চূর্ণ-বিচূর্ণ ফ্রিদা কাহলো

আহমেদ দীন রুমি

১৯৩৯ সালে ফ্রিদা কাহলোর এ ছবিটি তুলেছিলেন নিকোলাস মুরে ছবি: ভোগ ম্যাগাজিন

ভুল করে বসলেন ড্রাইভার। ট্রলির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দুমড়ে গেল বাসটা। গিয়ে ঠেকল রাস্তার পাশের দেয়ালে। যাত্রীদের সবাই আহত। ছিটকে বাইরে পড়ে গেছে বন্ধু আলেজান্দ্রো গোমেজ আরিয়েস। কিশোরীর অবস্থা আরো বেশি মারাত্মক। মেরুদণ্ড কণ্ঠাস্থি মিলিয়ে পাঁচটি ভাঙন। ১১টি ভাঙা নিয়ে স্থানচ্যুত ডান পা। সরে গেছে কাঁধ, পেলভিসে জখম তিনটি। তার চেয়ে বড় কথা, একটা ধাতব দণ্ড কোমরের ঠিক বাম পাশ দিয়ে ঢুকে তলপেটের নিচ দিয়ে বের হয়ে গেছে। ধরেই নেয়া হয়েছিল মৃত। অথচ তিনি চোখ খুললেন পৌরাণিক গল্পের নায়িকার মতো। শুধু মেক্সিকোর রেড ক্রস হাসপাতাল নয়, তামাম গ্রহে জানিয়ে দিলেন উপস্থিতি। ফ্রিদা কাহলো। স্বপ্নকে যিনি ভাষা দিয়েছিলেন। অবিশ্বাস্য জীবনকে তুলে ধরেছিলেন রঙের পরাবাস্তব আঁচড়ে।

জার্মানি থেকে মেক্সিকোয় থিতু হওয়া গিয়ের্মো কাহলো ছিলেন ফটোগ্রাফার। বিয়েতে আবদ্ধ হন স্থানীয় বংশোদ্ভূত মাতিলদে ক্যালদেরনের সঙ্গে। তাদের সংসারে ১৯০৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন ফ্রিদা। নিয়তি হয়তো তাকে ভিন্ন কিছুর জন্য তৈরি করছিল। দিয়েছিল ঘটনাবহুল জীবন। ছয় বছর বয়সে পোলিওতে খাটো হয়ে যায় ফ্রিদার ডান পা। ১৯২৫ সালে ঘটে নিয়তি নির্ধারণী বাস দুর্ঘটনা। ৪৭ বছরের জীবনে মুখোমুখি হতে হয় ৩০টি বড় ধরনের অস্ত্রোপচারের। বেড়ে উঠেছেন মেক্সিকোর স্থানীয় সংস্কৃতির আবহে। সময় তখন রাজনৈতিকভাবে উত্তাল। পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত ইউরোপ। বিশ্বব্যাপী কমিউনিজমের জয়রথ। ১৯১০-২০ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময় চলেছে মেক্সিকান রেভল্যুশন। সবিশেষ দিয়েগো রিভেরার সঙ্গে সম্পর্কের সাতকাহন। সবকিছু মিলে অদ্ভুত ক্যানভাস তৈরি হয়েছিল ফ্রিদার জন্য। বাস্তবতা তাকে যত বেশি হতাশ করেছে, তত তীব্রভাবে তিনি নির্মাণ করেছেন নিজস্ব বাস্তবতা। শিল্পবোদ্ধারা তার আর্টকে পরাবাস্তব হিসেবে আখ্যা দেন। ফরাসি কবি আন্দ্রে ব্রেতো পরাবাস্তব আন্দোলনের রূপকার। প্রথম দিকের পুরোধাপুরুষ হিসেবে ছিলেন বোদলেয়ার, র্যাবোঁ গিয়োম অ্যাপোলিনিয়ার। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের স্বপ্ন অবচেতন মনই পরাবাস্তব আন্দোলনের তাত্ত্বিক পাটাতন। সাহিত্যের চৌকাঠ ছেড়ে ক্রমে শিল্পের অন্যান্য শাখায় ছড়িয়ে পরে এর জয়যাত্রা। তবে ফ্রিদাকে যখন ব্রেতো পরাবাস্তব আর্টের ব্যাপারে বলেন, ফ্রিদা নাকচ করেছিলেন। তার জবাব ছিল স্পষ্ট, আমি স্বপ্ন আঁকি না। আঁকি নিজস্ব বাস্তবতাকে। 

পেইন্টিংয়ে হাতেখড়ি আগে হলেও বাস দুর্ঘটনা দেয় আনুষ্ঠানিকতা। বিছানায় পড়ে থাকা তিন মাস ফ্রিদা রঙের মধ্য দিয়ে তৈরি করেন বেঁচে থাকার নতুন রাস্তা। তুলির আঁচড়ে দৃশ্যমান হয় বিকল্প বাস্তবতা। যত দিন গেছে, পরিপক্ব হয়েছে অভিজ্ঞতার ঝুলি। মুনশিয়ানা এসেছে নির্মাণে। আলেজান্দ্রো গোমেজ আরিয়েস ফ্রিদার স্কুলজীবনের প্রেম। তার অনুপ্রেরণাতেই নির্মিত হয় প্রথম আত্মপ্রতিকৃতি। দুর্ঘটনার পর দুজনের সম্পর্ক শিথিল হতে থাকে। আরিয়েস চলে যায় বাইরে পড়াশোনার জন্য। কিছুটা শক্তি ফিরতেই ফ্রিদা জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট রাজনীতিতে। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা নিয়মিত গেট টুগেদার করত তখন। একত্রিত হতেন লেখক, ফটোগ্রাফার, চিত্রকর অন্যান্য শিল্পী। এখানেই দিয়েগো রিভেরার সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাৎ ফ্রিদার। পুনরায় এজন্য যে এর আগেও তাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল। ফ্রিদা রিভেরার প্রথম সাক্ষাৎ ১৯২২ সালে। রিভেরা ম্যুরাল আঁকতে এসেছিলেন ন্যাশনাল প্রিপারেটরি স্কুলে। ফ্রিদার স্কুল। রিভেরা তখন খ্যাতির শীর্ষে। পড়াশোনা করেছেন স্পেন প্যারিসে। পিকাসো মোদিলিয়ানির সঙ্গে বন্ধুত্ব। দীর্ঘদিন কিউবিজম মতবাদে প্রভাবিত থাকলেও বিপ্লবের পর মেক্সিকান আর্ট নিয়ে কাজ শুরু করেন। রাজনৈতিক মতাদর্শে ঘোর কমিউনিস্ট। প্রভাব এতটাই যে তাকে আখ্যা দেয়া হতো মেক্সিকোর লেনিন নামে। যা হোক, কমিউস্ট গেট টুগেদার থেকে ক্রমেই ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে ফ্রিদা আর দিয়েগো রিভেরার। বয়সের বাইরেও তাদের পার্থক্য ঢের। (চলবে)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন