নৈঃশব্দ্যে বেজে ওঠে জীবনের সুর

জাভেদ জলিল

পেইন্টিং নীরব সংগীতের মতো, যেখান থেকে গতি উৎসারিত হয়। অব্যক্ত শব্দ আর অনুভূতিগুলো কোনো শিল্পীর মাধ্যমে ঐকতানে পৌঁছয়। পেইন্টিং নিয়ে এমনটাই ধারণা পোষণ করতেন মোহাম্মদ কিবরিয়া। শিল্পীর তুলির প্রতিটা আঁচড় বহন করে তার চলার পথের আবেগ অনুভূতি। এভাবে শেষমেশ যে ছবি অঙ্কিত হয় তা মূলত পরিণত হয় শিল্পীর স্থান অভিজ্ঞতার প্রতিবিম্বে।

তিনি প্রশান্ত গভীর কণ্ঠে বলতেন, সব শিল্পই আদতে বিমূর্ত। তবে সত্যের কেন্দ্রবিন্দুকে ঘিরে কাজ করে পেইন্টিং। বিদ্রূপ আর বৈপরীত্য সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে নির্মাণ করেছে তার পেইন্টিংয়ের গতিপ্রকৃতি। তার পেইন্টিং থেকে ঝরে পড়ে নৈঃশব্দ্য, অথচ কী বিস্ময়করভাবে বিম্বিত করে তোলে জীবনকে! সতর্ক চোখে তাকালে টের পাওয়া যায় প্রশান্ত বর্ণনার প্রাবল্য। ফাঁকা রাস্তায় নৃত্যরত বৃষ্টিফোঁটার দাগ, হাইওয়ের পাশে নির্জন ফুটপাত স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে ফাঙ্গাসের আঁকাবাঁকা দাগ। তার কাছে পেইন্টিং সবসময় সচেতন সফর নয়। উপরন্তু এটা এমন এক প্রক্রিয়ার নাম, গড়পড়তা জীবনের সবচেয়ে ছোট ঘটনা থেকেও যার অনুপ্রেরণা আসা সম্ভব। কিবরিয়ার কাছে অবসাদ ধরা দেয় প্রাকৃতিকভাবেই। স্বভাবের দিক থেকে তিনি যেন এক আবেগপ্রবণ নিঃসঙ্গ সন্ন্যাসী, যে প্রশান্তি খুঁজে পায় রেখা আর রঙের নীরব আঁকিবুকিতে। কিবরিয়া এমনভাবে আঁকেন, যেন কাজেরও জীবন রয়েছে। পেইন্টিংয়ের ক্ষেত্রে সাবজেক্টিভ প্রবণতা সবসময় তার মুখ্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে হাজির থেকেছে। কম্পোজিশন টোনালিটি নিয়ে কিবরিয়ার মুনশিয়ানা অন্য মাত্রার। তিনি বলতেন, পেইন্টিং প্রকৃতির মতো। সবসময় বিবর্তিত হচ্ছে। নতুন ছবির জন্ম দেয়ার জন্য তিনি প্রকৃতির মাঝে বুঁদ হন। নির্মাণের উপরিতলে প্রস্ফুটিত করে তোলেন নিজের চিন্তাকে। তার পেইন্টিংগুলোর সূক্ষ্মতাই অদ্ভুতভাবে তৈরি করেছে কিবরিয়ার নীরব গভীরতাকে। কোনো চিত্রকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তোলার যাত্রায় কিবরিয়া প্রথমে পৃষ্ঠতলের শূন্যতা নিয়ে কাজ করেন। তারপর ধীরে ধীরে বিনির্মাণ করতে থাকেন চিন্তাকে। বিভিন্ন চিন্তার প্রকাশক হিসেবে রঙের ভিন্ন ভিন্ন স্তর ব্যবহার করেন তিনি। রঙগুলো একত্র হয়ে নির্মাণ করে বিচিত্র সব টোনালিটি। আর সেই টোনালিটির ওপর টোনালিটি ধারণ করে আবেগকে।

রঙ আর কাঠামোর প্রয়োগ দেখে লিথোগ্রাফির প্রতি কিবরিয়ার ভালোবাসা সহজেই অনুমান করা যায়। হূদয় আত্মাকে উদ্দীপিত করতে তার কাজ যেন সেই সব উপাদানের সঙ্গে অনুরণিত হয়। প্রিন্টমেকিং শিল্পের জন্য সৃজনশীলতা স্বতঃলব্ধ জ্ঞান থাকা জরুরি। প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতাকে কিবরিয়া রূপান্তর করেছেন নিখাদ অভিব্যক্তিতে। সূক্ষ্মতা কোমলতার প্রতি আগ্রহের কারণে প্রিন্টমেকিং মিডিয়ায় নিজস্ব একটা ভাষা তৈরি করেছেন তিনি। প্রিন্টমেকিংয়ের ক্ষেত্রে গ্রহণ করেছিলেন মিনিমাইজেশন নীতি। তবে প্রিন্টমেকিংয়ে কিবরিয়ার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তুশের ব্যবহার। তুশ হলো লিথোগ্রাফিতে ব্যবহূত বিশেষ ধরনের কালি। তিনি দস্তার তলের ওপর তুশ খোদাই করা রেখার মিশেলে তৈরি করতেন স্পষ্টতা। লিথো উপাদানকে ব্যবহার করার অনন্য পদ্ধতি তার সৃষ্টিকর্মে খুব সহজেই চোখে পড়ে। উপাদানের প্রতি তার সহজাত প্রতিক্রিয়া স্বতঃলব্ধ জ্ঞান মনের গহিন আবেগকে হাজির করে নির্দিষ্ট ছকে। বুদ্বুদের উল্লম্ব রেখাগুলো তৈরি হয়েছে অ্যাকুয়াটিন্ট প্যালেট গ্রিজের মিশ্রণে। আনডিলুটেড অয়েল পানি এক ধরনের ইল্যুশন তৈরি করে। একটি পরিকল্পনার সারবস্তুকে অন্য পরিকল্পনায় হাজির করার পদ্ধতি কিবরিয়ার অভিব্যক্তি প্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে থেকেছে।

শিল্পীর কাছে শিল্প হলো আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার প্রক্রিয়া। পিকাসো বলেছিলেন, আত্মা থেকে প্রতিদিনকার ধুলাবালি ধুয়ে দেয় শিল্প কিবরিয়া মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন কথাটা। কোলাজ তাকে আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন চিন্তার প্রক্রিয়াকে সুসংগঠিত করতে সাহায্য করে। তার পেইন্টিং অন্যান্য নির্মাণের পেছনে পাটাতন হিসেবে কাজ করেছে কোলাজ। বস্তুত কিবরিয়ার জন্য কোলাজ ছিল আধ্যাত্মিক আরোগ্যের মতো। যথাযথ উপাদানের সমন্বয়ে কনসেপ্টে রূপান্তরের মাধ্যমে চিন্তাপ্রক্রিয়াকে সুসংহত করার একটা উপায় কোলাজ। ইন্দ্রিয়জ বিশৃঙ্খলা কমিয়ে আনার উপায় তাকে উদ্বেগ থেকে মুক্তি দেয়। ভেতরের জগেক দেয় স্বাধীনতা। যখন তিনি শারীরিক দুর্বলতার জন্য কাজ করতে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন, কোলাজ রূপান্তর করত চিন্তাকে। এটা একটা মানসিক অবস্থা তৈরি করে, সেখানে স্পিরিট জীবনের ভাষায় বিন্যস্ত হতে পারে। উপাদানের একীভূতকরণ থেকে কিবরিয়ার জন্য অনুপ্রেরণা আসে। উপাদানগুলোর রঙ তাদের স্বাভাবিক ক্ষয় প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করে তিনি ছবিতে মেলে ধরেন সিদ্ধতা আর স্বতঃস্ফূর্ততা।

কাগজের ওপর দাগগুলোকে স্বাভাবিকভাবে চিহ্ন হিসেবেই দেখা হয়। কিন্তু চিহ্নকে কিবরিয়া ব্যবহার করেছেন আদিম চিদাত্মা চিন্তা হিসেবে। তা যেন তলের ওপর তারের মতো কাজ করে। উপাদান, মাধ্যম রূপের মধ্যকার ভারসাম্যকে প্রতিবিম্বিত করেছে তার অনুসন্ধানী মন। আবেগ আর আত্মবাদী জগতের অনন্ত রহস্যকে ধারণ করে রাখে তার সরলরৈখিক অভিব্যক্তিগুলো। কিবরিয়া যেন নাটক কিংবা দৃশ্যমান সংগীত নির্মাণ করেছেন। সরলরেখার মধ্য দিয়ে কোনো অবয়ব তৈরি করা মূলত গতির নির্দেশ করে। জটিল চিন্তাকে প্রকাশ করার জন্য কিবরিয়া পাটাতনের অগ্রগতি সাধন করেন। ভিন্ন টোনালিটির আবহ দিয়ে কাগজকে তৈরি করাটা আসলে চিত্রের নিগূঢ়তাকে আরো উচ্চে নিয়ে যায়। রৈখিক অবয়বকে খুব সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিবরিয়া অঙ্কনের তলকে উজ্জ্বল করতেন রূপ বিভিন্ন উপাদানের মধ্যকার সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। এটা তৈরির প্রক্রিয়াও ছিল অনন্য। বিভিন্ন ধরনের জলীয় মিশ্রণ, রঙের আভা, কালি কাগজ ব্যবহার করে ফুটিয়ে তুলতেন বিভিন্ন চরিত্র। বিভিন্ন দৈর্ঘ্য দিকের রেখাগুলো কিবরিয়ার চিন্তার সঙ্গে মিলিত হয়ে তৈরি করে অন্তহীন দৃশ্যাবলি।

তার কাজের সাবজেক্টিভ অনুভূতিগুলো ধারণ করে আছে আবেগ আর রহস্য। কিবরিয়ার জন্য নির্মাণ কেবল দর্শনসংক্রান্ত ভারসাম্যের জন্য নয়, এটা একটা অগ্রগতি। কীভাবে আমাদের অভ্যন্তরীণ চরিত্রগুলো ঐক্যবদ্ধ হয় ছোট্ট একটা চিত্রের মধ্যে। কিবরিয়া কাগজের ওপর পেনসিল ব্যবহার করতেন সেভাবেই, যেভাবে পাথরের গায়ে লিথো ক্রেয়নের মাধ্যমে দাগ টানা হয়। কিবরিয়া সাবলীল গ্রাফিক্যাল চিহ্ন ব্যবহার করেছেন এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃশ্যের অবতারণা করতে সেই চিহ্নগুলোকে অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মিশিয়েছেন। তার সহজাত স্বভাব একধরনের নিষ্কলুষতা পবিত্রতা নিয়ে এসেছে।

কিবরিয়া মিশ্র মাধ্যম ব্যবহার করতেন ভারসাম্য আনার জন্য। বিভিন্ন উপাদানের মিশ্রণ চিন্তার বহুত্বকে ধারণ করে। তিনি প্রকৃতির মৌলিক বৈশিষ্ট্যকে চিন্তায় রূপান্তর করেন চিত্রনির্মাণে প্রয়োগ করেন। মিশ্র উপাদানের মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ছবি তৈরির জন্য তিনি বিভিন্ন উপাদানকে তাদের স্বতন্ত্র মাত্রাতেই ব্যবহার করতেন। বিভিন্ন মাধ্যমে কিবরিয়ার অভিব্যক্তি উপাদানের আন্তঃসম্পর্কের মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হতো। বহুমাত্রিক ছবি নির্মাণের জন্য মাধ্যমগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক ঐক্যবদ্ধ করত শিল্পীর চিন্তাকে। মাধ্যমের মিশেল শিল্প সম্পর্কে পাণ্ডিত্য, গতিশীলতা সম্প্রসারণের ইঙ্গিত দেয়।

কিবরিয়ার কাজ এক অধরা দুনিয়ার কথা বলে, যেখানে আনুভূমিক উল্লম্ব তল বিভাজিত হয়েছে বিচিত্র সব আবেগ, গভীরতা বোঝাপড়ার মাধ্যমে।

 

ইংরেজি থেকে ভাষান্তর: আহমেদ দীন রুমি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন