বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: এক সীমাহীন মুক্তির আনন্দ

ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। শনিবার। ঘড়ির কাঁটায় সকাল সাড়ে ৯টা। তখন অবশ্য ভারতীয় সময় সকাল ৯টা। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের সকাল বেলার খবর প্রচার হচ্ছে। প্রচণ্ড শীতের সকালে সংবাদ পাঠকের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো:

‘পাকিস্তানের কারাগার থেকে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া হয়েছে এবং তিনি আজ ভোর সাড়ে ৪টায় পিআইএর একখানা বিশেষ বিমানে করে এক অজ্ঞাত স্থানের দিকে যাত্রা করেছেন।’

শীতের কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের কিরণ রশ্মি তড়িত্ প্রবাহের মতো আকাশবাণী কলকাতার খবরটি ভেদ করে ছুটে চলল বাংলার আকাশে-বাতাসে। বাংলার মানুষ আনন্দে লাফিয়ে উঠল! বিশ্ববাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু অজ্ঞাত কোন স্থানে সেই শঙ্কা কাটতে অপেক্ষা করতে হয়েছে দুপুর পর্যন্ত। দুপুরের দিকে খবর পাওয়া গেল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিমানটি লন্ডন যাচ্ছে। রাতে বিবিসি প্রচার করছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাংবাদিক সম্মেলন। তখন সকলেই নিশ্চিত হলেন। লন্ডনে পৌঁছে বঙ্গবন্ধু উঠেছেন ক্ল্যারিজ হোটেলে। গণমানুষের কাছে খবরটি পৌঁছল ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় যখন বড় বড় করে ছাপা হলো: ‘বঙ্গবন্ধু এখন লন্ডনে’।

ক্ল্যারিজ হোটেল থেকে বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে কথা বললেন তত্কালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ রাসেলসহ পরিবার-পরিজনের সঙ্গে। তিনি জানালেন দুদিন পরই তিনি দেশে আসছেন। ১০ জানুয়ারি তিনি আসবেন।

‘তোমরা কি সবাই বেঁচে আছো?’ আবেগাপ্লুত হয়ে পরিবারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু প্রথমেই যে কথাটি বলেছিলেন। সাত বছরের ছোট ছেলে রাসেল বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করে, ‘আব্বা, ওরা কি তোমায় ছেড়ে দিয়েছে? তুমি কবে আসবে? ওরা কিন্তু আমাদের খুব কষ্ট দিয়েছে। আব্বা, এখন আমরা সবাই ভালো আছি।’  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন থেকে কথা বলছিলেন পরিবারের মাঝে আনন্দের বন্যা বইলেও চোখে ছিল আনন্দাশ্রু। বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলার সময় আবেগে ভেঙে পড়েন। পরিবারের সদস্য ছাড়াও বঙ্গবন্ধু কথা বলেন ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি ও তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে।

গোটা দেশ, দেশবাসী তখন উত্ফুল্ল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং তার লন্ডনে উপস্থিতির সংবাদ শুনে দলে দলে নারী-পুরুষ, রাজনৈতিক কর্মী-নেতা, আবালবৃদ্ধবনিতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সঙ্গে ধানমন্ডির বাসায় সাক্ষাত্ করতে যান। রাত দ্বি-প্রহর পর্যন্ত দেশী-বিদেশী সাংবাদিকসহ সবারই আনাগোনা ধানমন্ডির বাসায়।

নগরবাসীর উচ্ছ্বাসের বিবরণ পাওয়া যায় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার একটি রিপোর্টে। ‘এ খবর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার: আকুল ইচ্ছার উত্তর: আনন্দে কাঁদিয়া ফেলার’ শিরোনামে রিপোর্টে বলা হয়: সে খবরটি ছিল আনন্দের। আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার। সে খবরটি ছিল তীব্র ব্যাকুল প্রতীক্ষার উপহার। সে খবরটি ছিল উল্লাসের। আর আনন্দে কাঁদিয়া ফেলার। সে খবরটি ছিল বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের আকুল ইচ্ছার উত্তর। জাতির পিতা আসিবেন। হয়তো আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই। তিনি এখন লন্ডনে। রাস্তায় একজন দুইজন করিয়া পথ চলা মিছিলে পরিণত হইল। গগনবিদারি স্লোগান উঠিল। আবার মিষ্টি বিতরণের পালা শুরু হইল। কয়েকটি মিছিল গেল ধানমন্ডির দিকে। কয়েকটি বঙ্গবন্ধুকে সম্বর্ধনা জানানোর প্রস্তুতি নিতে ছত্রভঙ্গ হইল। কিন্তু সারাদিন জনতা একটি আনন্দের খবরের আলোচনাতেই মুখর থাকিলেন।’

উচ্ছ্বাস এ পর্যায়ের ছিল যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন থেকে যাদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন সাধারণ জনতা খুশিতে তাদের সঙ্গে কোলাকুলি করতে থাকে। সাধারণ জনগণ পর্যন্ত লন্ডনে কথা বলার জন্য ট্রাংককল বুক করতে থাকে।

কিন্তু প্রতীক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না। কবে আসবে ১০ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু কখন ঢাকায় ফিরবেন। অনেকে রোজাও মানত করেন প্রিয় নেতার জন্য। ৮ থেকে ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রতিটি জনপদ ছিল সবচেয়ে উত্তেজনাভরা এবং জনগণের লক্ষ ছিল ঢাকার দিকে। ঘরের মানুষ বাইরে, বাইরের মানুষ রাস্তায় আর রাস্তার মানুষ মিছিলে। অনাহার, ঘুম, নিদ্রা কোনো কিছুর প্রতি কারো খেয়াল নেই। দিকে দিকে একই আওয়াজ। তিনি আসছেন। জাতির পিতা আসছেন। কান পাতলেই হাজার কণ্ঠে শোনা যায় একই ধ্বনি, ভেঙেছে দুয়ার এসেছে জ্যোর্তিময়। কিংবা মাগো তোমার মুজিব এলো ফিরে।

‘খোকা কখন আসবে’—এক বিরাট জিজ্ঞাসা নিয়ে ঢাকা বিমানবন্দরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুত্ফর রহমান। আর তার পাশে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভগ্নীপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে বিমানবন্দরে সন্তানের অপেক্ষার এমন আকুতি যেন সারা বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি। সন্তানের আশায় পথ চেয়ে বসে থাকা সে ছবিটি ছেপেছিল ঢাকার দৈনিক বাংলার বাণী। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত‌্যাবর্তনের আরো দুয়েকটি ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ‌্য ছিল সন্তানের মঙ্গল কামনা করে তসবিহ পড়ছেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহময়ী জননী আর তার পাশেই বঙ্গবন্ধুর বড় কন‌্যা  শেখ হাসিনা আমাদের আজকের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ইতিহাস হয়ে রইল। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে জাতির জনক এলেন মুক্ত স্বদেশ ভূমে। জেগে উঠল একটা ঘুমন্ত জাতি। দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে আওয়াজ উঠল: জেলের তালা ভেঙেছি, শেখ মুজিবকে এনেছি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আনন্দ ও উচ্ছ্বাস ভারতেও কমতি ছিল না। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিলাভ ইতিহাসের দৃষ্টিতে খুব একটা সহজ সরলীকরণ বিষয় ছিল না। তার মুক্তির পেছনে মুজিব নগর সরকার এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কূটনীতি অবলম্বন করতে হয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করেছেন। ফলে আমরা দেখি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির প্রশ্নে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের ৪ নভেম্বর ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রদত্ত সংবর্ধনাতেও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি সুবিবেচনা ও সহানুভূতির প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন। এমনকি তিনি ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দিনেও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী যে তিনটি শপথের উল্লেখ করেছিলেন তার মধ্যে প্রথম ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা, দ্বিতীয় শেখ মুজিবের মুক্তি এবং তৃতীয় ভারতে আগত লাখ লাখ উদ্বাস্তুর স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো।

কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হলেও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে প্রতীক্ষার শেষ হচ্ছিল না। এ বিষয়ে ইন্দিরা গান্ধী এবং তার প্রশাসন খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এ সময় ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সেকেন্ড ইন কমান্ড কে. শাংকারান নায়ার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন ভুট্টোর সম্মতি আদায়ে। শেষ পর্যন্ত খবরটি ইন্দিরা গান্ধীর সাউথ ব্লকে জানাজানি হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া হচ্ছে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। বিশিষ্ট কূটনীতিক শশাঙ্ক ব্যানার্জী লিখেছেন, ভুট্টোর গোপন গেমপ্ল্যান সম্পর্কে নয়াদিল্লি জানত না এমন নয়। তার জায়গা থেকে ভারত ভুট্টোর এ ইতিবাচক কাজের জবাব দিতে প্রস্তুত ছিল। রাওয়ালপিন্ডি থেকে জীবিত মুক্তি পাওয়ায় মুজিবের সঙ্গে ভারতের আবেগময় যাত্রা সম্পূর্ণ হলো। দিল্লির সাউথ ব্লকে, সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ে এবং মিনিস্ট্রি অব এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্সে এক ধরনের অকল্পনীয় আনন্দ-উত্সব শুরু হলো, যা ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার আনন্দের পর খুব বেশি পাওয়া যায়নি।”

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকালে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দিল্লিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বিপুল সংবর্ধনা জানানো হয়। বঙ্গবন্ধু দিল্লি পৌঁছেন ভারতীয় সময় ৮টা ৬ মিনিটে। বিমান থেকে বঙ্গবন্ধু বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমবেত জনতার ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। ২১ বার তোপধ্বনি করে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি শ্রী গিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী তাকে স্বাগত জানান। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী তাকে স্বাগত জানানো পর শেখ মুজিব অন্যান্য মন্ত্রী এবং সমবেত অন্যদের সঙ্গে করমর্দন করেন। শুধু ভারতই নয়, দিল্লি বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অভ্যর্থনার জন্য ২৩টি দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। যে দেশগুলোর কূটনৈতিক নেতারা উপস্থিত ছিলেন—বেলজিয়াম, ভুটান, বুলগেরিয়া, কলম্বিয়া, কিউবা, চেকোস্লোভাকিয়া, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, পূর্ব জার্মানি, পশ্চিম জার্মানি, হাঙ্গেরি, আয়ারল্যান্ড, ইটালি, মরিসাস, মঙ্গোলিয়া, নরওয়ে, পোল্যান্ড, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ভ্যাটিকান সিটি এবং যুগোস্লাভিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত সবার আগে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।

আমজনতাও বাদ যায়নি। দিল্লির কনকনে শীত উপেক্ষা করে লাখ লাখ জনতা ভিড় করছে পালাম বিমানবন্দরে। শুধু একনজর বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য, তার বক্তৃতা শোনার জন্য। অসাধারণ কৃতজ্ঞতা আর শ্রদ্ধাবোধ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে বক্তৃতা শুরু করলেন, কিন্তু উপস্থিত শ্রোতা বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বক্তৃতা শুনতে আগ্রহী হলে তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে জনসভায় বললেন, ‘আমার দেশের কোটি কোটি মানুষের হাসির প্রস্রবণে অবগাহন করতে আমি ছুটে যাচ্ছি, কিন্তু অন্ধকার থেকে আলোকের পথে যাওয়ার আগে ভারতভূমিতে দাঁড়িয়ে আমার চিরন্তন কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেলাম ভারতের জনগণের প্রতি, অনন্যা ও অসাধারণ তার প্রধানমন্ত্রীর প্রতি, তার সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষ—ওনাদের সবার প্রতিই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অপরিসীম কৃতজ্ঞতা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শুধু তার দেশেরই নেত্রী নন, তিনি সমগ্র মানব জাতির নেত্রী। তার কাছে ব্যক্তিগতভাবেও আমি কৃতজ্ঞ। শ্রীমতী গান্ধী পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রের দুয়ারে দুয়ারে ধরনা দিয়েছেন। বলেছেন, মুজিবকে মুক্ত করো একটা রাজনৈতিক মীমাংসায় আসো।’

১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি কলকাতার যুগান্তর পত্রিকা লিখেছিল দিল্লিতে এ সংবর্ধনা আর কেউ পায়নি। পত্রিকাটি লিখেছিল: স্বাধীনতার পর গত ২৫ বছর [১৯৭২] বহু রাষ্ট্রপ্রধানকে সংবর্ধনা জানানো হয়েছে, কিন্তু এমনটি আর কখনো দেখা যায়নি। এ যেন যুদ্ধজয়ের পর স্বদেশ প্রত্যাগত বীরের প্রতি সংবর্ধনা। অভ্যর্থনার স্বতঃস্ফূর্ততা ও আন্তরিকতার জন্য আজকের দিনটি অবিস্মরণীয় নয় অথবা বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ ও শেখ মুজিবের মুক্তি এ যুগল জয়ে ভারত ও বাংলাদেশের সাড়ে ৬২ কোটি অধিবাসীর সম্মিলিত আনন্দোচ্ছ্বাসের জন্যই আজকের দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে না। আজকের দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে কারণ বঙ্গবন্ধুর এ ঐতিহাসিক সফরের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের আদর্শের দৃঢ় ভিত্তির ওপর দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে ঐক্য ও মৈত্রী সুপ্রতিষ্ঠিত হলো।

দিল্লির যাত্রাবিরতিতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে আপ্যায়িত হয়েছিলেন কলকাতার সুস্বাদু বাঙালি মিষ্টি নতুন গুড়ের সন্দেশ, মসলাদার সিঙ্গাড়া ও দার্জিলিংয়ের সেরা চা দিয়ে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই স্বল্পসময়ের মিটিংয়ে ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি উত্থাপন এবং সম্মতিসূচক মনোভাব আদায় করেছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি লন্ডন থেকে ঢাকা ফেরার পথেই দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর এ সহযোগিতা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আনন্দ আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। মাত্র কয়েক ঘণ্টার বিরতিতে দিল্লির কূটনৈতিক সাফল্যের অজেয় শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলেন বীরের বেশে, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বাংলাদেশ সময় বেলা পৌনে ২টায়। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রমনার রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত তখন দীর্ঘ পথ লাখ লাখ লোকের হর্ষধ্বনিতে আনন্দমুখর। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে ফিরে আসাকে অভ্যর্থনা জানালো হূদয়ের সব উষ্ণ ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে। দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকা উচ্ছ্বসিত ভাষায় লিখল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ও বাংলাদেশের নতুন যুগের সূচনার উচ্চাশা নিয়ে। বাঙালি জাতির জন্য এটা এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। অত্যন্ত আবেগময় এ দিনটিকে বাঙালি জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত।

[ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম, অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যাপস্টোন ফেলো (২০১৮), ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, ঢাকা]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন