বাংলা সিনেমার সুদিনে যেমন ব্যবসা হলো মাল্টিপ্লেক্স ও সিঙ্গেল স্ক্রিনে

সাবিহা জামান শশী

ছবি: স্টার সিনেপ্লেক্স

সুদিন ফিরেছে বাংলা সিনেমার। তৈরি হচ্ছে ভালো সিনেমা এবং সে কারণে হলে ফিরছে দর্শক। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিবেশক সমিতির সূত্র থেকে জানা যায়, ২০২০ সালে মুক্তি পেয়েছিল মাত্র ১৫টি সিনেমা। ২০২১ সালে এসে সিনেমা মুক্তির সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২টি। ২০২২ সালে এ পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে ৪৯টি সিনেমা। অন্যদিকে বছর শেষে আজ মুক্তি পাচ্ছে ‘বীরাঙ্গনা ৭১’ ও ‘মেঘ রোদ্দুর খেলা’। 

সিনেমার ব্যবসার সঙ্গে দর্শক ও প্রেক্ষাগৃহের যোগসূত্র রয়েছে। মুক্তির পর সিনেমাগুলো দর্শক কেমন টানল আর কেমনই বা ব্যবসা করল, এ নিয়ে বণিক বার্তার কথা হয় কিছু সিনেমা হল ও মাল্টিপ্লেক্সের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। 

বাংলা সিনেমার বর্তমান বাজারের অবস্থা নিয়ে স্টার সিনেপ্লেক্সের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ‘এ বছর বাংলা সিনেমার জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর বছর ছিল। প্রেক্ষাগৃহে দর্শক ফিরে এসেছে এ বছর। আমাদের দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্য আশা জাগিয়েছে এ বছরই। এ বছরের সেরা সিনেমা ছিল পরাণ ও হাওয়া। দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ঘুড়ে দাঁড়ানোর জন্য সিনেমা দুটির অবদান ছিল ব্যাপক। সব মিলিয়ে বলতে গেলে স্টার সিনেপ্লেক্সের হলিউডের সিনেমার তুলনায় বাংলা সিনেমার প্রতি দর্শকের টান বেশি ছিল।’ 

ব্লকবাস্টার সিনেমাসের বিপণন বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক মাহবুব রহমান বলেন, ‘গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর অবস্থা ভালো ছিল। কভিড-১৯-এর সময় মানুষ হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে পারেনি, অনেকের এ আগ্রহ কমে গিয়েছিল। তবে গত রোজার ঈদ থেকে শান আর গলুই সিনেমা দুটির মাধ্যমে দর্শক হলে ফিরতে শুরু করে। এরপর পরাণ, দিন দ্য ডে, ও হাওয়া সিনেমাও সাড়া ফেলে।’

দেশী আর হলিউডের সিনেমা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হলিউডের সিনেমার সঙ্গে বিদেশী সিনেমার তুলনা করা যাবে না। যে সময় পরাণ বা হাওয়ার মতো বাংলা সিনেমা ছিল, সে সময় ওভাবে হলিউডের সিনেমা মুক্তি পায়নি। এখন যেমন একচেটিয়াভাবে অ্যাভাটার ব্যবসা করছে।’ 

সিনেমা সংকটে ঢাকার অন্যতম প্রাচীন সিনেমা হল মধুমিতা সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। বাংলা সিনেমার বাজার নিয়ে মধুমিতার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদের সঙ্গেও কথা হয় বণিক বার্তার। তিনি বলেন, ‘দিন দ্য ডে, পরাণ আর হাওয়া ছাড়া কোনো সিনেমাই আহামরি ভালো চলেনি। অনেক সিনেমা নিয়েই আমাদের আশা ছিল কিন্তু সে প্রত্যাশা পুরণ হয়নি। ভালো কনটেন্ট হলে দর্শক প্রেক্ষাগৃহে এসে সিনেমা দেখে, যার উদাহরণ পরাণ আর হাওয়া। দেশের বেশির ভাগ সিনেমা হলই বন্ধ রয়েছে এখন।’

একসময় দেশীয় চলচ্চিত্রের দর্শকপ্রিয়তার অন্যতম কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম। গত এক দশকের ব্যবধানে সিনেমা প্যালেস ও সুগন্ধা কেবল এ দুই সিনেমা হল টিকে আছে। চট্টগ্রামে এখনো চালু থাকা দুটি সিনেমা হলের কর্ণধার আবুল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একসময় সিনেমা হলের মালিকানা সবচেয়ে প্রাচুর্যময় ও সম্মানিত ব্যবসা হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনের লোকসানের ভার সইতে না পেরে এখন প্রায় সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে হাওয়া, পরাণ, মেইড ইন চিটাগাং-সহ বেশ কয়েকটি সিনেমা মুক্তি পাওয়ায় দর্শকের আগ্রহও ছিল উল্লেখযোগ্য।’ 

খুলনা জেলায় বর্তমানে চারটি সিনেমা হল চালু রয়েছে। খুলনা নগরীর চিত্রালী হলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহ খান তপু জানান, ২০২২ সালে খুলনার সিনেমা ব্যবসা সাফল্যে ছিল হাওয়া ও পরাণ। একই কথা জানিয়েছেন খুলনার সঙ্গীতা সিনেমা হলের ব্যবস্থাপক এরফান আলীও। 

দিনাজপুরে ১৫টি হলের মধ্যে ১১টিই বন্ধ। গণেশতলা এলাকায় মডার্ন সিনেমা হলের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ রেজা বলেন, ‘গত কয়েক বছরের মধ্যে চলতি বছরে পরাণ আর হাওয়া দুটি সিনেমা দেখতে হলে দর্শক হয়েছে। এছাড়া আর কোনো সিনেমা চলেনি। বর্তমানে কাগজ সিনেমার শো চলছে, এতে ১৫ জনের বেশি দর্শক হয় না।’ 

বরিশাল আর রংপুরের হল মালিকদের সঙ্গে কথা বলেও শোনা যায় তাদের হতাশার কথা। একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এ দুই অঞ্চলেও। বর্তমানে কেবল অভিরুচি সিনেমা হলটি চালু রয়েছে বরিশালে। এ হলের স্বত্বাধিকারী এবায়দুল হক চাঁন বলেন, ‘ভালো সিনেমা বছরে দু-তিনটা মুক্তি পায়। তখন ঠিকই দর্শক হলে আসে। বছরের বাকি সময় কর্মচারীদের বেতন দেয়া দায় হয়ে পড়ে আমাদের। ২০১৭-২০২২ সাল পর্যন্ত হলে মাত্র দুটি সিনেমা দর্শকপূর্ণতা পেয়েছে।’

অন্যদিকে রংপুরে শাপলা সিনেমা হলের ইনচার্জ মো. শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মানসম্মত সিনেমা নির্মাণ হলে অবশ্যই দর্শক হলমুখী হবেন। সম্প্রতি পরাণ ও হাওয়া অন্যতম উদাহরণ। এ দুই সিনেমা চলাকালে প্রতি শোয়ে দেড়শ থেকে দুই শতাধিক দর্শক হয়েছে প্রতিদিন। অথচ এখন তেমন হচ্ছে না।’ 

যশোরে এ সময় ১৫টি হল ছিল। কিন্তু সিনেমার দুর্দিনে বন্ধ হয়ে গেছে। এ বছর তুলনামূলক দর্শক পাওয়া গেছে। যশোরের বিখ্যাত মণিহার সিনেমা হলের ম্যানেজার তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘ চার থেকে পাঁচ বছর পর এমন দর্শকের সাড়া পাওয়া গেল হাওয়া ও পরাণ সিনেমার জন্য। আগে থেকেই টিকিট বুকিং হয়ে যায় সিনেমা দুটির জন্য। আমাদের হলে ১ হাজার ৩৪টি সিট রয়েছে, যার সবই বুকিং ছিল এ সিনেমাগুলোয়। 

দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরে বাংলা সিনেমার ব্যবসায়ের দিকে এগিয়ে ছিল পরাণ ও হাওয়া সিনেমা দুটি। এছাড়া আরো কয়েকটি সিনেমাও দর্শক টানতে পেরেছে। সব মিলিয়ে বাংলা সিনেমা নতুন করে আশা জাগাচ্ছে। মাল্টিপ্লেক্সগুলোয়ও ভালো অবস্থানে ছিল। কিন্তু দেশের কয়েকটি সিনেমা বাদে সারা বছরই সিঙ্গেল স্ক্রিনের হল মালিকদের লোকসান গুনতে হয়েছে। তবে ভালো সিনেমার ধারা বজায় রেখে ভালো ব্যবসাও সম্ভব, ২০২২ সে ইঙ্গিতই দিচ্ছে।


[এ প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বণিক বার্তার নিজস্ব প্রতিবেদক সুজিত সাহা এবং জেলা প্রতিনিধি শুভ্র শচীন, আসাদুল্লাহ্ সরকার, এম মিরাজ হোসাইন, সাব্বির আরিফ মোস্তফা ও আবদুল কাদের।]   

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন