স্পিচ ডিলে

শিশু কেন কথা বলছে না

শর্মিলা সিনড্রেলা

আরুশির বয়স সাড়ে তিন বছর। বিশ্বজগতের শব্দভাণ্ডারে এখনো তার প্রবেশ ঘটেনি। ঝুলিতে যাও দুয়েকটি শব্দ ছিল, একবার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর সেগুলোও হয়েছে বিস্মৃত। এখন নিজে নিজে বেশ কয়েকটি শব্দ বলে সে, তবে কোনো প্রশ্নেই তার কাছে মেলে না উত্তর। যদিও আকারে-ইঙ্গিতে নিজের চাহিদা ঠিকঠাক প্রকাশ করতে পারে সে।  

২০২০ সালে করোনাকালে জন্ম সাজিদের। সাজিদের বয়স যখন দুই ছুঁই-ছুঁই তখনো মুখ থেকে কোনো শব্দ না শুনে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান বাবা-মা। সচেতন থাকায় তখনই দ্বারস্থ হন চিকিৎসকের। আড়াই বছরের মাথায় গিয়ে সাজিদ ধীরে ধীরে অর্জন করতে শুরু করে শিশুর ভাষিক বিকাশের মাইলফলক।

গল্পগুলো এখন সবারই মোটামুটি চেনা। সন্তানকে নিয়ে এমন সমস্যার মুখে এখন অহরহই পড়ছেন বাবা-মায়েরা। বিশেষ করে শহরে সমস্যা তীব্র। আকারে-ইঙ্গিতে চাহিদা বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হলেও কথা দিয়ে মনের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে বিলম্বিত হচ্ছে অনেক শিশু। কিন্তু কথাই তো মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। চাহিদা বোঝাতেই হোক বা রাগ-ক্ষোভ, কথার আর বিকল্প কী? তেমনটাই বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগের চেয়ারম্যান তাওহিদা জাহান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের ভাষিক যোগাযোগ দক্ষতার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম কথা। আমরা মনের ভাব খুব সহজে প্রকাশ করতে পারি কথার মাধ্যমে। শিশু যদি কথা বলতে না পারে তাহলে তার চাহিদাগুলো সে জানাতে পারবে না। এমনকি শিশুর দৈনন্দিন চাহিদার মতো বিষয়গুলো যেমন: তার খিদে পেয়েছে, টয়লেট পেয়েছে সেটাও বলতে পারবে না। তার ভালো লাগা, খারাপ লাগা প্রকাশ করতে পারবে না। যখন সে তার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনগুলো জানাতে পারবে না, তখন তা যথাসময়ে পূরণ না হলে শিশু খিটখিটে হয়ে যেতে পারে। এমনকি তা তার সার্বিক মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

শিশুর শারীরিক মানসিক বিকাশের পাশাপাশি শূন্য থেকে চার বছরের মধ্যে শিশুর ভাষিক বিকাশ হয়ে থাকে। সময়ের মধ্যে শিশুর তিনটি ধাপে ভাষিক যোগাযোগের বিকাশ হয়ে থাকে। সেগুলো হলো: প্রাক-বাচনিক দক্ষতা, অনুধাবনগত দক্ষতা প্রকাশগত দক্ষতা। প্রকাশগত দক্ষতাটাই হলো বাচনিক যোগাযোগ বা কথা। দেখা যায় কোনো শিশু যদি প্রাক-বাচনিক দক্ষতায় পিছিয়ে পড়ে তাহলে সেই শিশু কথা বলার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়ে। তাওহিদা জাহানের মতে, এক্ষেত্রে শিশুর ভাষা বিকাশের যে মাইলফলক রয়েছে অর্থাৎ কোন বয়সে শিশু কোন ধরনের কথা বলবে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। যদি মনে হয় যে শিশু পিছিয়ে পড়ছে তাহলে অবশ্যই দক্ষ স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্টের পরামর্শ নিতে হবে। যত দ্রুত সমস্যাটি চিহ্নিত করা যাবে তত দ্রুত তাকে স্বাভাবিক ভাষা দক্ষতায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

অনেক সময় শিশুর স্পিচ ডিলে সমস্যাটা গিয়ে ডিজঅর্ডারে রূপ নেয়। তাই শিশুর স্পিচ ডিলে বা ভাষা বিলম্ব বা কথা বলতে দেরি হচ্ছে মনে হলে চিহ্নিত করতে হবে সেটা কোন কারণে হচ্ছে। শিশুর ভাষা বিলম্ব নানা কারণে হতে পারে। এক্ষেত্রে কখনো জেনেটিক্যাল কারণ, নিউরো বায়োলজিক্যাল কারণ আবার পরিবেশগত কারণও থাকতে পারে। অন্য কারণগুলোর ক্ষেত্রে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে আর পরিবেশগত কারণ যদি দ্রুত উপলব্ধি করা যায় তাহলে তা সমাধানে পদক্ষেপ নিতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুণ্ডু বলেন,

আমরা আগের চেয়ে ধরনের শিশুদের বেশি পাচ্ছি এবং গ্রামের তুলনায় শহরে সংখ্যাটা বেশি। অনেক সময় দেখা যায়, শিশুরা এক বছর পর্যন্ত স্বাভাবিক হারে কথা বলছে। পরে তা কমে যাচ্ছে।

অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের ক্লিনিক্যাল স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট মো. মুতিউল ইসলাম বলেন, জন্মের পর ছয়-সাত বছর পর্যন্ত শিশুদের ধাপে ধাপে বিভিন্ন শারীরিক মানসিক দক্ষতার মৌলিক বিকাশ ঘটে থাকে। শিশু যেমন ধীরে ধারে দাঁড়ায়, কথার ক্ষেত্রেও শিশু এভাবে ধীরে ধীরে পরিণত হয়। কিন্তু এখন বেশির ভাগ শিশুর ক্ষেত্রে স্পিচ ডিলে বা দেরিতে কথা বলার সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার মূল কারণ ডিভাইস আসক্তি।

তিনি আরো বলেন, ছয়-সাত বছর পর্যন্ত শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ ঘটে পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে। আগেকার সময়ে শিশুদের মাটি, গাছপালা, শব্দ এবং নানা মানুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। সেসব থেকেই শিশুরা সবকিছু শিখেছে। ডিভাইসের প্রভাব পরিবেশের সঙ্গে সংযোগের ক্ষেত্রে গ্যাপ পড়ে যাচ্ছে। ডিভাইসের আলো বা চরিত্রের সঙ্গেই শিশুর বেশি থাকা হচ্ছে। বাবা-মাও হয়তো সময় দিতে পারছে না। তাতে সন্তানের আচরণগত নানা পরিবর্তনও দেখা যাচ্ছে। কারণ সন্তান কোথায় কোন আচরণ করতে হবে তা শিখছে না। এসব কারণে দেখা যায় ডাকলেও শিশু শোনে না, একা একা থাকতে চায়।

ওভারঅল ডেভেলপমেন্ট ডিলের জন্য ডিভাইসকে দায়ী করা যায়। এর পাশাপাশি অটিজম বা সেরিব্রাল পালসির মতো নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডারের কারণেও ধরনের সমস্যা হতে পারে। জন্মের সময় বা শৈশবকালে মাথায় আঘাত পেলে, দীর্ঘ সময় জ্বর, বারবার মাইল্ড খিঁচুনি, জন্ডিসের কারণে নিউরোলজিক্যাল কোনো সমস্যা হলে ব্রেন থেকে শরীর সিগন্যাল পায় না, তখন মাসল মুভমেন্টে সমস্যা হয়। তাতে করে শিশু ঠিকমতো শব্দ তৈরি করতে পারে না।

বর্তমানে সময়ে শিশুর স্পিচ ডিলে আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। থেরাপিস্টের ভাষায়, সময়মতো কথা বলা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত করতে স্নায়ুবিকাশমূলক বিষয় ছাড়াও শিশুর সামাজিক যোগাযোগ পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার বিষয়টি আমাদের মাথায় থাকা জরুরি। শিশুকে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ টেলিভিশন ইত্যাদি যথাসম্ভব কমিয়ে দেয়া আবশ্যক। পাশাপাশি শিশুকে যথেষ্ট সময় দেয়া দরকার। যেকোনো ধরনের সমস্যা যত দ্রুত চিহ্নিত করা যায় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় তত ভালো। পরিবেশের নানা বিষয়ের প্রতি সঠিক প্রতিক্রিয়া, আচরণগত দৈনন্দিন জীবনের কর্মকাণ্ডগুলো সঠিকভাবে করতে অকুপেশনাল থেরাপির প্রয়োজন। আবার শারীরিক শারীরবৃত্তীয় কিছু বিষয়ে ফিজিওথেরাপির প্রয়োজন হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে মেডিকেল চিকিৎসা সার্জারির প্রয়োজন হয় (যেমন ঠোঁট কাটা তালু কাটা), আবার কারো বিশেষ যন্ত্রের (যেমন কানে কম শোনার জন্য হিয়ারিং এইড) প্রয়োজন। আর কথা বলা, ভাষার ব্যবহার, সামাজিক যোগাযোগ, খাবার গ্রহণ, শিখন বুদ্ধিবৃত্তিক কিছু বিষয়ে স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপির প্রয়োজন হয়। বিশেষত দেরিতে কথা বলার সমস্যা কমাতে স্পিচ থেরাপিস্ট সহযোগিতা করতে পারেন। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে যাতায়াত সেবা নেয়ার প্রচুর কষ্ট, অর্থ সময় ব্যয় হওয়ার কারণে অনেক বাবা-মা সন্তানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী হন না। সেক্ষেত্রে থেরাপি সেশনের পাশাপাশি বাবা-মাকে বাসায় কাজ করার জন্য কিছু বিশেষ কার্যক্রম শিখিয়ে দেয়া, পর্যাপ্ত কাউন্সেলিং অনলাইন টেলিথেরাপি সেবা কার্যকর হতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন