বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি

স্বাস্থ্যসেবায় বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির ভূূমিকা ও সমস্যা

বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে অন্তর্ভুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি চারটি। এগুলো হলো অ্যালোপ্যাথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা। অ্যালোপ্যাথিক ছাড়া বাকি তিনটিকে বলা হয় বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি বা অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার (এএমসি) ইউনানি আয়ুর্বেদিক শত শত বছরের প্রাচীন আদি চিকিৎসা পদ্ধতি। গ্রিক থেকে ইউনানি, ভারত উপমহাদেশ থেকে আয়ুর্বেদিক এবং জার্মান থেকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার উত্পত্তি। মূলত ভেষজ, প্রাণিজ, খনিজ উপাদাননির্ভর ইউনানি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতি।

তুলনামূলক কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সহজে সুলভ মূল্যে পাওয়া যায় এএমসি। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ ইউনানি, আয়ুর্বেদিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবহার করে আসছেন। আমাদের পূর্বপুরুষরাও বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে চিকিৎসা নিয়েছেন। বিকল্প চিকিৎসায় ওষুধ ছাড়াও কাপিং থেরাপি, আকু প্রেসার, আকুপাংচার, লিচ থেরাপি, যোগ ব্যায়াম, মেডিটেশন, রেজিমেন্টাল থেরাপি, ঔষধি খাদ্য জীবনযাত্রা পরিবর্তনসহ নানা পদ্ধতি বিভিন্ন দেশে স্থানীয়ভাবে ব্যবহূত হয়। চিকিৎসা পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। সংস্থাটির মতে, পৃথিবীর প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ এএমসির মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে থাকে।

১৯৮৯ সালে দেশে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক পর্যায়ে পাঁচ বছর মেয়াদি শিক্ষা কোর্স এক বছরের ইন্টার্নশিপ (বিইউএমএস, বিএএমএস বিএইচএমএস) ডিগ্রি চালু হয়। এরপর ১৯৯৯ সালে ৪৫টি জেলা সদর হাসপাতালে অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ারের অধীনে ৪৫ জন ইউনানি, আয়ুর্বেদিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসককে সরকারিভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকরা জেলা পর্যায়ে বহির্বিভাগে রোগীদের বিকল্প চিকিৎসার মাধ্যমে সেবা প্রদান করে আসছে। ২০১৪, ২০১৫ ২০১৯ সালে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ২০০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরকারিভাবে ২৯৭ জন ইউনানি, আয়ুর্বেদিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয়। দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিতে সেবা নিচ্ছে এবং হাসপাতাল থেকে সরকারিভাবে রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ দেয়া হচ্ছে।

দেশে এএমসির উন্নয়নে এখন পরিকল্পনা করা হচ্ছে। গত বছরের অক্টোবরে স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে রাজস্ব খাতে প্রকল্পের শূন্য পদে এএমসি চিকিৎসকদের দ্রুত নিয়োগ, কেন্দ্রীয়ভাবে ভেষজ বাগান তৈরি, উচ্চ শিক্ষা গবেষণার ব্যবস্থা গ্রহণ, সরকারিভাবে ইউনানি, আয়ুর্বেদিক হোমিওপ্যাথিক ওষুধ তৈরির জন্য ইডিসিএলে ইউনিট চালু, বাংলাদেশ ইউনানি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শিক্ষা আইন কাউন্সিলর দ্রুত বাস্তবায়ন, এএমসি মেডিসিন কোম্পানিগুলো গুণগত মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি করছে কিনা সে বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করা এবং রিপোর্ট প্রদান করার পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের এএমসি চিকিৎসা শিক্ষার উন্নয়নে যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়েছিল তার দ্রুত বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোচনা হয়।

সমস্যা চ্যালেঞ্জ:

ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, কোরিয়া, চীন, থাইল্যান্ডে বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির জন্য আলাদা মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিশ্ববিদ্যালয়, রিসার্চ কাউন্সিল বিএমডিসির (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) মতো নিয়ন্ত্রক কাউন্সিল আছে। সেসব দেশে উচ্চ শিক্ষা, গবেষণা এএমসি চিকিৎসকদের সরকারিভাবে কর্মসংস্থান, পদোন্নতির যথেষ্ট সুযোগ থাকায় চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

তবে আমাদের দেশে এক্ষেত্রে বেশ সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ারে দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ নেই। গবেষণা কার্যক্রমও খুব সীমিত। এছাড়া যেসব চিকিৎসক পাস করে বের হচ্ছেন তাদের সরকারিভাবে তেমন কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। প্রায় ৩০ বছর ধরে সরকারি দুটি কলেজ হাসপাতাল এবং জেলা সদর হাসপাতালে কর্মরত শিক্ষক চিকিৎসকরা প্রভাষক মেডিকেল অফিসার পদে চাকরিতে প্রবেশ করছেন। পদোন্নতি না থাকায় প্রভাষক মেডিকেল অফিসার হিসেবেই অবসর গ্রহণ করছেন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি হাজার ৮৯৪ জনের জন্য রেজিস্টার্ড চিকিৎসক আছে মাত্র একজন, আর হাজার ৬৯৮ জনের জন্য সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে শয্যা রয়েছে একটি। দেশে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো বেশি। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়বহুল হওয়ায় তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। স্বাস্থ্যসেবায় এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে বাংলাদেশকে বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থায় গুরুত্ব দিতে হবে।

বিকল্প ধারার চিকিৎসা ব্যবস্থা পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত মানবদেহের মৌলিক উপাদানের ওপর নির্ভর করে রোগ নির্ণয় করা হয়, যার সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের সামঞ্জস্য রয়েছে। বাংলাদেশে বিকল্প ধারার চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা প্রচার-প্রসার না থাকায় সাধারণ জনগণের কাছে বিষয়ে জানাশোনা সচেতনতা কম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ারের অধীনে পরিচালিত একটি জরিপের মাধ্যমে জানা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা হাসপাতাল থেকে এএমসি পদ্ধতিতে চিকিৎসা গ্রহণ করছে ২৬ শতাংশ রোগী।

আবার কিছু অসাধু হারবাল কোম্পানির চটকদার বিজ্ঞাপনের ফলে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়েছে ভুল বার্তা। জনসাধারণ মনে করে, বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি মানেই মাত্র দুই-তিনটা বিশেষ রোগের চিকিৎসা দেয়া। আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে এএমসির ওষুধ উৎপাদন বিপণন হচ্ছে। বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও প্রায় ৪০টি অ্যালোপ্যাথিক ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি ইউনানি, আয়ুর্বেদিক হারবাল ওষুধ উৎপাদন বিপণন করছে।

রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে একজন অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার চিকিৎসকের মাধ্যমে বন্ধ্যাত্ব রোগীদের সফল চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে সেই চিকিৎসককে গাইনি বিভাগে সম্পৃক্ত করে অ্যালোপ্যাথিক বিকল্প চিকিৎসার সমন্বয়ে টিম গঠন করে সমন্বিত চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া হাসপাতালের জার্নাল কমিটিতেও বিকল্প ধারার চিকিৎসক অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকদের নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা হাসপাতালে সরকারিভাবে কর্মরত অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ারের চিকিৎসক বেসরকারি চিকিৎসকরা রোগীদের মেডিসিন, স্থানীয় ভেষজের মাধ্যমে এবং জীবনযাত্রার ধরন পরিবর্তনের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা প্রদান করে যাচ্ছেন। ফলে রোগীরা স্বল্পমূল্যে মেডিসিন, স্থানীয় ভেষজ বেশকিছু থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা পাচ্ছেন। এভাবে তারা আর্থিক মানসিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। বর্তমানে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হূদরোগ, ওবেসিটির (অতিরিক্ত ওজন) মতো অসংক্রামক রোগ মহামারী আকার ধারণ করেছে। অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ জীবনযাত্রার অনুন্নত মান এর মূল কারণ। এএমসির মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা পরিবর্তন ঔষধি খাদ্য, স্থানীয় ভেষজের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর রোগ প্রতিরোধ সুস্থতা আনয়ন করা সম্ভব।

 

ডা. মো. মাছুদুর রহমান

পরিচালক (অল্টারনেটিভ মেডিসিন)

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর

ডা. মো. হাসান ইমাম

লেকচারার (অল্টারনেটিভ মেডিসিন)

সহকারী ফোকাল পারসন কর্মকর্তা (মেডিকেল কলেজের এপিএ সংক্রান্ত)

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন