‘ক্ষতর মুখগুলোকেই তোমার ভেতরে আলো প্রবেশের দরজা বলে জেনো’

২০২০ সালে বেঙ্গলের কামরুল হাসান গ্যালারিতে প্রদর্শিত শিল্পী দিলারা বেগম জলির জঠরলিপি সিরিজের ‘লাইটস্তম্ভ’-এর কাজ ছবি: সাদিয়া মরিয়ম রুপা

গতানুগতিক ধারার বাইরে নিজস্ব একটি ধরন লক্ষ করা যায় দিলারা বেগম জলি কাজে। নতুন ধারার শিল্পচর্চায় তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী। ড্রয়িং, পেইন্টিং, ভাস্কর্যের পাশাপাশি নিউ মিডিয়া আর্ট যেমনভিডিও আর্ট, স্থাপনা শিল্প, পারফরম্যান্স আর্টের ক্ষেত্রেও নতুন ভাবনা নিয়ে হাজির হন। যুক্ত ছিলেন সময় নামের ভিজুয়াল আর্ট মুভমেন্টের সঙ্গে। আশির দশকের যে কয়জন নারী শিল্পীর কাজে ফেমিনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়, তার মধ্যে তিনি অন্যতম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রুহিনা ফেরদৌস

একজন নারী শিল্পী হিসেবে আপনার জার্নি কতটা আলাদা?

চারুকলায় ভর্তি হওয়ার আগে ছবি আঁকা সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা ছিল না। চারুকলার পরিবেশ আমার শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় আমি আগ্রহী হয়ে উঠি। তখন বুঝতে পারি আমি এমন একটা বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছি, যার মাধ্যমে আমি নিজের ভাবনাকে প্রকাশ করতে পারি। শিক্ষাজীবন থেকে আমি অনেক রকম ম্যাটেরিয়াল নিয়ে কাজ করতাম। চট্টগ্রাম চারুকলা থেকে পেইন্টিংয়ে স্নাতক শেষ করে মাস্টার্স করি ঢাকা চারুকলায়। এরপর শান্তিনিকেতনে প্রিন্ট মেকিংয়ে পড়তে যাই। ১৯৯১ সালে শান্তিনিকেতন থেকে ঢাকায় ফিরে আসি। বলতে পারেন, সময়টা আমার ভাবনার জায়গাগুলোয় পরিবর্তন এনে দেয়। ফলে প্রকৃতি মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্কের ধারণাটা আমার কাজে দেখা যায়। নিজেকে চেনা, বড় বড় শিল্পীর সঙ্গে দেখা-পরিচিত হওয়া, শান্তিনিকেতনের পরিবেশসব মিলিয়ে আমার ভাবনার জগৎ তৈরি হয়। আমার কাজের গতিময়তা বাড়ে।

আপনার কাজগুলোয় এক ধরনের ফেমিনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়, কেন?

সামাজিকভাবে প্রচলিত নারীর প্রতি সমাজের যে মনোভাব তাকে প্রশ্ন করা এবং সেই মনোভাবকে শিল্পের ভাষায় প্রকাশ করার চেষ্টা অনবরত করে যাচ্ছি। মেয়েদের জন্য তালাভাঙার দরজার অভাব নেই। নবনীতা দেবসেনের ভাষায়, আমাদের হূত্কমল থেকে শ্বাসকমল সব দরজাই আধখোলা। থেকে ব্যক্তিজীবন, সমষ্টি জীবন, রাষ্ট্র সামাজিক মনোভাবনার পাশাপাশি পৃথিবীজুড়ে নারীর প্রতি যে বৈষম্য তারই প্রকাশ বারবারই বিষয়বস্তু হিসেবে আমার ক্যানভাসে উঠে এসেছে। যেমন তাহাদের কথা, ভ্রূণ প্রত্যাহার, সময়ের খনন সিরিজের কাজগুলো হয়তো সে কথাই বলে। এর আগে আমি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র লালসালু নিয়ে কাজ করেছি। এরও পরে অমরার আখ্যান, তাজরীননামা রানা প্লাজা কাজগুলো করি। আমাদের মায়েরা কাঁথা সেলাই করেন; মায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে, ভাবনা থেকে আমি কাজ করা শুরু করি। আমাদের দেশে নকশিকাঁথার প্রবর্তন মেয়েদের হাত ধরে। তাদের গল্পগুলো কাঁথা সেলাইয়ের মাধ্যমে উঠে আসে। আমার ভাবনাগুলো শিল্পের ভাষারূপে কাঁথার ফোঁড়ের মাধ্যমে উঠে এসেছে। ধরনের কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্ষত সিরিজ (সাদার ভেতরে সাদা ক্ষত), লাইট স্তম্ভ, গর্ভপাত ইত্যাদি, যার মাধ্যম ছিল সাদা কাগজ, আলোকচিত্র সুঁই।

আপনার কাজে মাধ্যম বা উপকরণেরও পরিবর্তন হয়েছে কি?

ব্যক্তিগতভাবে আমি একটা ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। তা কাটিয়ে ওঠার জন্য পারফর্মিং সুঁইয়ের ফোঁড়ের কাজগুলো বেছে নিই, যা আমার আগের কাজগুলো থেকে আলাদা এবং নতুন ভাব প্রকাশের মাধ্যম হয়ে উঠল। যেমন তাজরীননামা, উই অ্যান্ড মি, মেয়েছেলে, শীলারাসহ ভিডিও মাধ্যমে বেশকিছু পারফর্ম করি। মাধ্যম সম্পর্কে জানার ফলে পরবর্তী সময়ে মুভিং ইমেজ জঠরলীনা কাজটি করা হয়, যার বিষয় ছিল মুক্তিযোদ্ধা রমা চৌধুরীকে নিয়ে। সব যুদ্ধেরই প্রধান শিকার নারী। যুদ্ধ জরায়ুর বিনাশ চায়। নারীর জরায়ু হলো সামগ্রিক রাজনীতির এক বড় অংশ। কারণেই পৃথিবীর তাবৎ যুদ্ধে নারীদের ওপর আক্রমণটা হয় তার জরায়ুকে লক্ষ্য রেখে ভাবনা থেকে আমি সাতটা গর্ভাশয় বা জরায়ু তৈরি করি। গর্ভাশয় বা জরায়ুর যে অবজেক্টটা তৈরি হয় তার ওপর এডভার্ড মুনখের দ্য স্ক্রিম ছবিটার অ্যানিমেশন করে প্রজেক্ট করি। ছবির বিভিন্ন লাইন অ্যানিমেটেড হয়ে মায়ের কান্নার মতো ঝরে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল তা যেন মা বা দেশ-মায়েরই কান্না, যেখানে উঠে আসে যুদ্ধের সময় নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্বের ক্রমবৃদ্ধি। ১৯৭১ সালে গর্ভপাত হয়েছে। জরায়ুকে যেভাবে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে, ছবিতে তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। যখন নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলি, তারা জানান, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলেও আমাদের যুদ্ধ শেষ হয়নি। যতদিন বেঁচে থাকব, আমাদের যুদ্ধ চলবে। তখন আমার মনে হলো ওদের বেদনাটা আঁকি। জঠরলিপি সিরিজে ওদের ছবির ওপর সুঁই দিয়ে ফুটো তৈরি করে আমি আসলে ওই বেদনা ধরতে চেয়েছি। বীরাঙ্গনা নয়, আমি নাম দিয়েছি লাইট স্তম্ভ নারীরা আমাদের যুদ্ধের আলোকিত অংশ। সুঁই ফুটানো পোর্ট্রেটগুলো আমি লাইটবক্সের মধ্যে রাখি। ফলে থেকে যে আলো বেরিয়ে আসে, তা ছবিকে অস্পষ্ট করে দেয়, কিন্তু তাদের বেদনার গভীরতাগুলো আমরা অনুভব করতে পারি। এমনকি ওরা যে আলোকিত মানুষ, ওদের পোর্ট্রেটগুলো আমাদের সে কথা মনে করিয়ে দেয়।

অমরার আখ্যান যুদ্ধের পর যুদ্ধ সিরিজের ধারণাটা কীভাবে এল?

যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারকালে বিভিন্ন পত্রিকায় স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের টর্চার সেলগুলোর কথা উঠে আসে। তার মধ্যে মহামায়া ডালিম ভবন, গুডহিল, ফয় লেকের বধ্যভূমি, চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ এবং ঢাকার মোহাম্মদপুরের শরীরচর্চা কেন্দ্র ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে আমার কাজের অংশ হয়ে ওঠে। আমি জায়গাগুলোয় যাই, আলোকচিত্র ধারণ করি, এরপর ধারণকৃত আলোকচিত্রের ওপর সুঁইয়ের ফোঁড়ের ওপর ফোঁড় দিয়ে ক্ষত তৈরি করি, যা ইতিহাসেরই অন্য একটা বয়ান। এছাড়া ডালিম ভবনে গিয়ে আমি নিজে দুটো পারফরম্যান্সও করিডিপার্টেড সৌল। এছাড়া . নীলিমা ইব্রাহিমের আমি বীরাঙ্গনা বলছি থেকে কিছু অংশ নিয়ে একটি ইনস্টলেশন করি সাউন্ড-লাইট-ভ্রূণ দিয়ে, যার নাম অমরা

কলাকেন্দ্রে আপনার কাজের চলমান প্রদর্শনী /দৃশ্য-কে দেহের আখ্যান কেন বলছেন?

/দৃশ্য প্রদর্শনীটির কিউরেটর শার্মিলি রহমান। নামকরণ ওর করা। নামকরণের ভেতরেই শরীরের অন্তর্গত উপস্থিতি থাকলেও বাহ্যিক উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই না। এখানে নারীর একান্ত ব্যবহার্য পোশাক আছে, কিন্তু কোনো দেহ নেই। যেমন নারীর পরিহিত ব্লাউজকে সুঁইয়ের ফোঁড় দিয়ে এমনভাবে প্রজেক্ট করা হয়েছে দেখে মনে হবে মানুষের শরীরের চামড়ার ওপর পেরেক গেঁথে রাখা হয়েছে। এছাড়া তন্দুরি তৈরির চুলার ওপর নারী অঙ্গকে এমনভাবে রাখা হয়েছে যেন তা পুড়ে যাওয়া জরায়ুর কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়। আমার কাজগুলো নারীর ভেতরকার ক্ষতগুলোকে তুলে ধরে। তবে শুধু ক্ষত নয়, ক্ষতর মুখ দিয়ে আলো প্রবেশের দরজাগুলোকেও দেখিয়ে দেয়। যেমনটা জালাল উদ্দিন রুমি লিখেছেন, ক্ষতর মুখগুলোকেই তোমার ভেতরে আলো প্রবেশের দরজা বলে জেনো।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন