সাক্ষাৎকার

শিশুদের ‘ওদের’ মতো করে পর্যাপ্ত সময় আমরা দিচ্ছি না

অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুণ্ডু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান। দীর্ঘদিন ধরে শিশুদের বিভিন্ন স্নায়ু সম্বন্ধীয় সমস্যা রোগের চিকিৎসা, গবেষণা অধ্যাপনা করে আসছেন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ। শিশুদের স্পিচ ডিলের কারণ, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, চিকিৎসা করণীয় সম্পর্কে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

শিশুদের স্পিচ ডিলে বা দেরিতে কথা বলা কি একটি রোগ, নাকি পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে এটি হয়?

এটি অনেক বড় ব্যাপার। রোগের কারণে স্পিচ ডিলে হতে পারে। আবার অন্যান্য কারণেও হতে পারে। কানে যদি কেউ কম শোনে, তাহলে কথা বলে না। থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে কথা বলে না। একে কনজেনিটাল হাইপোথাইরয়েডিজম বলা হয়। অটিজম থাকলেও অনেক সময় শিশুরা কথা বলে না। ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুরাও কথা বলে না। আবার যেসব শিশু বেশি ইন্ট্রোভার্ট, মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে কিংবা মা-বাবারা পর্যাপ্ত সময় দিতে পারে না, তারাও দেরিতে কথা বলে। আমরা জানি, প্রথম পাঁচ বছরে শিশুদের মস্তিষ্ক বিকাশ হয়। প্রথম ছয় মাসে শিশু কথা বলতে পারে না। পরবর্তী ছয় মাসে অল্প অল্প বলে। দুই বছর বয়সে দুটি শব্দে ছোট ছোট বাক্য সে বলতে পারে। তিন বছরের সময় তা পরিপূর্ণতা পায়। তখন তারা স্কুলে যাওয়া নার্সারিতে পড়ার উপযোগী হয়। এভাবে পাঁচ বছরের মধ্যে শিশুর বিকাশ সম্পন্ন হয়। কোনো রোগের কারণে কিংবা পারিপার্শ্বিকতার কারণে শিশুর বিকাশ যদি ব্যাহত হয়, তখন কথা বলতে দেরি হয়। এর অন্যতম কারণ হিসেবে আমরা দেখেছি, অভিভাবক শিশুকে কম সময় দেন। শিশুরা প্রথম কথা শিখে মা-বাবা কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে। দ্রুত নগরায়ণের কারণে সবার ব্যস্ততা বাড়ছে। যে সময়ে শিশু কথা শিখবে, সে সময়ে শিশুর সঙ্গে পর্যাপ্ত কথাবার্তা পরিবারের সদস্যরা বলছেন না। এটি অন্যতম কারণ হতে পারে। আরেকটি কারণ হতে পারে, ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রতি শিশুদের আগ্রহ। ইউটিউবে তারা অনেক বেশি সময় ব্যয় করে। ইংরেজি, হিন্দিসহ বিভিন্ন ভাষার কনটেন্ট আছে ইউটিউবে। কখনো কখনো মা-বাবারাও ইংরেজিতে কথা বলে। ধরনের বহু ভাষার সংমিশ্রণ শিশুদের মনোজগতে জটিলতা তৈরি করে। তাই প্রথমে তাদের বাংলা শেখাতে হবে। তারপর অন্য ভাষা শেখাতে হবে।

আগের তুলনায় স্পিচ ডিলের শিশুদের আপনারা বেশি পাচ্ছেন? এর কারণ কী?

দুই দশক ধরে আমরা এটি লক্ষ করেছি। আমরা আগের চেয়ে ধরনের শিশুদের বেশি পাচ্ছি এবং গ্রামের তুলনায় শহরে বেশি। অনেক সময় দেখা যায়, শিশুরা এক বছর পর্যন্ত স্বাভাবিক হারে কথা বলছে। পরে তা কমে যাচ্ছে। আমি এক গবেষণায় দেখেছিলাম, ৪০-৪২ শতাংশ শিশুর কথা বলা কমে যায় দুই বছর বয়সে। এক বছরের পরে তারা মোবাইল এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস হাতে পায়। পর্যায়ক্রমে তা বাড়ে। একটি বিষয় খুব স্পষ্ট, এসব ডিভাইস শিশুদের কথার বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

শিশুদের সঙ্গে পর্যাপ্ত সময় কাটানো বা কথা না বলার কারণে কি এমনটি হচ্ছে?

আমরা আসলে শিশুদের সঙ্গে ওদের মতো করে সময় কাটাচ্ছি না। গ্রামাঞ্চলে সমস্যা নেই। সেখানে শিশুরা এসব ডিভাইস তেমন পায় না। অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করে। মা-বাবা, স্বজনদের কাছ থেকেও তারা পর্যাপ্ত সময় পায়। আমরা জানি, মস্তিষ্কের বিকাশ হয় দেখতে দেখতে, খেলতে খেলতে বলতে বলতে। অনেকগুলো কোষের সমন্বয়ে মস্তিষ্ক গঠিত। এতে আছে কোটি কোটি স্নায়ুকোষ বা নিউরন। নিউরনগুলো পরস্পরের সঙ্গে যথাযথভাবে সমন্বিত হলে শিশুর বিকাশ হয়। যদি কোনো উদ্দীপনা না দেয়া হয়, তবে নিউরনগুলো পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় না। সে উদ্দীপনা হচ্ছে নতুন জিনিস দেখা, নতুন জিনিস বলা নতুন কিছু করা। অর্থাৎ নতুন কোনো অভিজ্ঞতা। এক বছর বয়সে যখন একটি শিশু আরেকটি শিশুর সঙ্গে খেলাধুলা করে, তখন তার নতুন কিছু অভিজ্ঞতা হয়। নতুন কিছু দেখে, শেখে বোঝে। থেকে তার মস্তিষ্কে উদ্দীপনা তৈরি হয়। উদ্দীপনার ফলে নিউরনগুলো পরস্পর সম্পৃক্ত হয় শিশুর বিকাশ ঘটে। সে তুলনায় ঢাকার ফ্ল্যাটগুলোতে বেড়ে ওঠা শিশুদের উদ্দীপনা কম হয়।

তবে কি উন্নত বিশ্বে সমস্যা আমাদের মতো দেশের চেয়ে বেশি?

শিশুদের স্পিচ ডিলে উন্নত বিশ্বে অনেক বেশি। অটিজম, নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার (স্নায়ু বিকাশজনিত রোগ), শিশুদের বিকাশজনিত সমস্যা উন্নত বিশ্বে অনেক বেশি।

সমস্যা সমাধানে সরকার চিকিৎসকরা বিশেষ কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন?

আমাদের দেশে এরই মধ্যে সরকার অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ২০১১ সালে সরকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল নিউরো ডিজঅর্ডারের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ২০১৪ সালে ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম স্থাপিত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন আরো অনেক কিছু হচ্ছে। বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ জেলা পর্যায়ে শিশু বিকাশ কেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসবের মাধ্যমে শিশুর বিকাশজনিত সমস্যায় বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রদানের সর্বোচ্চ প্রয়াস চালাচ্ছে সরকার। আমাদের সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং জেলাগুলোতে এমন কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। তবে বড় আকারে এটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজি বিভাগে। এখানে প্রতিদিন প্রায় স্পিচ ডিলের সমস্যায় আক্রান্ত ১৫০ থেকে ২০০ শিশুকে নিয়ে আসেন অভিভাবকরা। রোগের চিকিৎসায় সব ধরনের ব্যবস্থা এখানে আছে।

চিকিৎসার পর স্পিচ ডিলের প্রভাব কি শিশুর শরীরে থেকে যেতে পারে?

যদি রোগের কারণে স্পিচ ডিলে হয়, তাহলে যথাযথভাবে চিহ্নিত করে ওইসব রোগের চিকিৎসা করলে উন্নতি হয়। আর যদি পারিপার্শ্বিকতার কারণে হয়, সেক্ষেত্রে দ্রুত কারণগুলো চিহ্নিত করে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যদি দেখা যায় ছয় মাস বয়সে শিশু যেভাবে মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসার কথা, এক বছর বয়সে আধো আধো কথা বলার কথা, কিংবা হাত দিয়ে ইশারা করা অথবা মা, বাবা, দাদা ইত্যাদি বললে তাদের দিকে তাকানো, এগুলো যদি না হয় কিংবা কম হয় তাহলে সচেতন হতে হবে। এগুলোকে আমরা বলি রেড ফ্ল্যাগ সাইন বা লাল পতাকা চিহ্ন। যদি দেড় বছরের মধ্যে এসব সমস্যা চিহ্নিত করে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে শিশুর বিকাশের সময়টাতে উদ্দীপনার ব্যবস্থা করা যায়। তখন শিশু অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারে।

জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বিষয়টি কতটুকু উদ্বেগের কারণ?

শিশুর স্পিচ ডিলে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদি শিশুর পাঁচ বছরের মধ্যে স্পিচ ডিলে সমস্যার সমাধান না করা যায়, তাহলে তা নির্মূল করা কঠিন হয়ে পড়ে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন