
ডা. মো. আবু জাহের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার (এএমসি) বা বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির পরিচালক ও লাইন ডিরেক্টর। দেশে বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করছেন। কাজ করছেন নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও। স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিতে চিকিৎসা প্রদান, মানুষের মধ্যে সচেতনতা, গবেষণা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ
বাংলাদেশে বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি বা অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ারের (এএমসি) প্রসার সম্পর্কে জানতে চাই।
আমাদের দেশে গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে একটামাত্র ইউনানি কলেজ। সিলেটে একটা হোমিওপ্যাথিক কলেজ আছে, যারা ডিপ্লোমা ডিগ্রি দিত। খুব সম্প্রতি সেখানে গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি চালু হয়েছে কিন্তু ভর্তি শুরু হয়নি। যেখানে ১৬ কোটির ওপরে মানুষের বসবাস সেখানে একটা মেডিকেল কলেজ মোটেও পর্যাপ্ত নয়। দেশের ৩৩০টি উপজেলায় তিন ডিসিপ্লিনারি চিকিৎসক কর্মরত আছেন। বাকি উপজেলায় কোনো চিকিৎসক নেই। ফলে এ পদ্ধতিতে যারা চিকিৎসা দেবে, প্রচার-প্রচারণা করবে, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করবে এমন কেউ নেই। প্রতিটি উপজেলায় অন্তত একজন করে হলেও সাড়ে চারশর ওপর হোমিও, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ডাক্তার দরকার। প্রতিটি উপজেলায় যদি একজন করে চিকিৎসক প্রদান করা হয়, তাহলে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হবে।
সরকারিভাবে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা নিচ্ছে ১৪ শতাংশ মানুষ, ২৩ শতাংশ বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর ভরসা করছে। বাকিরা চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে। এই বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে এএমসিতে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেয়া যায়?
আমাদের ক্ষুদ্র যে পরিকল্পনা আছে সেটা থেকে আমরা প্রচার-প্রচারণার কিছু কাজ করি। যেমন প্রতিটি উপজেলায় পোস্টার বানিয়ে অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার সম্পর্কে ধারণা দেয়া আছে। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নিয়েও আমাদের কিছু প্রচার-প্রচারণা আছে। কিন্তু ব্যাপক আকারে নেই। আমাদের যে বাগানগুলো আছে যেখানে হারবাল উদ্ভিদ থাকে বা যে কম্পাউন্ডার আছে তা অপ্রতুল। তাই কাজগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে না। দেশে যে বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি আছে তার অবস্থা অনেক করুণ। আমাদের দেশে প্রচলিত আয়ুর্বেদিক ইউনানি ৫ হাজার বছরের পুরনো। এ পুরনো চিকিৎসা পদ্ধতিকে যদি আমরা ঢেলে সাজাতে পারি তাহলে দেশের মানুষ ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে।
এএমসি ও লোকজ চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য কী?
লোকজ চিকিৎসা বলতে যেখানে ঝাড়ফুঁক ও স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন লতা-পাতা ব্যবহার করা হয়। এর সুনির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি নেই। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো প্রতারণামূলক চিকিৎসা। আর বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি বিজ্ঞানভিত্তিক এবং তা প্রমাণিত। রাস্তাঘাটে অনেক সময় দেখা যায়, অনেক রোগের ওষুধ খাওয়াচ্ছে। সেখানে কিন্তু অল্টারনেটিভ চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। কবিরাজ হেকিম নাম দিয়ে প্রতারণামূলক চিকিৎসা করা হয়। আমরা এ ধরনের চিকিৎসা দেয়ার বিপক্ষে। আমরা চাই, এর একটা কাঠামোগত অবস্থান থাকবে, উপজেলা পর্যায়ে ও জেলায় চিকিৎসকরা থাকবে এবং মেডিকেল কলেজ থাকবে।
দেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিকল্প পদ্ধতিতে চিকিৎসা প্রদানের বিষয়ে বলুন।
আমাদের বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির যে তিনটি ভাগ রয়েছে আয়ুর্বেদিক, ইউনানি ও হোমিওপ্যাথিক—তার প্রতিটির অন্তত একজন করে চিকিৎসক প্রতিটি উপজেলায় থাকা দরকার। এ বিষয়টি আরো ব্যাপক সম্প্রসারিত করা দরকার। সরকারি পর্যায়ে আরো অনেক মেডিকেল কলেজ নির্মাণ করা দরকার। আমাদের দেশে ৩৮ থেকে ৪০টি অ্যালোপ্যাথিক সরকারি মেডিকেল কলেজ আছে। ইউনানি আয়ুর্বেদিক কিন্তু সেই পরিমাণে নেই। হোমিওপ্যাথিক যেগুলো আছে সেগুলো সরকারি নয়, বেসরকারি। ফলে তার মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এসব ঢেলে সাজানোর দরকার আছে। সময়ের সঙ্গে আপডেট করা দরকার। এমএ পাস করার পর বা চাকরি থেকে রিটায়ার করার পরও একজন এসে এ শিক্ষায় ভর্তি হতে পারেন, তা বাতিল করা দরকার।
মানুষের আস্থা অনুযায়ী এএমসির বাস্তবায়ন কতটুকু হচ্ছে?
ভারতেও এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা ব্যাপক প্রসারিত। কিছু ওষুধ আছে যা রফতানি করে ভারত প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডে এ চিকিৎসা স্বীকৃত। কিন্তু আমাদের দেশে বিষয়টা পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হয়নি। আমরা চেষ্টা করছি, তবে ততটা উন্নতি হয়নি। এই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম এবং মানুষ উপকার পায়।
বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কেমন?
বাংলাদেশে এ-সংক্রান্ত কোনো পরিসংখ্যান বা মন্ত্রণালয় নেই। প্রধানমন্ত্রী চান ইউনানি, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতিকে মূল ধারার চিকিৎসা পদ্ধতিতে নিয়ে আসতে। কিন্তু সেই পরিকল্পনা এখনো পুরো শৈশব পর্যায়ে রয়েছে। এএমসি বাংলাদেশে ব্যাপক আকারে প্রসারিত হতে আরো সময় লাগবে। চিকিৎসা পদ্ধতিটি এ উপমহাদেশে যেভাবে প্রচার-প্রচারণা পেয়েছে বাংলাদেশেও সেভাবে পেলে মানুষ উপকৃত হবে।
বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি বাস্তবায়নে বর্তমানের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাই।
সরকারি কলেজগুলোতে সব ইকুইপমেন্ট, ওষুধ-ডাক্তার ইত্যাদি প্রকল্প থেকে দেয়া হয়। তাদের পড়াশোনা চালানোর জন্য যে ইকুইপমেন্ট, ল্যাবরেটরিতে সাপোর্ট বা যন্ত্রপাতি দরকার সেগুলোও প্রজেক্ট প্ল্যান থেকে কিনে দেয়া হয়। বিভিন্ন উপজেলায় থাকা ভেষজ বাগান আমরা অর্থায়ন করে থাকি। বিভিন্ন উপজেলায় যে ৩৩০ জন চিকিৎসক আছেন তাদের আমরা ওষুধ দিই বিনামূল্যে জনগণের মধ্যে বিতরণের জন্য। আর যারা চিকিৎসক আছেন তাদের বেতন-ভাতা প্রদান করি।
সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা কী কী রয়েছে?
মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রীদের আমাদের প্রতি সফট কর্নার আছে। কিন্তু কিছু মামলার জটিলতার কারণে এসব প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। দেখা যায় দুজনের মধ্যে কিছু কিছু কনফ্লিক্ট আছে, তারা একে অন্যের বিরুদ্ধে মামলা করে। তাতে চলমান প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। আর্থিকভাবে যতটা দরকার আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে চেষ্টা করা হয়। আরেকটা পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্প একনেকে পাস হবে। আশা করি তাতে সব প্রকল্প চলমান থাকবে।
বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির চিকিৎসকদের নিজ উদ্যোগে চেম্বারে রোগী দেখার সীমাবদ্ধতা এবং এএমসি বিষয়ে গবেষণার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আপনার মতামত বলুন।
সবাই যার যার গণ্ডির মধ্যে থাকলে আইনি কোনো বিরোধ নেই। কেউ কেউ অল্টারনেটিভ মেডিসিন নামে ভারত থেকে ডিগ্রি আনে। এ ডিগ্রি কতটা বৈধ আমি জানি না। যারা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত মেডিকেল কলেজ থেকে বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিতে পাস করেছে তাদের ডাক্তার লিখতে দেয়া উচিত। তবে ডাক্তার লেখায় হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা আছে, ফলে মন্তব্য না করা সমীচীন। আর গবেষণার ক্ষেত্রে বলতে পারি এ পদ্ধতির জন্য সরকারিভাবে কোনো ওষুধ তৈরি করা হয় না। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডে (ইডিসিএল) অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ বানানো হয় কিন্তু এভাবে হোমিওপ্যাথি, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ওষুধ বানানো হয় না। এসব ওষুধের জন্য ইডিসিএলের একটি প্লান্ট থাকা উচিত। বাংলাদেশে প্রায় ২৩০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে যারা এএমসির ওষুধ বানায়।