ফ্রোজেন শোল্ডার

শুধু ব্যথানাশক ওষুধে ফ্রোজেন শোল্ডার ভালো হয় না

ছবি: ফিজিওথেরাপি প্লেস

আমাদের দুই হাত ঘাড়ের মধ্যে যে জয়েন্টটা থাকে সেটাকে বলা হয় কাঁধের অস্থিসন্ধি বা শোল্ডার জয়েন্ট। ডানদিকে বামদিকে দুটি শোল্ডার জয়েন্ট রয়েছে আমাদের। শোল্ডার জয়েন্টে একটি কমন সমস্যার নাম ফ্রোজেন শোল্ডার বা কাঁধের জড়তা। এর বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাডেসিভ ক্যাপসুলাইটিস। ফ্রোজেন শোল্ডার নামেই এটা বেশি পরিচিত, এমনকি ডাক্তারদের কাছেও। শারীরিক জটিলতার মূল উপসর্গ শোল্ডার জয়েন্টে ব্যথা। তা ইউনিল্যাটেরাল বা বাইল্যাটেরাল হতে পারে। মানে একদিকে অথবা দুদিকেই হতে পারে।

সমস্যায় আক্রান্তরা সাধারণত বলেন, হাত উঁচিয়ে যেসব কাজ করতে হয় যেমন চুল আঁচড়ানো, খোঁপা বাঁধা বা জামা পরা, তাদের এসবে সমস্যা হয়। অনেক সময় ভুক্তভোগীরা জানান, শোল্ডারে ব্যথার কারণে প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতেও সমস্যা হচ্ছে। বাসাবাড়ির কিছু কাজ যেমন জানালা পরিষ্কার করা বা দরজা পরিষ্কার করা এসব করতেও সমস্যা হয়। এসবই ফ্রোজেন শোল্ডারের খুব সাধারণ উপসর্গ।

আমাদের প্রতিটা অস্থিসন্ধি বা জয়েন্টে পর্দা বা জয়েন্ট ক্যাপসুল থাকে। সেই জয়েন্ট ক্যাপসুলের মধ্যে অনেক সময় প্রদাহ বা লোকাল ইনফ্লেমেশন হয়। সেটাকে বলা হয় ক্যাপসুলাইটিস। এখানে ক্যাপসুল কনট্রাক্ট করে অর্থাৎ ভেতরে ভেতরে ফুলে মোটা হয়ে যায়।

ফ্রোজেন শোল্ডার কেন হয় তা এখনো বিজ্ঞানীদের কাছে অজানা। ৪০ থেকে ষাটোর্ধ্ব পুরুষ নারীদের সমস্যা হতে পারে। যেহেতু চিকিৎসাবিজ্ঞান মূলত গবেষণানির্ভর; সেখানে বলা হয়েছে কিছু কিছু সমস্যা থাকলে জটিলতা বেশি হয়। যাদের দীর্ঘদিন অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে ফ্রোজেন শোল্ডারের জটিলতার শঙ্কা বেড়ে যায়। যদি থাইরয়েড হরমোনের রোগ মানে হাইপো থাইরয়েডিজম এবং হাইপার থাইরয়েডিজম থাকে তাহলে ফ্রোজেন শোল্ডার হতে পারে। কারো শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকলেও জটিলতা হতে পারে। যাদের হার্টের রোগ আছে তাদের বামদিকে ফ্রোজেন শোল্ডার হতে পারে। স্ট্রোক-পরবর্তী সময়েও সমস্যা হতে পারে। আরো কিছু স্নায়বিক রোগ যেমন পারকিনসন্স থাকলেও ফ্রোজেন শোল্ডার হতে পারে। এছাড়া আঘাতের কারণেও ফ্রোজেন শোল্ডার হতে পারে। হাতের যদি কোনো হাড় ভেঙে যায় বা বাহুর হাড়ের ফ্র্যাকচার হলেও পরবর্তী সময়ে ফ্রোজেন শোল্ডার হতে পারে। তার পরও বলতে হয়, এখনো এর মূল কারণটা অজানা।

আমরা প্রথমত ভুক্তভোগীর কাছ থেকে তার ইতিহাস শুনতে চাই। যখন ভুক্তভোগী ধরনের সমস্যাগুলোর কথা বলে তখন আমরা তার কিছু ক্লিনিকাল পরীক্ষা করাই। এটা কি শোল্ডারের ব্যথা নাকি অন্য কোনো সমস্যা তা দেখি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখি এটা ফুলে গেছে বা লাল হয়ে গেছে কিনা। কোনো কাটা চিহ্ন আছে কিনা, কোনো অপারেশন হয়েছে কিনা, আগে ভেঙে গিয়েছিল কিনা ইত্যাদি বিবেচনা করার পর আমরা প্রয়োজনে তাকে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দিই। থাইরয়েড, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল চেক করে দেখি বা তাকে একটা এক্স-রে করতে বলি। এসব দেখার পরে আমরা পরিকল্পনা করি ফ্রোজেন শোল্ডারে ভোগা ব্যক্তিকে কীভাবে সুস্থ করা যায়। যখন আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছাই যে চিকিৎসার জন্য আসা ব্যক্তি ফ্রোজেন শোল্ডারেই ভুগছেন তখন আমরা চিকিৎসার দিকে যাই।

সাধারণত ব্যথা নিয়ে কেউ যখন চিকিৎসার জন্য আসেন তখন আমাদের অনেক কিছু বিবেচনা করতে হয়। তাদের আগে থেকে অন্য কোনো রোগ আছে কিনা যেমন গ্যাস্ট্রিক আলসারের সমস্যা, অ্যাজমা, কিডনি, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, বয়স কেমন সেসব বিবেচনা করে ওষুধ বেছে নিতে হয়। সব ওষুধ সবার জন্য সহনীয় নয়। ওষুধ কখনো কখনো ক্ষতির কারণ হতে পারে। সেভাবেই ব্যথানাশক ওষুধ নির্বাচনের পরে আমরা কিছু লোকাল জেল দিতে পারি আর কিছু অ্যান্টিআরসেন ড্রাগ দিতে পারি। এরপর আমরা কিছু ফিজিওথেরাপি দিয়ে থাকি। যেটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা মেডিকেল কলেজে সহজেই পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে ভুক্তভোগীকে কিছু ব্যায়ামও করতে হবে।

ব্যথা দূর করার জন্য শোল্ডার জয়েন্টের কিছু নিয়মতান্ত্রিক ব্যায়াম দরকার হয়। যেমন শোল্ডার মবিলাইজিং এক্সারসাইজ, কডম্যান এক্সারসাইজ, পেন্ডুলাম এক্সারসাইজ। তবে ফ্রোজেন শোল্ডারে ভোগা সবার ক্ষেত্রে এক রকম ব্যায়াম দেয়া হয় না। সমস্যা বুঝে সিদ্ধান্ত দিতে হয়। কতদিন থেকে ভুগছেন, বয়স কেমন সেসব বুঝে আলাদা আলাদা ফিজিওথেরাপি ব্যায়ামের পরামর্শ দেয়া হয়। শুধু ব্যথানাশক ওষুধে সমস্যা ভালো হয়ে যায় না। পাশাপাশি ভুক্তভোগীর ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল থাইরয়েড থাকলে তা নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। যেহেতু ফ্রোজেন শোল্ডারের কারণ অজানা, তাই অ্যাসোসিয়েটেড ডিজিজগুলোর চিকিৎসাও যথাযথ চালিয়ে যেতে হবে।

আমাদের দেশের বেশির ভাগ ভুক্তভোগী দরিদ্র। তাই তাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সতর্ক করতে পারি না। আমরা তাদের বোঝাতে পারি না যে শুধু ওষুধ খেলেই জটিলতা ভালো হয়ে যাবে না। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ব্যায়াম করতে হবে। খাবারের নিয়ন্ত্রণও চিকিৎসার একটি অংশ। গ্রামে যারা থাকেন তারা শহরে এসে ফিজিক্যাল থেরাপি নিতে পারছেন না। তাই তাদের সুস্থ হতে আরো বেশি সময় লাগে। এসবই ফ্রোজেন শোল্ডার থেকে মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের বড় সীমাবদ্ধতা। সাধারণত ফ্রোজেন শোল্ডার থেকে সেরে উঠতে রোগীর দুই মাস সময় লাগে। তবে অন্য কোনো সমস্যা থাকলে দুই বছর পর্যন্ত লেগে যায়। ফ্রোজেন শোল্ডারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ওষুধের পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি ব্যায়ামের ভূমিকা অনেক বেশি।


ডা. মো. আরিফুল ইসলাম

সহকারী অধ্যাপক

ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগ

রংপুর মেডিকেল কলেজ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন