বাংলাদেশের উন্নয়ন গল্প ও আব্দুল মোনেমের আখ্যান একই সূত্রে গাঁথা

এএসএম মঈনুদ্দিন মোনেম

আমরা জীবনে সবাই সফল হতে চাই, সেরা হতে চাই, বিখ্যাত হতে চাই। পৃথিবীজুড়ে শতকোটি মানুষের মাঝে সবাই কি সফল হতে পারে? এদের মধ্যে শুধু হাতে গোনা কয়েকজন সফলকাম হন। এর কারণ কী? নশ্বর পৃথিবীতে বিখ্যাত ব্যক্তিরা প্রতিদিন জন্মগ্রহণ করেন না। তারা আসেন হয়তো শতবর্ষের ব্যবধানে। তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনে পৃথিবীতে রেখে যান অনেক কীর্তিগাথা, যা মানুষ মনে রাখে সুদীর্ঘ সময়কাল, ভোগ করে এর সুফল। এমনই এক ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে।

দেশে সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় শূন্য অবস্থান থেকে শীর্ষ সারিতে আরোহণ করা হাতে গোনা যে জন সুপ্রতিষ্ঠিত সফল ব্যক্তির নাম ওঠে, এর মধ্যে একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি মোনেম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আলহাজ আব্দুল মোনেম, যিনি আমার গর্বিত বাবা। লক্ষ্যে পৌঁছার অদম্য মনোবল, চেষ্টা আর অধ্যবসায় যে একজন মানুষকে তার লালিত স্বপ্নের শিখরে নিয়ে যায়, তার এক অনন্য উদাহরণ তিনি। শুরু থেকেই জিরো থেকে হিরো হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার চিন্তা-চেতনায়। পাথেয় না থাকলেও অনিশ্চিত স্বপ্নের পথে রওনা হন তিনি। শুধু ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তা, স্মার্টনেস কিংবা অর্থসম্পদ ইত্যাদির ওপর সফলতা নির্ভর করে না, বরং ব্যক্তির আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং নিবিষ্ট মনে কর্মে লেগে থাকা গুণের ওপর সফলতা নির্ভর করে। সুদীর্ঘকাল নানা টানাপড়েন, ত্যাগ-তিতিক্ষা পরিশ্রমের মাধ্যমে বাবা অর্জন করেন বিরল সফলতা।

পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে এসএসসি পাস করে বাবা যখন ঢাকায় আসেন, তখন তার হাতে ছিল গুটিকয়েক টাকা, যা দিয়ে চলাই ছিল দায়। সময় সরকারের সার্ভে পদে পরীক্ষা দেন এবং প্রথম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু চাকরিতে তার মন টেকেনি। স্বপ্ন ছিল আরো বড় কিছু করার, বড় কিছু হওয়ার। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ব্যবসা। মাত্র ৭০ টাকা পুঁজি করে কীভাবে ব্যবসা করতে হয়, সেটা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। দক্ষতা সততা দিয়ে গড়ে তুলেছেন সুবিশাল সাম্রাজ্য।

আমার বাবা আব্দুল মোনেম বিশ্বাস করতেন, সবচেয়ে ভালো প্রযুক্তি ব্যবহার করে সব কাজে এক নম্বর হওয়া সম্ভব। অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ঠিকাদার হিসেবে কাজ শুরু করলেও পরে ১৯৫৬ সালে মাত্র ২০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেড (এএমএল) গড়ে তোলেন। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে নেতৃত্ব দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৫৭ সালে এএমএল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাত্রা করে। আর অবকাঠামো বিনির্মাণ দিয়ে মূল ব্যবসা শুরু করে আব্দুল মোনেম গ্রুপ। পরবর্তী সময়ে এএমএল বহুমাত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।

বাবা ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ। মহান আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা এবং সততাকে সবসময় গুরুত্ব দিয়েছেন। কাজের বিষয়ে তিনি খুবই দক্ষ দূরদর্শী ছিলেন। শুধু ফিল্ড সার্ভে করলেই তিনি বুঝতে পারতেন প্রকল্পে কী কী প্রয়োজন হবে এবং কীভাবে প্রকল্পটি সুন্দরভাবে শেষ করা যাবে। এটি তার অন্যতম ব্যতিক্রমী গুণ ছিল।

ব্যবসা পরিবার একসঙ্গে সফলভাবেই সামলেছেন বাবা। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই ছেলে তিন মেয়ের জনক। সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, এটা আমার বাবার কৃতিত্ব। তিনি আমাকে বলেছেনতুমি হার্ভার্ডে ট্রাই করো। আমি বলেছি, এমআইটিতে পড়াই তো যথেষ্ট। কিন্তু তিনি বলেছেন, যা- করবে নাম্বার ওয়ান হতে হবে।

আমার বাবার টাকা ছিল না। এক বেলা খাবারের টাকা জোগাড় করাই ছিল খুব কষ্ট। অথচ সেই ব্যক্তি স্বপ্ন দেখছেন, তার ছেলে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। সেজন্য আমি একজন আব্দুল মোনেমকে শুধু পিতা হিসেবেই নয়, বরং তাকে আমার জীবনের একজন গাইড, একজন মেন্টর, একজন আর্কিটেক্ট মনে করি। তিনি আমার কাজের অনুপ্রেরণা ছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার প্রতিটি পদক্ষেপ আর অক্লান্ত শ্রম নিবেদিত ছিল নিজ হাতে গড়া শিল্প গ্রুপ আব্দুল মোনেম লিমিটেডের জন্য। নির্মাণ আর অবকাঠামো দিয়ে ব্যবসা শুরু করে ডালপালা ছড়ান বহুমাত্রিক প্রতিষ্ঠানে। কাজের সুযোগ করে দেন অসংখ্য মানুষের। দীর্ঘ ৬৪ বছরের কর্মজীবন তাকেও দিয়েছে দুহাত ভরে। রাষ্ট্রপতির শিল্প উন্নয়ন পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা এসেছে বাবা আব্দুল মোনেমের হাতে।

ব্যবসায়ের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে বিপদগ্রস্ত অসহায় মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে বাবা গড়ে তোলেন আব্দুল মোনেম ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আব্দুল মোনেমের নিজ গ্রাম বিজেশ্বরে প্রায় ৫২ একর জমি দান করেছে। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ বেশ কয়েকটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এছাড়া একটি এতিমখানা পরিচালনাসহ সব খরচ বহন করছে ফাউন্ডেশনটি। এখানে প্রায় তিন হাজার এতিম পড়াশোনা করে। দেশে বন্যা বা অন্য কোনো ধরনের বিপর্যয়ের সময়ও ফাউন্ডেশন ত্রাণ বিতরণ অন্যান্য সহযোগিতা করে থাকে।

খেলাধুলায়ও দারুণ আগ্রহী ছিলেন আব্দুল মোনেম। বাংলাদেশে ফুটবলের সুবর্ণ সময়ে ঢাকার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৪-৯৫ মৌসুম পর্যন্ত ঢাকার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। তার সময়ে ফুটবল লিগে ১৯৮৬, ১৯৮৭ ১৯৮৮ সালে হ্যাটট্রিক শিরোপা জেতে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি।

এএসএম মঈনুদ্দিন মোনেম: আব্দুল মোনেমের জ্যেষ্ঠ পুত্র  এএমএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন