গ্যাস সরবরাহে বাপেক্সের ওপরই নির্ভরতা বাড়াচ্ছে পেট্রোবাংলা

আবু তাহের

তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির জন্য বাংলাদেশের দুটি দীর্ঘমেয়াদি উৎস হলো কাতার ওমান। এর মধ্যে কাতার থেকে সবচেয়ে বেশি এলএনজি আমদানি করছে জ্বালানি বিভাগ। দেশটি থেকে গত দুই অর্থবছরে এলএনজি আমদানি করতে ব্যয় হয়েছে ২৩ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা। শুধু কাতার থেকে গত দুই অর্থবছরে যে পরিমাণ ব্যয়ে এলএনজি আমদানি করা হয়েছে, গত ১৩ বছরে এর মাত্র এক-চতুর্থাংশ অর্থ পেয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স)

২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাপেক্সের গ্যাস অনুসন্ধান উন্নয়নমূলক নানা ধরনের প্রকল্পে মোট বিনিয়োগ হয়েছে হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি দায় পরিশোধ তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে কাতার থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকায়।

তবে দীর্ঘমেয়াদি স্পট এলএনজি আমদানির অর্থ হিসাব করলে গত দুই অর্থবছরে যথাক্রমে ১৭ হাজার ৬৯২ কোটি ৩৮ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ মোট ব্যয়ের পরিমাণ ৫৬ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা।

এলএনজি আমদানিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেও পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান করতে পারছে না পেট্রোবাংলা। অবস্থায় দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলনে জোর দিয়েছে সংস্থাটি। স্থানীয় রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাপেক্সকে দিয়ে গ্যাস অনুসন্ধান উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে গত এক বছরে আশাতীত সাফল্য মিলেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাপেক্স মোট আটটি অনুসন্ধান উন্নয়ন কূপে কাজ করেছে। এর সবকটিতেই গ্যাসের সন্ধান সরবরাহ বেড়েছে। সময়ে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করার জন্য দৈনিক অন্তত ১৩৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎস বাড়িয়েছে বাপেক্স।

জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থানীয় উৎস থেকে গ্যাসের পরিমাণ কম হলেও সংকটময় পরিস্থিতিতে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়া গ্যাস বড় ভূমিকা রেখেছে। নানা তত্পরতায় আমদানি উৎস থেকে যখন গ্যাস মেলেনি ঠিক সেই সময়ে বাপেক্সের তত্পরতায় গ্রিডে বাড়তি গ্যাস যুক্ত হওয়া বড় সাফল্য। গ্যাস সংকটে থাকা জ্বালানি বিভাগের জন্য এটি কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক।

উচ্চমূল্যের কারণে স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কেনা বন্ধ রয়েছে চলতি বছরের জুলাই থেকে। অবস্থায় আমদানি চ্যানেল দিয়ে বাড়তি কোনো এলএনজি যুক্ত হয়নি গ্রিডে। এলএনজি আমদানিতে বছরজুড়ে জ্বালানি বিভাগের তত্পরতা দেখা গেলেও গ্রিডে বাড়তি কোনো গ্যাস যুক্ত হয়নি।

চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে এলএনজির উচ্চমূল্য ছিল। এরপর ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় এলএনজির দাম। ফলে চলতি বছরের জুলাইয়ে স্পট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে দেয় পেট্রোবাংলা।

এলএনজি কিনতে অর্থ সংকট এবং পরে রিজার্ভ ডলারের সংকট দেখা দিলে পণ্যটি আর কেনা যায়নি। অবস্থার মধ্যে জ্বালানি বিভাগ স্থানীয় উৎস থেকে সরবরাহ বাড়ানোর বিষয়ে উদ্যোগ নেয়। পেট্রোবাংলার লক্ষ্য হলো ২০২৫ সাল নাগাদ জাতীয় গ্রিডে ৬১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত করা।

এর ধারাবাহিকতায় বাপেক্স বিভিন্ন কূপ খনন, সংস্কার ওয়ার্কওভারের উদ্যোগ নেয়। বাপেক্সের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যক্রমের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর সংস্থাটি আটটি গ্যাসকূপে কাজ করেছে। এসব কূপ খনন করে দৈনিক ১৩৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার উৎস তৈরি হয়েছে। কয়েকটি কূপের গ্যাস এরই মধ্যে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। বাকি কূপগুলোর গ্যাসও দুই-তিন মাসের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।

চলতি বছরের জুনে কুমিল্লার শ্রীকাইলে অনুসন্ধান কূপ খনন শুরু করে বাপেক্স। ডিসেম্বরেই কূপের খননকাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। বর্তমানে কূপ থেকে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায়। এর আগে আগস্টে ভোলার শাহবাজপুরে বাপেক্সের সহায়তায় টবগী- অনুসন্ধান কূপ খননের কাজ শুরু করে রাশিয়ার তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম। হাজার ৫২৪ মিটার গভীরতায় কূপ খননের কাজ অক্টোবরে শেষ হয়। কূপ থেকেও দৈনিক ২০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস পাওয়া যাবে।

এছাড়া গত মাসে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায় প্রাকৃতিক গ্যাসকূপ খননের কাজ শুরু করেছে বাপেক্স। শরীয়তপুর- অনুসন্ধান নামে কূপে এরই মধ্যে ২০০ মিটার পর্যন্ত খননের কাজ শেষ হয়েছে। কূপে ৩০ ২০ ইঞ্চি কেচিং স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে খননকাজ শেষে কূপ থেকে সম্ভাব্য ১০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস পাওয়ার আশা করছে পেট্রোবাংলা।

স্থানীয় অনুসন্ধান কূপের পাশাপাশি বাপেক্সের মাধ্যমে পুরনো কূপেরও সংস্কার করছে স্থানীয় গ্যাস উৎপাদন কোম্পানিগুলো। এরই মধ্যে মোট চারটি কূপের ওয়ার্কওভার করা হয়েছে। এসব কূপ ওয়ার্কওভার করার মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে আরো ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে।

সিলেট গ্যাসফিল্ডের আওতায় সিলেট- গ্যাসকূপের ওয়ার্কওভার শেষ হয় চলতি বছরের জানুয়ারিতে। কূপ থেকে গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে দৈনিক পাঁচ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এছাড়া এসজিএফসিএলের আরো দুটি কূপে কৈলাসটিলা- বিয়ানীবাজার- যথাক্রমে চলতি বছরের এপ্রিলে নভেম্বরে কাজ শেষ হয়। দুটি কূপ খনন শেষে জাতীয় গ্রিডে মিলেছে ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এসব কূপ ওয়ার্কওভারে কাজ করেছে বাপেক্স।

এর বাইরে বাপেক্সের নিজস্ব গ্যাসকূপ সালদা- ওয়ার্কওভার করে দৈনিক তিন মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। এছাড়া ভোলার শাহবাজপুরে দৈনিক ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ সক্ষমতা রয়েছে এমন কূপে প্রসেস প্লান্ট বসানো হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যে কূপে প্রসেস প্লান্ট সম্পন্ন করা গেলে সেখান থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু হবে। বাপেক্সের গ্যাসকূপ থেকে সিএনজিতে রূপান্তরের মাধ্যমে উত্তোলন করে গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা করছে পেট্রোবাংলা। এরই মধ্যে গ্যাস মূল ভূখণ্ডে আনতে কাজ শুরু করেছে বাপেক্স, পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, বিশ্ববাজার থেকে যখন গ্যাস কেনা যাচ্ছে না তখন স্বল্প সময়ে বাপেক্সের তত্পরতা চোখে পড়ার মতো। তারা গত এক বছরে সংস্কার অনুসন্ধান কূপে যে পরিমাণ গ্যাস পেয়েছে সেটি সাফল্যের তালিকাকেই ভারী করে। তবে সংস্থাটিকে আরো বড় আকারে কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে জ্বালানি বিভাগের সদিচ্ছার প্রয়োজন।

বিষয়ে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আলী বণিক বার্তাকে বলেন, গত এক বছরে বাপেক্স ১০টি কূপ খনন, সংস্কার উন্নয়নের কাজ করেছে। অতীতে এত স্বল্প সময়ে ধরনের কাজ হয়নি। এক বছরে প্রতিটি কূপ থেকে গ্যাস পাওয়া গিয়েছে এবং জাতীয় গ্রিডে এরই মধ্যে বেশির ভাগ গ্যাস যুক্ত হয়েছে। আশা করছি, ২০২৫ সাল নাগাদ ৬১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সেটি পূরণ হবে। বাপেক্স সে লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন