কালিদাস কর্মকার

পাললিক আত্মার খোঁজে

ওয়াহিদ সুজন

কালিদাস কর্মকারের চিত্রকর্ম ও তার ছবি প্রয়াত এ শিল্পীর ফেসবুক থেকে নেয়া

দেহ-মন; মানুষের চিন্তা সক্ষমতার মতোই প্রাচীন দ্বন্দ্ব। নিয়ে ধর্ম-দর্শন-শিল্পে আলোচনা কম নয়। এমন এক দ্বৈততা, যার সমাধান হওয়ার নয়। বরং তাকে ছাড়িয়ে যাওয়া যেতে পারে আত্মার বাগানে। দ্বন্দ্বমুখর মনই আত্মা খোঁজে, যেখানে মানুষ পরম ঐক্য অনুভব করে, দ্বন্দ্বটুকু নেই হয়ে যায়।

মানুষ নিজ ভাবনা ঐতিহাসিক সীমারেখার ভেতর আত্মাকে রাঙায়। কালিদাস কর্মকারের শিল্প আলোচনায় বারবার ফিরতে হয় সেই রঙ-রূপ-রেখার মাঝে, যেখানে অধরা অচিন আত্মা বসত করে। এই সেই ফিনিক্স পাখি, যেখানে মাটির মানুষ থাকে সোনার মহল গড়িয়া

পাখি হওয়ার জন্যই আত্মার ধারণার জন্ম! যার ভেতর একই সঙ্গে খেলে গতি-স্থিতি। যে সর্বপ্রাণে ব্যাপৃত। তার অতলে থাকে সব জন্মের ঠিকুজি। যুক্তি-অযুক্তি, জ্ঞাত-অজ্ঞাত সবকিছুই তাতে নস্যি। আত্মার হদিস করলে মানুষের একান্ত যে রূপ ধরা পড়ে, যাকে ধরা বা বাধা যায় না। এই অনির্বচনীয়কে খুঁজতে হয় মূর্ত জগত্, যাকে খুঁজতে গেলে বাস্তবতা নিজেই ভেঙে পড়ে বিমূর্ত রূপের ভেতর। যাকে আর চাক্ষুষ আলো-ছায়ায় ফুটিয়ে তোলা যায় না।

কালিদাসের চিত্রজগত্ আত্মা নিয়ে মানুষের ভাবনার রূপান্তর। বাংলায় ফিগারেটিভ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে অদেখা জগত্ ফুটিয়ে তুলতে দেখি, সেখানে ঐতিহ্যের সঙ্গে হাজির করেছেন সর্বসাম্প্রতিক নানা অনুষঙ্গ। ফর্ম মাধ্যম ভাঙা-গড়ার ভেতর দিয়ে নিত্যনতুন হয়ে ওঠেন। প্রযুক্তির উত্কর্ষের সঙ্গে শিল্পের মেলবন্ধনকে গভীরভাবে আত্মস্থ করতে দেখি আমরা। ধারণার আত্মার চেয়ে তার শিল্পের আত্মা আমাদের শিহরিত করে। আমরা তাকে ধরতে পারি।

তার শিল্প নির্মাণে সহজ দর্শন আছে। প্রয়োগবাদী সে চিন্তা। তার ভাবনায় কোনো কিছুই ফেলনা ছিল না। শিল্প এক সর্বব্যাপী ঘটনা, যেখানে ইট-কাঠ, নুড়ি কিংবা আরো কিছু; কোনো কিছুই ফেলনা নয়। বলছিলেন, শিল্প, শিল্পের উপাদান আমাদের চারপাশে অজস্র, আমাদের শুধু খুঁজে বের করতে হবে।

বস্তুজগতের সঙ্গে এই যে ভাবের মেলামেশা; তার চিত্রে আমরা দেখেছি অনুবিশ্বের বিস্ময়কর রূপান্তর। মানুষের মনকে এভাবেও পড়া যায়!

কালিদাসের একাধিক প্রদর্শনীর শিরোনাম থেকে তার কাজের দার্শনিক কেন্দ্রবিন্দু সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এর মধ্যে পাললিক সিরিজ খুবই পরিচিত। পাললিক প্রাণ-মাটি-প্রতীক, পাললিক অনুভব, পাললিক স্মৃতি বা পাললিক আত্মা। আবার আত্মার প্রসঙ্গ এসেছে রিয়ালাইজেশন অব সৌল বা সৌল সয়েল সিম্বলস শিরোনামে।

বেশ কয়েক দশক বিস্তৃত পরিসরে নিজের শৈল্পিক নিপুণতায় রসিকজনের মন ভরিয়েছেন মহাজন। নিরীক্ষা সংশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি করেছিলেন স্বতন্ত্র ধারা, এজন্য তাকে পাললিক বাংলা শিল্পের রূপকার বলতেন কেউ কেউ। যখন শিল্প ভুবনে ছাপ রাখা শুরু করেন, তখন জয়নুল আবেদিন, কাইয়ুম চৌধুরী, কামরুল হাসান, এসএম সুলতান, হাশেম খান, শাহাবুদ্দিন আহমেদের মতো গ্রেট মাস্টাররা সমানতালে কাজ করে যাচ্ছিলেন। দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্তরে তারা বিখ্যাত। তাদের চিত্রকর্মে বাংলার যে চিরায়ত রূপ এসেছে তার চেয়ে খানিকটা ভিন্ন পথে হেঁটেছেন কালিদাস। ক্যানভাসে বাংলার মাটি-জল-হাওয়া অন্য রূপ পেয়েছে। আত্মা আত্মপরিচয়সহ হাজির হয়েছে মাটির মানুষ। বাংলার জনসমষ্টির ইতিহাস অনেক প্রাচীন হলেও আত্মপরিচয় শেকড়ের বিষয়টি শিল্প-সাহিত্য রাজনৈতিক বিশ্ব নির্মাণে সবসময় প্রশ্ন হয়ে হাজির ছিল এবং আছে। তাকে বিমূর্ত রূপ দিয়ে অনেকটাই ভেঙেছেন কালিদাস।

ফর্মের দিক থেকে নির্দিষ্ট করে বললে, গড়পড়তা শিল্পচর্চাকে ডিঙিয়ে স্বাতন্ত্র্য ভাষা তৈরির জন্য বেশ ঝুঁকিই নিয়েছিলেন। তার চিত্রভাষ্যে সুররিয়ালিজমের প্রভাবকে খোলা চোখে আবিষ্কার করা যায়। চিত্রের বিষয়ই এখানে নিয়ে আসে। অন্তর্গত চৈতন্যে যাকে আমরা ধরতে চাই, তার রূপটি প্রথাগত বর্ণনাধর্মিতার বাইরে রেখেছেন। আধুনিক মানুষের মানস জটিলতা বর্ণনাকে আরো কোণঠাসা করে ফেলে। একদিকে বিজ্ঞাননির্ভর সভ্যতায় যুক্তির চূড়ান্ত উন্মাদনা, অন্যদিকে মানুষের একাকিত্বের নতুন রূপ, যেখানে মানুষ একা হয়ে দেখে আবেগ-অনুভূতির অযৌক্তিক বিন্যাস। পরাবাস্তববাদী চিত্রায়ণ সেই পরিস্থিতির বহুল বর্ণিলতা বা চূড়ান্ত সরলতাকে প্রকাশ করতে পারে। এই নৈর্ব্যক্তিক পরিস্থিতির জন্য জুতসই ফর্ম ইম্প্রেশনিজম। কালিদাস বহুমাত্রিক প্রকাশধর্মে আশ্রয় করেছিলেন, যেভাবে মানুষ কোনো একক গুণ বা বাক্য দ্বারা প্রকাশযোগ্য নয়। যার বাইরে অ্যাবস্ট্রাক্ট ইম্প্রেশনিজম আর ভেতরে সুররিয়ালিজম। লক্ষণগুলো কালিদাসের রঙ-রেখায় মিলেছে। বাস্তবতা যেখানে গহিনের তালাশ করে খুঁজে পায় অনন্ত প্রশান্তি।

বস্তু ভাবনার বিমূর্ত সমর্পণে অভিজ্ঞতাপরম্পরা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একজন শিল্পীর অভিজ্ঞতা অবচেতনে তিনি যা বহন করে আনেন, তা একই সঙ্গে নির্দিষ্টকালে অতীতবাহিত চিন্তার ছাপ। আবার তাকে প্রকাশ হতে হয় সমকালীন ভাষায়। বোধটুকু কালিদাস কর্মকারের কাজে ভীষণভাবে উপস্থিত। নিজের চিন্তাকে আরো সমকালীন উপায়ের আশ্রয় করতে তত্পর ছিলেন সবসময়। তার শিল্প কৌতূহল ছিল সীমাহীন। যেমন তার কাজে নতুন মাত্রা এনেছিল ভিসকসিটি প্রিন্টিং। মাধ্যমে তাকে বাংলাদেশে পথিকৃত্ বলা যায়। নতুন মাধ্যম টেকনিকের প্রতি তার যে তপস্যা তা অনেকটা কোলাজের দিকে ধাবিত করে। ছাপচিত্রে তার পরিচিতি অনেকটাই ছড়ানো, যেখানে লোকজ মোটিফ প্রতীকের সমন্বয়ে গ্রামীণ কৃষ্টি যুগলবন্দি হয়েছে। ইতিহাস ঐতিহ্যের মধ্যে প্রশ্নবোধক হয়ে থাকা জীবনবোধ উপস্থাপন করেন তিনি। আধুনিক মনন বেশভূষার আড়ালে থাকা পলিমাটির সৌরভটুকু পুরোপুরি তার হাতে উঠে আসে। বিভিন্ন মাধ্যমের সংশ্লেষণ বাংলার ভবিষ্যত্ শিল্পযাত্রাকে সহজ আরো সাহসী করে নিঃসন্দেহে। সংখ্যার বিচারে কালিদাস কর্মকারের কাজের পরিমাণ বিপুল। বৈচিত্র্যের দিক থেকেও একই কথা প্রযোজ্য।

তার রঙের ব্যবহার নিয়েও আলোচনা আছে ঢের। রঙের ব্যবহারে এক ধরনের সাংগীতিক অনুরণন পাওয়া যায়। উজ্জ্বল রঙের সামনে থমকে দাঁড়াতে হয় কখনো কখনো। ক্যানভাসের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ভাঙাচোরা একটি মুখ বা নানা ধরনের আকৃতি বা আঁকিবুঁকি আরো গভীরে টানে। বিশেষ করে লালের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ব্যবহার তার মতো ভূ-ভাগে খুব কম শিল্পীই করেছেন। একবার তো বলে ফেললেন, তরুণ-তাজা প্রাণের এক বিশাল এনার্জি যেন এই লাল রঙে আছে। চিরনতুন অধরা যে আত্মা তার খোঁজ তো তাজা প্রাণই পাবে। সেই অবিনশ্বর যাত্রায় কালিদাস কর্মকারকে স্মরণে নিতে হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন