেশনগুলো দেবেন, ফর্মুলা ক্যালকুলেট করে দেবেন কর্মকর্তা। এতে হয়রানির সুযোগ কমে আসবে বলে প্রত্যাশা। এছাড়া রিটার্ন দাখিলের পদ্ধতি বা যেসব কাগজ জমা দিতে হয়, বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে, সেগুলো সংস্কার করা হয়েছে। আর আয়কর পদ্ধতি যে আইসিটিনির্ভর করা হচ্ছে, সেটিকে প্রাতিষ্ঠানিক করার চেষ্টা হয়েছে। ১৯৯০ দশকের শুরুতে পণ্যের ওপর আরোপ করা রাজস্ব-শুল্ক-কর সংস্কার করা হয়েছিল। তারপর কোনো অর্থবহ উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং প্রয়োগের অনিয়ম বা জটিলতার ফলে বহুল বিচ্যুতি ঘটেছে। এসব বিচ্যুতি ও আদায়ের অনিয়ম দূর করলে রাজস্ব আহরণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। নতুন মূসক (ভ্যাট) আইন নিয়ে সরকার ও এফবিসিসিআইএর সঙ্গে তীব্র মতপার্থক্য দেখা দেয়। তখন আইনটির বাস্তবায়ন স্থগিত করা হয়। বিষয়টি সন্তোষজনক ও পরিপূর্ণ মীমাংসা হয়নি। আইনটি বাস্তবায়নের জন্য অভিজ্ঞ কর্মকর্তা, শিল্প-বাণিজ্য খাতের প্রতিনিধি, রাজস্ব আইন বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ সমন্বয়ে কমিটি গঠনে বিবেচনার দরকার হবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পৌনঃপুনিকতা পরিহার করা দরকার, যার ফলে শিল্প-বাণিজ্য ও ভোক্তা উপকৃত হবে। রাজস্ব কর বাবদ অনাবশ্যক অতিরিক্ত এবং অনিশ্চিত ব্যয় পণ্যের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা হ্রাস করে; উচ্চশুল্কহার দ্বারা প্রতিরক্ষণ এ দুর্বলতা দূর করতে পারে না। বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সমান্তরালভাবে মূসকসংক্রান্ত বিষয়গুলো পরীক্ষা শুরু করা যেতে পারে। 

প্রত্যক্ষ করের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি প্রগতিশীল, যা সমাজের আয় ও সম্পদবৈষম্য রোধ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আয়করের বিধান হচ্ছে উচ্চবিত্ত সম্পদশালীর কাছ থেকে করের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে সেটি নিম্নবিত্তের জন্য খরচ করা। অর্থনৈতিক এ নীতির মাধ্যমেই উচ্চবিত্তের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস এবং নিম্নবিত্তের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিপূর্বক সমাজে সমতা আনয়নে ভূমিকা পালন করে। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে বিগত দেড় দশকে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ উন্নতি সাধিত হয়েছে। জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, সর্বোপরি গড় আয়ু বৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেরই নির্দেশক। এসব অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাঝেও যে নেতিবাচক কিছু প্রভাব লক্ষ করা যায় তা হলো ধনী-দরিদ্রের ক্রমবর্ধমান আয় ও সম্পদবৈষম্য। বর্তমানে দেশে কর ব্যবস্থার আরেকটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হচ্ছে, জাতীয় আয়ের তুলনায় আহরিত করের পরিমাণ বেশ নগণ্য। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের দেশের কর-জিডিপির অনুপাতে অনেক কম। বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণ মোতাবেক কোনো দেশের আদর্শ কর-জিডিপি অনুপাত হওয়া উচিত ১৫ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে এটি ৮-৯ শতাংশ। এ অবস্থা উন্নয়নের জন্য খাতভিত্তিক কর এবং জিডিপিতে অবদানের একটি বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এ বিশ্লেষণ থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে খাত থেকে আহরিত করের পরিমাণ তুলনামূলক কম তা উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে উপযুক্ত বিধান থাকা প্রয়োজন। কিন্তু খসড়া আয়কর আইনে এরূপ কোনো বিশ্লেষণের ফলাফলভিত্তিক বিধানের সংযোজন লক্ষ করা যায় না।

কর কর্তৃপক্ষের বিবেচনামূলক ক্ষমতা অধিক হওয়ায় করদাতা এবং কর কর্তৃপক্ষ একে অন্যের মধ্যে অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়, যা কর আহরণে বাধা সৃষ্টি করে। তবে এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজন আছে। মোট রাজস্বের বড় অংশ আসে উৎসে কর থেকে। কিন্তু উৎসে কর কর্তনকারী কর্তৃপক্ষগুলো কর কর্মকর্তাদের যাচাই-বাছাইয়ে সহযোগিতা করে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, এসব কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নেই, মেশিন নষ্ট ইত্যাদি অজুহাতে যাচাই-বাছাই পিছিয়ে দেয়। এতে ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা যায় না। অবিতর্কিত রাজস্ব দাবি পরিশোধ না করলে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ অন্যান্য সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ক্ষমতা পাচ্ছেন কর কর্মকর্তারা। দেশে কর ও জিডিপি অনুপাত অন্যান্য উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের মতো আশাব্যঞ্জক নয়। উন্নত দেশের সোপানে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে এ অনুপাত অনেকাংশে বাড়ানো প্রয়োজন। বর্তমানে কর কর্মকর্তারা করদাতার সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারেন না। 

শুধু আইনি ত্রুটি নয়, এনবিআরের কাঠামোগত দুর্বলতাও প্রকট। বর্তমানে জেলা পর্যায়ে এনবিআরের কার্যালয় আছে। ফলে উপজেলা পর্যায়ে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা আয়করের বাইরে থেকে যাচ্ছেন। উপজেলা পর্যায়ে এনবিআর কার্যালয় থাকা জরুরি। আর অনলাইনে আয়কর ও ভ্যাট দেয়া পুরোপুরি চালু হলে লোকবল বেশি বাড়াতে হবে না। সব মিলিয়ে, এনবিআরের গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। যত দ্রুত সম্ভব ব্যবসায়ীবান্ধব নতুন আয়কর আইন ও কাস্টমস আইন চালু করা হোক। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ৬৭ শতাংশ কোটিপতি কর আওতার বাইরে। অর্থাৎ দেশের ৬৭ শতাংশ কোটিপতি আয়কর দেন না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এনবিআরের। কারণ তারা করজাল সারা দেশে ছড়াতে পারেনি। যে কারণে রাজস্ব আহরণ কম হচ্ছে, করদাতাদের ওপর বাড়তি করের চাপও তৈরি হচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড করের আওতা বাড়ানোসহ নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। তবে এসব পরিকল্পনা খুবই শ্লথগতির। বিনিয়োগ বাড়াতে পারলেই কেবল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব। রাজস্ব আয় বাড়ানো এর শর্ত। এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে দরকার করবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি। সেখানে রাজস্ব প্রদানে সেবা নিশ্চিত, অনুকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আইনকানুন সময়োপযোগী করা গুরুত্ব পাবে। পরিকল্পনাজনিত সমস্যা তো রয়েছেই, সঙ্গে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক নানা জটিলতা। আছে দুর্নীতির অভিযোগও। এসব বিষয়ে সরকারকে আরো জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। রাজস্ব আয় ব্যবস্থাপনা সহজ করার পাশাপাশি কর ফাঁকিবাজদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে আনার দায়িত্বও সরকারকে নিতে হবে।

রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের হাতে বিপুল ক্ষমতা দেয়া আছে, যা থাকা উচিত নয়। এক ব্যক্তির হাতেই আইন প্রণয়ন, প্রয়োগ ও বিচারিক ক্ষমতা। তারা রেজিস্ট্রেশন দেন, ট্যাক্স রিটার্ন নেন, ইন্সপেকশন-অডিট করেন। এটি থাকা উচিত নয়। এমন পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের ইঙ্গিত। আশা করা যায় এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের কাছে ইতিবাচক বার্তা যাবে এবং কর প্রদানে তারা আরো উৎসাহিত হবেন। করজালের আওতায় নতুন করদাতাদের অন্তর্ভুক্ত করতে কর কর্মকর্তারা অধিক সময় দেবেন বলে প্রত্যাশা। একটা ওয়াচডগ বডি করা দরকার, যে কর কর্মকর্তা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হবেন কিংবা যারা দুর্নীতির মাধ্যমে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বিরাট পরিমাণ রাজস্ব প্রদান না করার সুযোগ তৈরি করে দেবেন, অভিযোগ আসামাত্রই যেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ থাকে, আইনে যেন তাও থাকে। আইনে বেশি কর আদায় করলে তার জন্য ১০ শতাংশের মতো প্রণোদনার ব্যবস্থা আছে, তাহলে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন