জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ২২ ডিসেম্বর ‘মজুরি চুরি বিষয়ে অভিবাসী শ্রমিকদের গণসাক্ষ্য’ গ্রহণ ও প্যানেল আলোচনার আয়োজন করে রেফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) ও মাইগ্র্যান্ট ফোরাম ইন এশিয়া (এমএফএ)। সেখানে ধারণাপত্র পাঠ করেন রামরুর নির্বাহী পরিচালক ড. সি আর আবরার। এ আয়োজনে সহযোগী হিসেবে ছিল বণিক বার্তা
অভিবাসী শ্রমিকদের সাক্ষ্য
মো. আবু
বকর ছিদ্দিক, টাঙ্গাইল
২০২০ সালের মার্চে একটি কোম্পানির মাধ্যমে সৌদি আরবে যাই। ৫ লাখ টাকা করে নিয়েছিল। পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ দেয়ার কথা বলে আমাদের তিন মাস আটকে রাখে। কোনো বেতন দেয়নি। পরে আমরা কনস্ট্রাকশনের কাজ করেছি। তাতেও নিয়মিত টাকা না পেয়ে বাধ্য হয়ে বাইরে কাজ করেছি। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী যেসব সুবিধা দেয়ার কথা তার কিছুই দেয়নি। বাইরে কাজ করার কারণে আমাকে গ্রেফতার করা হয়। দুই মাস জেলে রেখে পরে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। যে কোম্পানি নিয়ে গিয়েছিল তারাও কোনো খোঁজ নেয়নি।
মো. নাজির
হোসেন, টাঙ্গাইল
আমি গত মে মাসে একটি এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরবে গিয়েছিলাম। অফিস ক্লিনারের কাজ করার কথা থাকলেও আমাকে একটি হোটেলে কাজ দেয়া হয়। সেখানে আমার তিন মাসের বেতন পাওনা রয়েছে। ওভারটাইমের টাকাও চেয়ে পাইনি। আমার পাসপোর্ট তারা আটকে রেখেছিল। পরে আমি সেখান থেকে পালিয়ে বাড়ি থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা নিয়ে এজেন্সির মাধ্যমে দেশে চলে আসি।
রানু
বেগম, ঢাকা
সৌদি আরবে চার বছর ছিলাম। তার মধ্যে ১৫ মাসের বেতন দেয়নি। খাওয়া, ঘুম ও কাজের কষ্ট বলে বোঝানোর মতো না। সরকারি অফিসে যোগাযোগ করে অভিযোগ দিয়েছিলাম। ৬০০ রিয়াল বেতন থেকে নানা টাকা কেটে রাখত। পরিবারের সঙ্গে ছয় মাসে একবার কথা বলতে দিত। ছুটি নিয়ে দেশে চলে আসি। আসার সময় ১ টাকাও দেয়নি। ওদের আচরণ খুবই খারাপ, মারধর করে। সেখানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাসপোর্ট নিয়ে যায়। কেউ সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসে না।
আল আমিন,
টাঙ্গাইল
আমি দুবাই ছিলাম সাত মাস। চার মাস কাজ করেছি, বেতন পাইনি। বহুদিন এক বেলা না খেয়ে থেকেছি। যেতে সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছিল, কিন্তু কোনো টাকা আমি আয় করতে পারিনি। অবস্থা খারাপ দেখে বাড়িতে যোগাযোগ করি। মায়ের গয়না বিক্রি করে টাকা পাঠালে আমি দেশে ফিরে আসি।
হযরত
আলী, কুমিল্লা
২০০৯ সালে আমি লেবানন যাই। সেখানে একটি কোম্পানিতে ১১ বছর ধরে কাজ করেছিলাম। আকামা, ইন্স্যুরেন্স থেকে শুরু করে সবকিছুই আমাদের বেতন থেকে কেটেছিল। যদিও কোম্পানি থেকে এগুলো দেয়ার কথা ছিল। করোনার কারণে আপডাউন টিকিটে দেশে আসি। পরে আর যেতে পারিনি। টিকিটের টাকাও ফেরত পাইনি।
মো.
সজীব, ঢাকা
২০১৭ সালে লেবানন গিয়েছিলাম সাড়ে ৪ লাখ টাকা খরচ করে। সেখানে চার বছর থেকেছি। শুরুতে নয় মাস ক্লিনারের কাজ করেছি। সেখানে আমাকে প্রাপ্য বেতনের অর্ধেক দেয়া হতো। প্রাপ্য বেতন পাচ্ছিলাম না বলে সেখান থেকে চলে যাই। পরে কোম্পানি আমার নামে মামলা করে। লেবাননে বিস্ফোরণের পর আমাদের কোনো কাজকর্ম ছিল না। টোকাইয়ের কাজ করেছি। পরে বাংলাদেশ এম্বাসির মাধ্যমে যোগাযোগ করে দেশ থেকে টাকা নিয়ে ফেরত আসি।
মিজান, কুমিল্লা
দুবাইয়ে ১১ বছর ছিলাম। করোনার আগে আপডাউন টিকিট নিয়ে এসেছিলাম। করোনার কারণে যেতে পারিনি। পরে যোগাযোগ করে দেখি ভিসা ক্যানসেল। ভিসা ক্যানসেল হওয়ায় চাকরির শর্ত অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। কী কারণে ভিসা ক্যানসেল হয়েছে তা জানতে পারিনি।
শাহিনা, ঢাকা
হাসপাতালে কাজের কথা বলে একটি কোম্পানি আমাকে গৃহকর্মীর কাজ দিয়েছিল। তারা সারা দিন কাজের ওপর রাখত। বেতন ও ওভারটাইমের টাকা দিত না। পরে আমি দেশে চলে আসতে চাইলে পাঠিয়ে দেয়। আমি বিএমইটিতে অভিযোগ করলে নিয়োগকারী এজেন্সির মালিককে ডাকা হয়। আমার দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। কোম্পানি থেকে ৩০ হাজার টাকা দেয়। এরপর তাদের লাইসেন্স বাতিল করে দিলে কোম্পানির মালিক আমাকে ধীরে ধীরে টাকা পরিশোধ করবে জানিয়ে অনুরোধ করে যেন আমি অভিযোগ তুলে নিই। সহানুভূতির খাতিরে সাইন দেই। কিন্তু লাইসেন্স চালু হলে বাকি টাকা আর দেয়নি তারা।
ইকবাল
হোসেন, টাঙ্গাইল
আমি সৌদি আরব ছিলাম। ক্লিনারের কাজ দেয়ার কথা ছিল সেখানে। আট ঘন্টা কাজ করার কথা থাকলেও তারা ১৪ ঘণ্টা কাজ করাত। চার মাস কাজ করে ১ টাকাও বেতন পাইনি। নিরুপায় হয়ে পালিয়ে যাই। পরে বাইরে কাজ করায় পুলিশ আমাকে ধরে ১৫ দিন জেলে রাখে। এরপর তারা আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়।
খুকি আক্তার, কুমিল্লা
আমি একটি এজেন্সির মাধ্যমে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে জর্ডান গিয়েছিলাম। সেখানে যাওয়ার পর দালাল আমাকে এক মালিকের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে এক মাস আমাকে কাজ করিয়ে টাকা দেয়নি।
দুই মাস বসিয়ে রেখেছে। বেতন বা ক্ষতিপূরণ দেয়নি। পরে আবার অফিসে ফেরত দিয়ে যায়। অফিসে আমাকে খাবার-দাবার দিত না। দেশে ফেরত আসতে চাইলে তারা জানায় ৩ লাখ টাকা দিয়ে দেশে আসতে হবে। তারা টাকার জন্য অনেক হুমকি-ধামকি দিত। পরে ধার করে আমার ছেলে টাকা পাঠালে আমি ফেরত আসি।
মো.
ওমর, ঢাকা
আমি লেবাননে ছিলাম। চুক্তি অনুযায়ী ৪৫ হাজার টাকা বেতন দেয়ার কথা থাকলেও ২৭ হাজার টাকা করে দিয়েছে। তাদের কাছে আমার এখনো অনেক টাকা পাওনা রয়েছে। মেশিনের কাজ করায় হাত-পা কেটে যেত। এর চিকিৎসা খরচও তারা বহন করত না। খাবারের টাকাও ঠিকমতো দিত না। পরে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে যোগাযোগ করে দেশে চলে এসেছি।
রেখা আক্তার (ভুক্তভোগী অভিবাসীর স্ত্রী), কুমিল্লা
২০২১ সালের ৩০ জুলাই আমার স্বামী কুদ্দুস মিয়া সৌদি আরব গেছেন। তাকে কফি হাউজে কাজ দেয়ার কথা ছিল, দেয়নি। তিন মাস ঘুরিয়েছে। বেতন ধরা হয়েছিল ১৪০০ রিয়াল। পরে কাজ দিলেও ওভারটাইম করাত। কিন্তু বেতন ও ওভারটাইমের টাকা দিত না। পরে বাধ্য হয়ে তাকে তার ভাইয়ের আশ্রয়ে গিয়ে অন্য কাজ খুঁজে নিতে
হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ মত
ড. সি আর আবরার
নির্বাহী পরিচালক রেফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)
অনেক অভিবাসী শ্রমিক বছরের পর বছর কাজ করা সত্ত্বেও চাকরির মেয়াদ শেষে সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। কভিডকালে এমন বঞ্চনা অনেক ঘটেছে। ওভারটাইম করানো হচ্ছে, কিন্তু এজন্য কোনো টাকা দেয়া হচ্ছে না। বেশি সময় কাজ করানোর ক্ষেত্রে শ্রমিকের ইচ্ছার কোনো মূল্য নেই। তাকে বাধ্যতামূলক ওভারটাইম করানো হচ্ছে। এ ধরনের ওভারটাইমসহ নারী গৃহকর্মীকে একাধিক গৃহে কাজ করানো হচ্ছে। চাকরির শর্ত অনুযায়ী বছরে যে ছুটি পাওয়ার কথা, তা দেয়া হচ্ছে না। যেসব ক্ষেত্রে বিমান ভাড়া দেয়ার কথা, সেটাও দেয়া হচ্ছে না। আলোচনা ছাড়াই বেতন কমানো এবং চুক্তি সমাপ্তির পর বকেয়া না দেয়া বা আটকে রাখাও মজুরি চুরির অন্তর্ভুক্ত। মোট কথা, তাদের চাকরির যেসব শর্ত রয়েছে, তার বেশির ভাগই মানা হচ্ছে না। এটা দুয়েকজন শ্রমিকের ক্ষেত্রে ঘটছে এমন নয়। এ ধরনের অন্যায্য আচরণ উপসাগরীয় ও অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের শ্রমিক নিয়োগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যেহেতু ওই শ্রমিকরা অসংগঠিত দুর্বল, তাই শ্রমিক প্রেরণকারী উৎস দেশগুলোও তাদের এসব সমস্যা সমাধানে তেমন দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয় না। তাদের আবার বাজার হারানোর ভয়ও রয়েছে। এসব কারণে অভিবাসী শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে কোনো সুরাহা হচ্ছে না।
একটা সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আমাদের শ্রমিকদের বিমান ভাড়াসহ এজেন্টদের বাড়তি একটা ফি দিত, নানা সুযোগ-সুবিধা দিত। সেই বাজার আস্তে আস্তে পুরোটা বদলে যায়। এখন অনেক ক্ষেত্রে সেই দেশগুলোতে ভিসা বিক্রিও একটা নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উৎস রাষ্ট্রগুলোর মূল বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তারা বেশি শ্রমিক পাঠাতে পারছে কিনা এবং দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে কিনা। কভিড-পরবর্তী সময়ে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে এটাকে সামনে আনা হয়। এশিয়াব্যাপী কাজ করা মাইগ্র্যান্ট ফোরাম ইন এশিয়া (এমএফএ) এক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে ২০টি সংগঠনের জোট বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি মাইগ্র্যান্টস ও রামরু অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসে। ২০২১ ও ২০২২ সালে ভারত, ফিলিপাইন, নেপাল, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশে এ বিষয়ে কয়েকটি গবেষণা হয়। এসব গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমরা বলছি, এটা একটা কাঠামোগত মজুরি চুুরি। ২০২১ সালে গ্লোবাল কমপ্যাক্ট অন মাইগ্রেশন স্বাক্ষরিত হয়, যা এখন পর্যন্ত অভিবাসনের সবচেয়ে বড় চুক্তি। এ চুক্তির একটি মূল্যায়ন হয়েছিল নিউইয়র্কে। সেখানে মূল প্রতিবেদনে দুটি জায়গায় মজুরি চুরির বিষয়টি স্থান পায়। এটা একটা সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
কাঠামোগত মজুরি চুরির মানে হলো শ্রমিকদের যে শর্তে নেয়া হচ্ছে, সেই শর্তগুলোকে মানা হচ্ছে না। মোটামুটিভাবে এটা মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসী শ্রমিকদের বাস্তবতা। কাঠামোগতভাবেই এমনটা হচ্ছে। যেসব দেশে শ্রম আইন আছে; কিন্তু তার সুবিধা অভিবাসী শ্রমিকরা পাচ্ছেন না নানা কারণে। নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পুরো ব্যবস্থায় এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই। যে কারণে এটিকে কাঠামোগত মজুরি চুরি বলছি আমরা।
মজুরি চুরির ঘটনা শুধু কয়েকটি সূচকে সীমাবদ্ধ নয়। বীমা, চিকিৎসা পরীক্ষা, পরিবহন খরচ, দক্ষতা প্রশিক্ষণের অজুহাতে মজুরি থেকে কর্তনও সাধারণ বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে, শ্রমিকদের উচ্চ মজুরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় কিন্তু গ্রহীতা দেশগুলোতে পৌঁছানোর পর চুক্তিপত্র দ্বিতীয় সেটে স্বাক্ষর করতে বলা হয়। বেশির ভাগ শ্রমিকই এসব চুক্তির ভাষা বুঝতে পারেন না। এ নতুন চুক্তি অনুসারে তাদের আগের চুক্তির চেয়ে কম বেতন দেয়াকে বৈধতা দেয়া হয়। শ্রমিকদের জরিমানা আরোপের আড়ালে মজুরি কর্তনও সাধারণ ব্যাপার। অনেক ক্ষেত্রে খাবারের মান এবং বাসস্থানের মান তাদের মজুরি থেকে কাটা পরিমাণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এসবই মজুরি চুরির অংশ।
অভিবাসী শ্রমিকরা মৃত্যুর পরও তাদের মজুরি এবং প্রাপ্য অধিকার কেড়ে নেয়া থেকে রেহাই পান না। স্বাভাবিক মৃত্যুর দাবিগুলো প্রায়ই সত্য থেকে দূরে থাকে। ‘স্বাভাবিক’ শব্দটির ব্যবহার নিয়োগকর্তাদের কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও অন্যান্য দায়িত্বের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান থেকে দায়মুক্তি দেয়। সেই সঙ্গে মৃত অভিবাসীদের পরিবারের দাবি ও অভিযোগ দায়ের করার সুযোগ খুব কম থাকে। এ ধরনের অভিযোগ দায়ের করতে যে বিশাল আইনি খরচ রয়েছে, সেটি তাদের ঢাল হিসেবে কাজ করে। শ্রমিক ও পরিবারের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণের ওপর কর আরোপের বিষয়টিকেও আমরা মজুরি চুরি হিসেবে ধরতে পারি।
নাজমা আক্তার
মাঠ সমন্বয়কারী রামরু
অভিবাসীদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভোগান্তির কাহিনী, কষ্টের কাহিনী। এর পরও বাংলাদেশ থেকে প্রচুর শ্রমিক যাচ্ছেন। করোনাকালে নানা সমস্যার মুখে পড়ে তারা দেশে এসেছেন। প্রত্যেকেই তাদের জমানো টাকা, পেনশনের টাকা, বেতনের টাকা রেখে আসতে বাধ্য হয়েছেন। দেশে আসার পরও পরিবার, সমাজ করোনার অজুহাতে তাদের নানা বঞ্চনার মুখে ফেলেছে।
অনেক শ্রমিক এখনো বৈধ চুক্তির মাধ্যমে বিদেশে যাচ্ছেন। যাওয়ার পর তারা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন বা পাচার হচ্ছেন। নিরুপায় হয়ে কেউ কেউ দেশ থেকে টাকা নিয়ে বিমান ভাড়া দিয়ে ফিরে আসছেন। বিএমইটিতে অভিযোগ করলে তিন মাসের মধ্যে সমাধান হওয়ার কথা। তখন বিএমইটি থেকে ডাকা হলে শুনানিতে আসার ক্ষেত্রেও অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে বাধা দেয়া হয়। শুনানিতে যাতে পৌঁছতে না পারে সেজন্য নানা তত্পরতার অভিযোগও শোনা যায়। আবার অনেকে বিএমইটি সম্পর্কে জানে না।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া
আইনজীবী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
আমরা একটি নতুন ধারণা মজুরি চুরির বিষয়ে কথা বলছি। বর্তমানে কাঠামোগত মজুরি চুরি হচ্ছে। সাধারণ দৃষ্টিতে শুধু বেতন দিল না, এমন ক্ষেত্রে বিষয়টি আটকে নেই। উপস্থিত শ্রমিকদের বক্তব্য থেকে মজুরির কাঠামোগত চুরির বিষয়টি আরো বেশি প্রতিষ্ঠিত হলো। পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে আরো ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনাও দেখছি। আমরা দেখেছি কী ধরনের নির্যাতন, নিপীড়ন, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে নারীরা দেশে ফিরছেন। কেউ কোনোমতে প্রাণ নিয়ে ফিরছেন, কেউবা লাশ হয়ে। এখন পর্যন্ত আমরা জানি প্রতিদিন ৮-১০টা অভিবাসীর মরদেহ আসছে বাংলাদেশে। গত ১৪ বছরে প্রায় ৪৫ হাজার মরদেহ এসেছে বাংলাদেশে। রামরুর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, গত ১১ বছরে ৩৪ হাজার অভিবাসী শ্রমিকের মরদেহ বাংলাদেশে এসেছে। নির্যাতনের শিকার একজন বলছিলেন, মানুষ না খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকলে সেখানকার স্থানীয়রা ফিরেও তাকায় না।
আগে ফিলিপাইন, নেপালের মতো দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি যেতেন। তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করেছিল। মনে হতে পারে, এতে করে একটা সুযোগ থেকে শ্রমিকরা বঞ্চিত হবেন। অনেকেই ভাবেন বিদেশে গিয়ে বৈধ পথে কিছু উপার্জন করে ভাগ্য ফেরাবেন। কিন্তু আসলে যে তা হয় না, তা অভিবাসী শ্রমিকদের বর্ণনা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। আরো অনেকের কাছ থেকে আমরা জেনেছি মূল প্রতারণাটা কোথায় হয়। সরকার নিয়ম করে দিয়েছে, রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে যেতে গেলে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে নিবন্ধন করে নিতে এবং কোন দেশে কত টাকা খরচ হবে সেটিও বলে দেয়া আছে। কিন্তু তা কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। নিয়োগকারী এজেন্সিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে ২০১৩ সালে একটি আইন হয়েছিল। কিন্তু সেটাও শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। আইনটা যতটা না শ্রমিকদের নিরাপত্তা, মজুরি নিরাপত্তা, চাকরির নিরাপত্তার জন্য সহায়ক, দুঃখজনক হলেও সত্যি, সেগুলো শ্রমিকদের মজুরি না দিয়ে কীভাবে পার পেয়ে যাওয়া যায়, শ্রমিকদের নিরাপত্তা না দিয়ে কীভাবে পার পাওয়া যায় সেটিরই বহিঃপ্রকাশ। যিনি প্রতারণার শিকার হলেন, তার যে ক্ষতি হলো, মানসিক যে হয়রানি হলো, এসব ক্ষতিপূরণ কে দেবে? ২০১৩ সালের আইনে এসব বিষয় অস্পষ্ট।
আইনে ব্যবস্থা নেয়ার কথা যদি বলা থাকে তাহলে আমাদের পরিসংখ্যানটা জানা দরকার কতগুলো রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, কতজন ভুক্তভোগী আইনি পথে সমাধান পেয়েছেন? আমরা উল্টোটা শুনি, তাদের সিন্ডিকেট অনেক বড়, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। নতুনভাবে আইনি ধারণাগুলো পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যাদের আমরা দালাল বলছি বা রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকেও এ আইনি কাঠামোর মধ্যে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। সত্যিকার অর্থেই এ দালাল শ্রেণীকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে কিনা বা শ্রমিকদের এ নিশ্চয়তাগুলো দেয়া সম্ভব হবে কিনা, আমরা এখন পর্যন্ত সন্দিহান।
আইনি বিষয়ে তিনটা জিনিস বলতে চাই। শ্রমিকদের সুবিধা-অসুবিধা বা মজুরির অন্য অধিকারগুলোর বিষয়ে আইনে কীভাবে ও কয়টা স্তরে দেয়া আছে? ২০১৩ সালের আইনে বলা আছে, বাংলাদেশের কোনো শ্রমিক যদি যাওয়ার আগ মুহূর্তে কিংবা সেখানে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন তাহলে দেশীয় আইনি কাঠামোর মধ্যে, দেশীয় আদালতে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। কিন্তু আমরা যে মুহূর্তটায় একটা দেশে গিয়ে পৌঁছাচ্ছি, সেখানে অনেকে ১৫-১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করছেন। সেখানে কোনো বেতন হচ্ছে না, খাবার দিচ্ছে না, থাকার জায়গা অপরিষ্কার। তখন ওয়ার্ক পারমিট বাদ দিয়ে অন্য জায়গায় গিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেন। তখন যতটা না টাকার বিষয় তার চেয়ে বেশি হয়ে দাঁড়ায় বাঁচার আকুতি। তখন দেখা যায় শেষ পর্যন্ত এসব শ্রমিক অনিয়মিত (অবৈধ বলতে চাই না) হয়ে যাচ্ছেন। এ জায়গাটায় অভিবাসী শ্রমিকদের সুবিধা দেয়ার জন্য আইনি কাঠামো বাংলাদেশে নেই। ওইসব দেশে যে দূতাবাসগুলো আছে সেগুলোর ভূমিকা শ্রমিকরা যেটা বলছেন, তারা দেশে ফেরার ব্যবস্থা করেছে। অধিকাংশ ঘটনায় দেশ থেকে শ্রমিকরা টাকা নিয়ে টিকিটের টাকা দিয়েছেন কিংবা দালালকে কোনো টাকা দিতে হলে সেটা দিয়ে দেশে আসতে হয়। এখন শ্রমিকদের এসব সুবিধা-অসুবিধাগুলো দেখার জন্য যদি কোনো ডেস্ক থাকত, যদি সে দেশের মালিকদের সঙ্গে দরকষাকষির একটা সুযোগ থাকত, সেখানে যেই দালাল শ্রেণী রয়েছে, তাদের ওই দেশের আইনের আওতায় নিয়ে আসার যদি ব্যবস্থা করা যেত, তাহলে মজুরি চুরি ঠেকানো বা কমানোর একটা পদক্ষেপ নেয়া যেত।
শ্রমিকরা যখন বিভিন্ন দেশ থেকে খেয়ে না খেয়ে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে, আমরা তাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধা নাম দিচ্ছি। কিন্তু তাদের আমরা আদতে কতটুকু মর্যাদা দিচ্ছি? আমাদের আচরণে, আইনি সুযোগ-সুবিধাগুলো নিশ্চিত করার মাধ্যমেই সেই মর্যাদাটা তাদের দিতে হবে। আমরা এ কথা স্বীকার করে নিতে বাধ্য যে, অভিবাসীদের পাঠানো আয় আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ভূমিকা রাখছে। তাহলে তাদের নিরাপত্তার জন্য, আয়ের পথ সুগম করার জন্য আমরা কী ব্যবস্থা নিচ্ছি? রাষ্ট্র হিসেবে আমরা দেশীয় পর্যায়ে আইনের কথা বলছি, সেটার বাস্তব প্রয়োগ আমরা দেখছি না। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সক্রিয়তার অভাবেও কাঠামোগত মজুরি চুরির ঘটনা ঘটছে।
এই যে ৪০ হাজার-৪৫ হাজার মরদেহ দেশে এসেছে গত ১৪ বছরে। আমাদের ধারণা একটি মরদেহেরও ময়নাতদন্ত হয়নি। আমরা জানি না মানুষগুলোর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ। এ রাষ্ট্রের দায় আছে তার নাগরিক কীভাবে মারা গেল তার প্রকৃত কারণ নির্ণয় করা। অভিবাসীরা নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে গিয়ে যে পরিমাণ প্রতারণা আর হয়রানির শিকার হয়েছেন, সেটি যেন আর কারো হতে না হয়। সে পথ খোঁজার জন্য কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।
মো. নিজামুল হক নাসিম
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল
অভিবাসী শ্রমিকদের কষ্ট আমরা অনেক সময় বুঝি না বা বুঝতেও চাই না। শুধু দেখি তারা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে কিনা। আমরা গর্বের সঙ্গে বলি এদের আয়ই আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় আয়। কিন্তু তারা কীভাবে থাকছে, কীভাবে জীবনযাপন করছে, কীভাবে কাজ করতে হচ্ছে? এ সম্পর্কে আমরা জানলেও মুখ খুলছি না। সবাই মনে করে মুখ খুললে ওই দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে। এ ভয়টা আমাদের কাটিয়ে আসার সময় এসেছে। দেখা দরকার, যে চুক্তিতে দেশ থেকে তারা যাচ্ছেন সেই চুক্তি অনুযায়ী শ্রমিকরা সুবিধাগুলো পাচ্ছেন কিনা। এটা আগের চেয়ে কমেছে, তবে এখনো অনেক আছে। এ বিষয়ে সরকারের আরো বেশি নজর দেয়া দরকার। একই সঙ্গে যাদের শ্রমিক হিসেবে পাঠানো হবে, তাদের সঠিক প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠানো উচিত। শ্রমিকরা যখন বিদেশে যান, তখন আমাদের দূতাবাস ছাড়া তাদের আশ্রয়ের আর কোনো জায়গা নেই। তাই তাদের বিষয়ে আরো অনেক দায়িত্বশীল হতে হবে। শ্রমিকদের পাঠানোর ক্ষেত্রেও প্রশিক্ষণ দিয়ে, তারা সেখানে কী কাজ করবেন এবং সেখানকার পরিস্থিতি ভালোভাবে বুঝিয়ে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে পাঠাতে হবে। তখন আর শ্রমিকরা ভুল জায়গায় যাবেন না এবং তারা কোনো কারণে হতাশায়ও পড়বেন না।
সুলতানা ওহাব
প্রজেক্ট ম্যানেজার বাস্তব
অভিবাসন নিয়ে যতগুলো নীতিমালা হয়েছে, সেগুলোর কার্যক্রম কই? আইন হচ্ছে, কিন্তু মনিটরিং সেল কই? অনেক প্রচার-প্রচারণা, আশ্বাস দেয়া হয়। সভা-সেমিনার হয়, আইন হয়, কিন্তু অভিবাসীদের অবস্থার কোনো গুণগত পরিবর্তন হয় না। এজেন্সিগুলোকে ধরতে গেলে দেখা যায়, তারা রাজনৈতিক বড় কোনো শক্তির সঙ্গে যুক্ত। তখন তাদের আর ধরা যায় না। এসব এজেন্সির অনেক এজেন্ট বিভিন্ন দেশে আছে। ওইসব দেশে যখন কোনো শ্রমিক অভিযোগ করে তখন তাদের ধরে এনে অফিসগুলোতে নির্যাতন করা হয়। ফলে প্রতিকার মেলে না? এসব অনিয়ম বন্ধে আইনগুলো প্রতিষ্ঠিত হোক, মনিটরিং হোক।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা; নির্বাহী চেয়ারম্যান, পিপিআরসি
অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি যে আলোচনা জাতীয়ভাবে হয় তা হচ্ছে অর্থনীতিতে তাদের ভূমিকা। কিন্তু তাদের প্রয়োজন নিয়ে যে আলোচনা, সেটি তুলনামূলকভাবে দুর্বল। তাই শ্রমিকদের স্বার্থ সবসময় আড়ালেই থেকে যায়।
অভিবাসী শ্রমিকদের চার স্তরে কষ্ট পেতে হয়। প্রথমত, তাদের বিদেশে যেতে হলে দেড় লাখের জায়গায় সাড়ে ৪-৫ লাখ টাকায় যেতে হয়। সেটা কেন, তার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই। আমরা মনে করি, কিছু কাগুজে পদক্ষেপ নিয়ে বুঝি সব সমাধান হয়ে গেল! কিন্তু একজনের অভিজ্ঞতায় জানলাম, ওইসব কাগজ কোনো রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেনি।
দ্বিতীয়ত, তারা কাজ করলে চুক্তি অনুযায়ী বেতন দেয়া হয় না। অর্থাৎ তাদের মজুরি চুরি করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে ৪০-৫০ শতাংশ মজুরি দেয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় মজুরি দিচ্ছেই না একেবারে। তবে আশার কথা, সরকারপ্রধান এ অভিযোগকে গ্রহণ করেছেন। তাই এ বিষয়ে নজর দেয়ার একটি ভিত্তি তৈরি হয়েছে। তৃতীয়ত, তাদের কর্মঘণ্টার ক্ষেত্রে চুক্তি মানা হয় না। একধরনের মজুরি দাসত্বের পরিস্থিতিতে তাদের কাটাতে হয়। এটাকে মজুরি দাসত্ব ভিন্ন অন্য কিছু বলার সুযোগ নেই। কিছু হলেই পাসপোর্ট আটকে রাখা, নির্যাতন করার ঘটনা ঘটছে। আর সর্বশেষ চতুর্থ বিষয় হচ্ছে, প্রতিকারহীনতা। তথ্যপ্রমাণ দিয়ে, কাগজপত্র দিয়ে প্রতিকার চাওয়া হচ্ছে, কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। সমস্যার প্রতিকারে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতেও দেখা যায় না। শ্রমিকদের রেমিট্যান্স পেয়ে উল্লাসের পাশাপাশি তাদের ওপর করা অবিচারের বিরুদ্ধেও কথা বলতে হবে। যারা শ্রমিক বা শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করেন শুধু তারা নন, যারা দেশের অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেন, তাদেরও কথা বলতে হবে।
প্রতারণার আরেকটি ক্ষেত্র হচ্ছে ভিসা ব্যবসা। এ দেশীয় এবং ওই দেশীয় একটি চক্র মিলে এটি করছে। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় তারা আরো বলীয়ান হচ্ছে দিন দিন। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, অনেক শ্রমিককে অবৈধ বলা হচ্ছে। এরা তো বৈধপথে গিয়ে বাধ্য হয়ে অনিয়মিত হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া ওইসব শ্রমিকের কাছে কোনো উপায়ও নেই। তাদের অবৈধ বলার সুযোগ নেই। এদের বিষয়টা আলোচনায় আসা দরকার। এছাড়া কভিডের সময় অভিবাসী শ্রমিকরা যে নির্যাতন ও অনিয়মের শিকার হয়েছেন, তাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার ও ওইসব দেশের সরকার মিলে একটি কভিড জাস্টিস ফান্ড তৈরি করতে হবে। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারেন। অভিবাসীদের সমস্যা সমাধানে ব্যক্তির সমস্যার সমাধান দিতে হবে এবং কাঠামোগত সমস্যার সমাধানও দিতে হবে।