অতলদর্শী শিল্পী

মইনুদ্দীন খালেদ

কিবরিয়া শুধু বাংলাদেশেরই নয়, পৃথিবীরই এক বিরল প্রতিভাধর বিমূর্ত ধারার শিল্পী পুরুষ। রঙ-রেখার পরিচর্যার তিনি এক নিজস্ব শিল্পময় ভুবন তৈরি করতে পেরেছেন। কেন বস্তুনিরপেক্ষ বর্ণভুবনের যাত্রিক হলেন তিনি? দৃশ্যময় পরিচিত পৃথিবী ছেড়ে নিরঙ্কুশ প্রস্ত লালে, নীলে বা হলুদকে নির্ভর করে কেন অস্তিত্বকে জানান দিলেন? প্রধানত নিমগ্ন রইলেন ধূসর-কালোয়? অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কেন্দ্রস্থিত হওয়ার পথ কেন তিনি খুঁজে নেন? রোমান্টিক পরিব্রাজনই হোক আর শোকের অকূল সাগরই হোক, শেষাবধি তিনি একটা ভরকেন্দ্রে থিতু হন। মানুষী অস্তিত্বের এসব বিচিত্র অনুভবের জটিল মানচিত্র পাঠ করতে হলে জানা প্রয়োজন শিল্পীর যাপিত জীবন।

কিবরিয়ার আঁতুড় নিবাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায়। এখানকার আদিম জঙ্গম প্রকৃতি বিশেষ করে লালচে মাটির রূপ শৈশবে তার মনে বিশেষ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। মাটিতে ফসল ফলে কম, তবুও মাটিই সহিষ্ণুতার সংকেত দেয়, বেঁচে থাকার মর্মার্থ পাঠ করায়। আত্মীয়-পরিজন পরিবৃত হলেও জীবন তার কোনো সহজাত প্রবৃত্তির কারণে কেবলই নৈঃসঙ্গ্যের বলয়ে প্রবিষ্ট হয়েছে। বিজনতাপ্রিয় মানুষটির মনে সংগুপ্ত ছিল চিত্রশিল্পী হওয়ার বাসনা। স্কুলশিক্ষকের প্রেরণা তাকে প্রেরণ করে কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে। এখানে গুরুদের কাছে দীক্ষিত শিক্ষিত হয়ে ১৯৫০- স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর তিনি স্বদেশ ত্যাগ করেন। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ঢাকায় এসে যোগ দেন একটি স্কুলের ড্রইং শিক্ষক হিসেবে। স্বদেশেই সঙ্গী ছিল বিজনতা।

পঞ্চাশের দশকে তিনি জাপানে গিয়ে পেইন্টিং ছাপচিত্রে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। ষাটের দশকের শুরুতে দেশে ফিরে আবারো যোগ দিয়েছেন চারুকলা অনুষদে। বাংলাদেশ জাপানে তিনি সর্বাগ্রগণ্য শিল্পীর মর্যাদা পেয়েছেন। পদক সম্মান, সম্মাননা, উচ্চমূল্যে ছবি বিক্রি, সব অর্জিত হয়েছিল; তবু তিনি নির্মোহ, বাকসংযত।

স্বখাত সলিলে প্রবহমান কিবরিয়া ১৯৫১-এর শুরুতে ঢাকায় চলে আসেন। তখন তিনি তরুণ যুবা: বয়স তার ২২। তখন ঢাকার শিল্পচর্চার প্রধান একমাত্র প্রতিষ্ঠান আর্ট ইনস্টিটিউটের বয়স মাত্র তিন। আরো দুবছর পর অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে। তাই কলকাতার বিদ্যালয়ের মতো কোনো ঐতিহ্য ছিল না নতুন শিল্পবিদ্যায়তনের। অপর দিকে আরো একটি লক্ষণীয় দিক এই যে দেশে বৌদ্ধ-হিন্দু মুসলিম যুগের শিল্প নিদর্শন থাকা সত্ত্বেও ধর্ম বা পুরাণ এখানকার শিল্পীদের গভীরতর চর্চার বিষয় হয়নি। বরং অসুষ্ঠু রাষ্ট্র পাকিস্তানের আধিপত্য বঞ্চনার শিকার হয়ে এখানে একটি প্রতিবাদী মনোভঙ্গির শিল্প প্রয়াস ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকে। সময় বাস্তববাদী শৈলীতে ঘটমান বর্তমান বাঙালির লোকজীবন চিত্রায়ণে শিল্পীদের মধ্যে মনোনিবেশ লক্ষ করা যায়।

রেনেসাঁ থেকে জন্ম নেয়া ন্যাচারালিজম এবং আরো পরিণত কালের রিয়ালিজম: এর কোনোটাতেই তুষ্ট থাকেনি নবীন রাষ্ট্রের নবীন শিল্পবিদ্যালয়ের নবীন শিল্পীদল। তারা বুঝেছিলেন যে শিল্প সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়। বিবর্তনের বীজ উন্মীলিত হয় শিল্পীমনেই। তাই রিয়ালিজমের আধিপত্যে আঘাত হানে দেশের প্রাণস্বর লোকশিল্পশৈলী। জয়নুল আবেদিনই এর প্রথম ঋত্বিক। একাডেমিক রিয়ালিজম, লোককলা আর কিউবিজমের সমন্বয়ে ১৯৫১ সালে তিনি নতুন ধারায় ছবি আঁকতে শুরু করেন। তার পথ অনুসরণ করলেন কামরুল হাসান এবং প্রথম প্রজন্মের শিল্পীকুল। আঙ্গিকগত পরিবর্তন বা ভাষার বিবর্তনে প্রাধান্য পায় কিউবিক শিল্পাদর্শ। জয়নুল, কামরুল, সফিউদ্দীন তিন পুরোধা পুরুষের পর কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, রশিদ চৌধুরী প্রমুখ পুরো ১৯৫০-এর দশকজুড়ে বাস্তববাদী শৈলী, লোককলা স্পষ্টভাবে কিউবিজমের সংশ্লেষে এক নতুন ধারার শিল্পচর্চা করে প্রথাগত রেনেসাঁ ব্যাকরণকে বিদায় জানান। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে কিবরিয়া যেভাবে নিখাদ কিউবিজমে আত্মমগ্ন হয়েছেন, অন্য শিল্পীদের কাজে সেই লক্ষণ দেখা যায় না। অন্যরা তুলনায় উল্লিখিত মিশ্র ভাষায় শিল্পের নতুন মাত্রা প্রসারণ করতে চেয়েছেন। কাউকে আপাত কিউবিক বা ছদ্ম কিউবিক হিসেবে শনাক্ত করতে হবে। তারা স্পেসকে জ্যামিতিতে কেটে ছবির নানা তলের মেলবন্ধনের বিশেষ সূত্র অন্বেষণ করেছেন।

জাপানি শিক্ষাটা সুমার্জিত কৌশলে কাজে লাগিয়েছেন কিবরিয়া। তার গুরুরা তাকে শিল্পের রহস্যময় দেশ পরিব্রাজনে দিশা দিয়েছেন। বিশেষ করে তার দুই গুরু তাকেসি হায়াসি (১৮৯৬-১৯৭৫), যিনি তাকে প্রিন্টিংয়ে দীক্ষা শিক্ষণ দিয়েছেন আর হিদিও হাগিওরা (১৯১৩-২০০৭) যিনি তার প্রিন্টমেকিং শিক্ষক ছিলেন। প্রথম গুরু ফবিজম-উত্তর বর্ণের  ক্ষমতা পরখ করার বিষয়টা কিবরিয়াকে অবহিত প্রদর্শন করেছেন এবং দ্বিতীয় নিরবয়ব বর্ণময় উদ্ভাসন অথবা নিরপেক্ষ জ্যামিতি কিংবা কাঠ ধাতব পাতের অন্তর্গত বিন্যাস উদ্ধার করে টেক্সচারের ক্ষমতা ব্যাখ্যা করেছেন। ক্ষমতা কিবরিয়া পরবর্তী সময়ে মুদ্রিত করেছেন তার পেইন্টিংয়েও। বস্তুত ব্যাখ্যাতীত বিরামহীন বুদ্বুদের মতো অস্তিত্বের অস্থিরতা অনুবাদ করার ক্ষেত্রে টেক্সচার অর্থাৎ বিন্দুর বুনট বা রেখার জাল-জালিকার অনুষঙ্গ বিশেষ ভূমিকা রাখে; পরিচর্যায় কিবরিয়া এতটাই পারমিতা দেখিয়েছেন যে কিবরিয়া শিল্পভাষার প্রধান মুদ্রাই শিল্পীর স্বকীয় টেক্সচার অর্থাৎ তার মনোলোক /সৃজনলোকের দর্শন।

কিবরিয়ার শিল্পকর্ম প্রমাণ দেয় যে তিনি অস্তিত্ববাদী। বস্তুত বিমূর্ত ধারার শিল্পীদের মধ্যে যারা নিরালম্ব হওয়ার বেদনা অনুভব করেছেন এবং বর্ণের সখ্যে অস্তিত্বের নিশানা খুঁজে পেয়েছেন তাদের সংঘেরই সদস্য কিবরিয়া। তবে জাপানি শিক্ষা আর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বাংলার নাগরিক বলে কিবরিয়া মার্ক রথকো, আরসাইল গোর্কি, জ্যাকসন পোলক প্রমুখ বিমূর্ত প্রকাশবাদীদের থেকে আলাদা চরিত্রের মজবুত অর্থনীতি নেই বলে, রাষ্ট্রের আচরণও সুষ্ঠু নয় বলে আর সর্বোপরি বাংলাদেশের মতো দেশের আন্তর্জাতিক শিল্পাঙ্গনে আধিপত্য কায়েম হয়নি বলে কিবরিয়ার মতো অতলদর্শী শিল্পী ঢাকা নামক গ্রামে সীমায়িত হয়েছেন। গরিব দেশের শিল্প আর ধনিক দেশের আধিপত্য, বিষয়ের বিতর্কে সরব হওয়ার আশু প্রয়োজন আছে।

 

মইনুদ্দীন খালেদশিল্প সমালোচক

লেখাটি কিবরিয়া আন্তর্জাতিক ছাপচিত্র মেলা ২০১৭-তে প্রকাশিত ক্যাটালগ থেকে নেয়া (সংক্ষেপিত)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন