রাষ্ট্রপতি হিসেবে সংসদে শেষ ভাষণ আবদুল হামিদের

নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতীয় সংসদে গতকাল ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ছবি: পিআইডি

বছরের প্রথম শীতকালীন অধিবেশন শুরু হয়েছে। একাদশ সংসদের ২১তম অধিবেশন চলবে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। স্পিকার . শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে গতকাল বিকাল ৪টা ১০ মিনিটে সংসদের বৈঠক বসে। সংবিধান অনুযায়ী পরে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। রাষ্ট্রপতি হিসেবে সংসদে এটি তার শেষ ভাষণ। অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী সংসদ নেতা শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ উপস্থিত ছিলেন।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে আগামী এপ্রিলে শেষ হচ্ছে আবদুল হামিদের মেয়াদ। সংবিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগ নেই। আবদুল হামিদ ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রথম মেয়াদে শপথ নেন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তিনি।

জাতীয় সংসদকে দেশের জনগণের সব প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, স্বাধীন সার্বভৌম দেশে জনগণই সব ক্ষমতার উৎস এবং তাদের প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দু জাতীয় সংসদ। আপনারা জনপ্রতিনিধি, তাই জনস্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। নতুন প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, সুখী, সুন্দর উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দেয়া আমাদের পবিত্র কর্তব্য।

প্রতিবারের মতো এবারো মন্ত্রিসভার ঠিক করে দেয়া ১৬৮ পৃষ্ঠার ভাষণের সংক্ষিপ্তসার অধিবেশনে পড়েন রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, দেশের অগ্রযাত্রাকে বেগবান করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে জাতি এগিয়ে যাক ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত, আত্মমর্যাদাশীল বঙ্গবন্ধুর সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার পথে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মাদক জঙ্গিবাদকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূলের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাঙালি জাতিকে আরো ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।

সংসদের নতুন বছরের প্রথম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণ দেয়ার বিধান রয়েছে। পরে তার ভাষণের ওপর একটি ধন্যবাদ প্রস্তাব আনা হয়। অধিবেশনজুড়ে ওই প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করেন সংসদ সদস্যরা। আলোচনা শেষে রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে সংসদে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।

সংসদ কক্ষে গতকাল রাষ্ট্রপতি ঢোকার পর নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। স্পিকারের ডান পাশে রাখা চেয়ারে তিনি আসন নেন। স্পিকারের অনুরোধের পর তিনি তার লিখিত ভাষণের সংক্ষিপ্তসার পড়া শুরু করেন। সময় তার মূল বক্তব্য পঠিত বলে গণ্য করার জন্য স্পিকার শিরীন শারমিনকে অনুরোধ জানান আবদুল হামিদ। স্পিকারের আসনের বাম পাশে রাখা রোস্ট্রামে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেন তিনি।

মূল ভাষণের সংক্ষিপ্তসারে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অর্থনীতি, বাণিজ্য-বিনিয়োগ, খাদ্য-কৃষি, পরিবেশ-জলবায়ু, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের কার্যক্রম সাফল্য তুলে ধরেন। এছাড়া দেশে আইনের শাসন সুসংহত সমুন্নত রাখা এবং সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের কার্যক্রমের প্রশংসা করেন। এছাড়া মহামারী যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে এর প্রশংসা করেন রাষ্ট্রপ্রধান।

আবদুল হামিদ বলেন, জাতীয় জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ আমরা অতিবাহিত করছি। ২০২২ সাল ছিল চ্যালেঞ্জের একটি বছর। সমগ্র বিশ্বই পার করছে এক কঠিন সময়। করোনা অতিমারী আমরা সফলভাবে মোকাবেলা করে অর্থনীতি গতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হলেও রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধ আমাদের অগ্রযাত্রাকে শ্লথ করেছে। তার পরও ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেট ১৪ শতাংশ বেড়ে লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করে রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয় নীতির ওপর ভিত্তি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল দূরদর্শী নেতৃত্বে পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারকরণ, ব্যবসা-বাণিজ্য শ্রমবাজার সম্প্রসারণে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য করা, নারীর ক্ষমতায়ন জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে।

রাষ্ট্রপতির ভাষণের পর স্পিকার শিরীন শারমিন সংসদের বৈঠক রোববার বিকাল সোয়া ৪টা পর্যন্ত মুলতবি করেন।

অধিবেশন চলবে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত: বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আগামী এপ্রিলে বসবে বিশেষ অধিবেশন। জাতীয় সংসদ ভবনে গতকাল অনুষ্ঠিত কার্যোপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। একাদশ জাতীয় সংসদের কার্যোপদেষ্টা কমিটির একাদশ বৈঠকে কমিটির সভাপতি স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী সভাপতিত্ব করেন। কমিটি সদস্য এবং সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বৈঠকে অংশ নেন। এছাড়া ছিলেন কমিটির সদস্য বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, আমির হোসেন আমু, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ওবায়দুল কাদের, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, ডেপুটি স্পিকার মো. শামসুল হক টুকু, আনিসুল হক, গোলাম মোহাম্মদ কাদের, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, চিফ হুইপ নূর--আলম চৌধুরী।

বৈঠকে একাদশ জাতীয় সংসদের ২১তম অধিবেশনের কার্যাদি নিষ্পন্নের জন্য সময় বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত আসে, আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে অধিবেশন। শুক্র শনিবার ব্যতীত প্রতিদিন বিকাল সোয়া ৪টায় তা শুরু হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে ১০ জানুয়ারি বিশেষ আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়।

অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর জন্য ৭৩টি অন্যান্য মন্ত্রীর জন্য হাজার ৮৫৪টি প্রশ্নসহ মোট হাজার ৯২৭টি প্রশ্ন পাওয়া গেছে। বিধি-৭১- মনোযোগ আকর্ষণের নোটিস পাওয়া গেছে ৩৪টি। বেসরকারি সদস্যদের বিলের কোনো নোটিস পাওয়া যায়নি। আগে অনিষ্পন্ন আটটি বেসরকারি বিলের মধ্যে গত সপ্তদশ অধিবেশনে একটি বিল উত্থাপিত হয়ে কমিটিতে পরীক্ষাধীন রয়েছে। অধিবেশনে উত্থাপনের জন্য ছয়টি সরকারি বিল গত অধিবেশনে অনিষ্পন্ন ১২টি বিলসহ ১৮টি বিলের মধ্যে কমিটিতে পরীক্ষাধীন ১১টি, পাসের অপেক্ষায় একটি উত্থাপনের অপেক্ষায় ছয়টি।

সংসদে শোক প্রস্তাব: একাদশ জাতীয় সংসদের ২০তম অধিবেশন শুরু পর যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি মারা গেছেন তাদের নামে সংসদে শোক প্রস্তাব আনা হয়। অধিবেশন শুরুর পর স্পিকার তাদের নামে শোক প্রস্তাব আনেন। পরে মরহুমদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দাঁড়িয়ে মিনিট নীরবতা পালন শেষে তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান দুলাল।

এর আগে স্পিকার বলেন, আমি গভীর দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে আমরা এরই মধ্যে একজন সাবেক মন্ত্রী, দুজন সাবেক প্রতিমন্ত্রী, একজন সাবেক বিরোধীদলীয় হুইপ চারজন সাবেক সংসদ সদস্যকে হারিয়েছি।

এবারের সংসদ অধিবেশনে আওয়ামী লীগের সংসদ উপনেতা মনোনয়ন দেয়া হবে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুতে পদটি শূন্য হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন