১০ হাজার কর্মীর একটি দক্ষ দল এএমএল

দেশের প্রায় সব বড় অবকাঠামোয় আব্দুল মোনেমের ছাপ আছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

আব্দুল মোনেম (জন্ম: ৫ জানুয়ারি ১৯৩৭—মৃত্যু: ৩১ মে ২০২০) ছবি: আব্দুল মোনেম লিমিটেড

নিভৃত এক গ্রাম থেকে এসএসসি পাসের সনদ নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন আব্দুল মোনেম। পকেটে কেবল ৭০ টাকা। ব্যস্ত শহরে যেখানে টিকে থাকাই ছিল সংগ্রামের, সেখানে তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি নাম লেখান নির্মাণ ব্যবসায়। শুরুতে নিজে শিখেছেন, তারপর শিখিয়েছেন। একসময় সেই ছেলেটিই হয়ে উঠেছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী। পণ্য উৎপাদন সেবা খাতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার পদচারণ থাকলেও নির্মাণ শিল্পে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতকে শক্তিশালী করার পেছনে আব্দুল মোনেম অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। নিজের হাতে গড়া আব্দুল মোনেম লিমিটেডে (এএমএল) কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন ১০ হাজারের বেশি মানুষকে। কর্মসংস্থানের পরিধি ক্রমে বেড়েই চলেছে।

আব্দুল মোনেমের সাফল্যকে সবসময় শাণিত করেছে তার সততা, শ্রম আর কাজের গুণগত মান। একটা সময় দেশের সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়নে যখন চেয়ে থাকতে হতো বিদেশীদের দিকে তখন নিজস্ব চিন্তা, সাহস আর অভিনবত্বে বাংলাদেশকে এনে দিতে থাকেন একের পর এক সাফল্য। পদ্মা সেতু থেকে কর্ণফুলী টানেল কিংবা যমুনা সংযোগ সড়ক অথবা নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামোএসব কিছুরই বড় একটা অংশই বাস্তবে রূপ দিয়েছে আব্দুল মোনেমের সুদূরপ্রসারী ভাবনা। এসব কাজে গ্রুপটি ব্যবহার করেছে নিজস্ব যন্ত্রপাতি। পদ্মা সেতু নির্মাণে একমাত্র দেশীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আব্দুল মোনেম লিমিটেড সরকারসহ সব মহল থেকে বিশেষ সম্মান অর্জন করে।

দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানটি নির্মাণ করেছে ৪৪ কিলোমিটার দীর্ঘ খুলনা-মোংলা হাইওয়ে, ৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ ভাটিয়াপাড়া-গোপালগঞ্জ-মোল্লারহাট রোড, গোপালগঞ্জ বাইপাসসহ, গড়াই ব্রিজ, মাওনা ব্রিজ, গুলশান বনানী ব্রিজ, বনানী ফ্লাইওভার, লালন ব্রিজের সংযোগ সড়কসহ আরো অনেক কিছু। ১৯৮৪ সালে খুলনা-মোংলা হাইওয়ের কাজ করে প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড লাভ করে। সেই আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে প্রতিষ্ঠানটি পৌঁছে যায় এক নতুন উচ্চতায়। আর পদ্মা বহুমুখী ব্রিজে কাজ করার মধ্য দিয়ে সেই অবস্থান স্থায়িত্ব লাভ করে।


মালয়েশিয়ান কনস্ট্রাকশন ফার্ম এইচসিএমের সঙ্গে এএমএল একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার স্থাপন করেছে। এই ভেঞ্চারের অধীনে পদ্মা মূল সেতুর দুদিকে জাজিরা মাওয়া প্রান্তে দুটি সংযোগ সড়ক তৈরির দুটি আলাদা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। দুটি চুক্তির মধ্যে ছিল পাঁচটি ব্রিজ, ২০টি কালভার্ট আটটি আন্ডারপাসের নির্মাণকাজ। পদ্মা ব্রিজের জন্য সার্ভিস এরিয়া- তৈরি করার আন্তর্জাতিক টেন্ডারও পায় একমাত্র এএমএল।

সুউচ্চ ভবন, হাইড্রোলিক স্ট্রাকচার, বিমানবন্দর, নদীতে জেটি টার্মিনাল, বাস টার্মিনাল, ফ্যাক্টরি এবং এমন আরো অনেক কিছু তৈরি করেছে এএমএল। প্রতিষ্ঠানটির প্রচেষ্টায় আভিজাত্যের ছাপ দেখা যায়। এএমএল সফলভাবে হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে সংস্কার প্রকল্প সম্পন্ন করেছে। সবচেয়ে কম সম্ভাব্য সময়ে ওই প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছিল। সফলভাবে সিলেটে ওসমানী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের কাজ, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এসএম বারাক অ্যান্ড দামালকোটের কাজ, ঢাকার গাবতলী, মহাখালী সায়েদাবাদে তিনটি বাস টার্মিনাল, সাত লাখ বর্গফুট জায়গাজুড়ে তিনটি টাওয়ার মোনেম বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট বানিয়েছে। শুধু নির্মাণকাজের মধ্যেই কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ না থেকে পরবর্তী সময়ে আইসক্রিম ইউনিট বেভারেজ ইউনিট, ২০০০ সালে ম্যাংগো পাল্প প্রসেসিং, ২০০৪ সালে ইগলু ফুডস, ড্যানিশ বাংলা ইমালসন, সিকিউরিটিজ ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড, ইগলু ডেইরি প্রডাক্টস লিমিটেড, ২০০৭ সালে সুগার রিফাইনারি লিমিটেড এএম এনার্জি লিমিটেড, ২০০৮ সালে নোভাস ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, ২০১০ সালে এএম অ্যাসফল্ট অ্যান্ড রেডিমিক্স লিমিটেড, ২০১২ সালে এএম অটো ব্রিকস লিমিটেড, ২০১৪ সালে এএম ব্র্যান অয়েল কোম্পানি এবং ২০১৫ সালে আব্দুল মোনেম ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক গ্রুপে পরিণত হয়েছে। এএম বেভারেজ ইউনিটের অধীনে এএমএল কোকা-কোলা ব্র্যান্ডের কোকা-কোলা, ফ্যান্টা, স্প্রাইট কিনলে ড্রিংকিং ওয়াটার বোতলজাত করে আসছে। ইগলু আইসক্রিম বাংলাদেশে একটি অতিপরিচিত নাম।

আব্দুল মোনেমের শেষ স্বপ্ন ছিল প্রাইভেট ইকোনমিক জোন তৈরি। ওই জোনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিনিয়োগ আসবে। এক কোটি লোকের কাজের সুযোগ তৈরি করে দেয়ার প্রবল ইচ্ছা ছিল আব্দুল মোনেমের। ২০১৫ সালে বেজার কাছ থেকে আব্দুল মোনেম ইকোনমিক জোন লাইসেন্স পায়, যা প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন। ইকোনমিক জোনের কাজ দ্রুত অগ্রসরমাণ।

চাকরির সুযোগ তৈরি বৈচিত্র্যময় ব্যবসায়িক কার্যক্রমের পাশাপাশি আব্দুল মোনেম লিমিটেড মনে করে, সমাজের ভালো থাকা নিশ্চিত করার জন্য তাদের আরো অনেক কিছু করার রয়েছে। জনগণ, সমাজ দেশের প্রতি অবদানের যখন স্বীকৃতি দেয়া হয় তা অনুপ্রাণিত করে। এএমএল পেয়েছে সেরা করদাতার সম্মাননা, সর্বোচ্চ মূল্য সংযোজন কর প্রদানকারীর সম্মাননা, আইএফএডব্লিউপিসিএ গোল্ড মেডেল, বিজনেস পারসন অব দি ইয়ার ২০০৮, কমার্শিয়ালি ইম্পরট্যান্ট পারসন ২০১০, ২০১১ ২০১৩, যমুনা ব্যাংক লিমিটেডের এক্সিলেন্স ফর বিজনেস পারফরম্যান্স।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন