এসওএস চিলড্রেনস ভিলেজেস

বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধশিশুদের জন্য যে ঠিকানা গড়েছিলেন ভিনদেশী

আল ফাতাহ মামুন

১৯৭২ সাল। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ। একাত্তরের দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ শেষে বিজয়ের সূর্য রঙ ছড়াতে শুরু করেছে কেবল। তবে যেখানেই আলো পড়ছে সেখানেই রক্ত ধ্বংসের চিহ্ন স্পষ্ট। ভাঙা মাস্তুল হাতে তখন সিন্দবাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বুকে তার গভীর স্বপ্ন। আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ছে চোখে-মুখে। বাংলাদেশ নামের ভাঙা জাহাজটিকে মেরামত করে ঝকঝকে-তকতকে করার ব্রত নেন। ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেনঅসহায় দুঃখী মানুষের মুখে যে করেই হোক তিনি হাসি ফোটাবেন। বাঙালি একদিন বিশ্বের বুকে ঠিকই মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। দেশ পুনর্গঠনের সংগ্রামে বিদেশী বন্ধুদেরও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানান। তার সেই ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে পরিবারহারা শিশুদের পরিবার ফিরিয়ে দেয়ার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে আসেন অস্ট্রিয়ার মানবদরদি অধ্যাপক হারম্যান মেইনার। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে মা-বাবাহারা শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যতের দায়িত্ব নেন। তার উদ্যোগে ১৯৭২ সালের ১৭ মে রাজধানীর শ্যামলীতে প্রতিষ্ঠিত হয় এসওএস (সোসাইটাস সোশ্যালিজ) চিলড্রেনস ভিলেজেস বা শিশুপল্লী।

যুদ্ধশিশুদের নিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে চিলড্রেনস ভিলেজেস কাজ করছে পরিবারহারা অনাথ শিশুদের পরিচর্যা নিয়ে। ঢাকার বাইরে রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, বগুড়া সিলেটেও এখন আন্তর্জাতিক সংস্থাটির শাখা গড়ে উঠেছে। মা-বাবাহারা শিশুদের পরিবারের ছায়ায় বেড়ে ওঠার পাশাপাশি তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠাই মূল কাজ। পড়াশোনা, খেলাধুলা তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তোলার সব ব্যবস্থাই রয়েছে ভিলেজে। আছে মমতাময়ী মায়ের পরশ ভাই-বোনের নিবিড় বন্ধন। গত ৫০ বছরে ভিলেজ থেকে পড়াশোনা করে দেশ-বিদেশের উল্লেখযোগ্য খাতে অবদান রাখছেন এমন যুদ্ধ পরিবারহারা শিশুর সংখ্যা কম নয়।

চিলড্রেনস ভিলেজেসের শুরুর গল্পটা বেশ যত্ন নিয়ে শুনিয়েছেন সংস্থার বাংলাদেশের ন্যাশনাল ডিরেক্টর . মো. এনামুর রহমান। তিনি বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ট্রিয়ায় জন্ম নেন হারম্যান মেইনার। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই মাকে হারিয়ে অনাথ হন। বড় বোনের আদরে বেড়ে ওঠা হারম্যানের হঠাৎ মনে হয়, গর্ভধারিণী মাকে ছাড়াও মায়ের অভাব পূরণ করা সম্ভব। সে ভাবনা থেকেই শুরু করেন চিলড্রেনস ভিলেজেস। মাত্র ৬০০ অস্ট্রিয়ান শিলিং (তত্কালীন মূল্যমান প্রায় ৪০ ডলার) নিয়ে ১৯৪৯ সালে অস্ট্রিয়ার ইমস্ট নামের শহরে গড়ে তোলেন ভিন্নধর্মী একটি গ্রাম। বিশাল জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা গ্রামটিতে তৈরি করা হয় আবাসিক এলাকার মতো ছোট ছোট বাসা। সেগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে পৃথক পরিবার, প্রতি পরিবারেই নির্দিষ্ট সংখ্যায় স্থান পায় অনাথ শিশুরা। একটি পরিবারে যে আদর-মমতায় একটি শিশুর বেড়ে ওঠার কথা ছিল, সে সবকিছুই মাথায় রেখে পরিকল্পনা সাজান হারম্যান মেইনার। বর্তমানে ১৩৫টি দেশে এসওএস চিলড্রেনস ভিলেজেসের কার্যক্রম চলছে।

শ্যামলীর এসওএস চিলড্রেনস ভিলেজে বৃহস্পতিবার সরজমিনে দেখা যায়, মমতাপাড়া, রুপালীপাড়াসহ কয়েকটি পাড়া মিলিয়ে পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছে। সে দৃশ্য দেখলে মনেই হবে না যে, এখানে কেউ অনাথ কিংবা পরিবারহারা। একেবারে ছোট শিশুদের মায়ের মমতায় খাইয়ে দেয়া হচ্ছে, তুলনামূলক বড় শিশুরা নিজ হাতেই খাচ্ছে আনন্দ নিয়ে। খাওয়া শেষে ব্যাট-বল কিংবা র্যাকেট হাতে মাঠে জড়ো হয়েছে একদল শিশু। আবার যারা মাঠে আসেনি তারা ঘরের কম্পিউটারের সামনে বসেছে কার্টুন অথবা গেমস নিয়ে।

চিলড্রেনস ভিলেজেসের কার্যক্রম নিয়ে . মো. এনামুর রহমান বলেন১৫টি পাড়া নিয়ে একটি ভিলেজ গড়ে উঠেছে এখানে। প্রতিটি পাড়ায় একজন মায়ের দায়িত্বে -১০টি শিশু প্রতিপালিত হয়। শিশুরা নিজস্ব তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করে। ছেলেরা ১৪ বছর হলে এখান থেকে মিরপুরের ইয়ুথ ভিলেজে শিফট হয়ে যায়। আর মেয়েরা ১৮ বছর হলে কলেজের হোস্টেলে চলে যায়।

ভিলেজ ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি পাড়ায় দোতলা বিল্ডিংয়ের একটি ঘর। নিচের তলায় একটি বেডরুম, ড্রয়িং, কিচেন ওয়াশরুম আর দোতলায় তিনটি বেডরুম। রুপালীপাড়ার মা সুমাইয়ার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আমার চার মেয়ে তিন ছেলে। দুই বছরের শিশু মেয়েকে নিয়ে আমি নিচে থাকি। আর অন্যরা থাকে দোতলায়।

এখানে শিশু নির্বাচনের বিষয়টিও বেশ সুন্দর। শূন্য থেকে ছয় বছরের শিশুদের মায়ের কোলে তুলে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে যে শিশুটির বাবা-মা নেই কিংবা থাকলেও খোঁজখবর নেয় না, ফেলে চলে যায় এমন শিশুদের ভিলেজের সদস্য করা হয়। একদিন বয়সের অনেক শিশুও স্থান পেয়েছে ভিলেজে। বিভিন্ন শিশুর সঙ্গে কথা হলে জানায়, খুব আনন্দের সঙ্গেই আছে তারা। তবে শিশুরা যে অনাথ বা পরিবারহারা বিষয়টি একটা বয়স পর্যন্ত বুঝতে দেয়া হয় না। যখন শিশুরা বড় হয় তখন তাদের অনেকে নিজ থেকেই বুঝতে পারে নিজেদের অতীত সম্পর্কে। সম্পর্কে একজন মা বলেন, শিশুরা বড় হলে আমরা তাদের বুঝিয়ে বলি অথবা অনেকের অন্য আত্মীয়রা দেখা করতে এলে তারা বুঝতে পারে, যাকে মা জেনেছে সে গর্ভধারিণী নন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, শিশুরা জানার পরও রক্তের স্বজনদের চেয়ে আমাদের প্রতিই তাদের টান থাকে বেশি।

চিলড্রেনস ভিলেজেসে যারা মায়ের দায়িত্ব পালন করেন তারা মূলত পেশাদার মা ভিলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মা নিয়োগ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে স্বামীহারা, পরিবার নেই বা সন্তানহীন নারীদেরই বাছাই করা হয়। বাছাই প্রক্রিয়া শেষে মায়েদের ট্রেনিং দিয়ে এখানে নিয়োগ দেয়া হয়। মাস শেষে তারা বেতন পান। বছরে ছুটিও পান। ছুটিতে তারা আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে যান। ওই সময় শিশুদের দেখভাল করেন খালারা। মূলত শিক্ষানবিশরাই খালার দায়িত্ব পালন করেন বেশি।

ব্যতিক্রমী মায়ের চাকরি কেমন লাগে জানতে চাইলে আনজুয়ারা নামে এক মা বলেন, শিশুদের ভালোবাসি ছোটবেলা থেকেই। স্বামীহারা হওয়ার পর একাকিত্ব ঘোচাতে চাকরি বেছে নিয়েছি। তবে এটা যে চাকরি কখনো মনেই হয় না। আমার নিজের মেয়ে আছে বাড়িতে। ছুটিতে তাকে দেখে আসি, এখানেও আমার সন্তানদের দেখভাল করি। মা তো মা-ই। মাতৃত্বের ভালোলাগা কখনো বলে বোঝানোর মতো নয়।

সন্তানদের প্রতি বিরক্ত হন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু রক্ত-মাংসের মানুষ, মান-অভিমান হয়েই যায়। কখনো আমার অভিমান হলে সন্তানরা মান ভাঙায়। আবার সন্তানদের রাগ হলে আমি বুঝিয়ে বলি। আসলে আমরা তো সবাই পরিবারহারা। পরিবারের গুরুত্বটা আমাদের কাছে অনেক বেশি। তাই অন্য সব পরিবারের চেয়ে এখানে ঝুট-ঝামেলা খুব কম হয়। আনন্দেই সময় কেটে যায়।

শ্যামলীর এসওএস চিলড্রেনস ভিলেজেই বড় হয়েছেন তানজিয়া আফরিন। এখন পড়ছেন ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে। থাকেন হোস্টেলে। তাই ভিলেজের মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তিনি বলেন, আমরা তিন বোন ভিলেজে বড় হয়েছি। ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ার পর এখানে নিয়ে আসা হয় আমাদের। বড় বোন এখন ইডেন কলেজে পড়ছে। পাশাপাশি চাকরি করছে একটি ফাইভ স্টার হোটেলে। ছোট বোন এখন এইটে পড়ছে। এখানেই থাকে। প্রায়ই মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসি।

ভিলেজে রাখা, লালন-পালন ছাড়াও পরিবারের সঙ্গে থাকা দুস্থ শিশুদের আর্থিক সহযোগিতার প্রকল্পও রয়েছে সংস্থাটির। এনামুর রহমান বলেন, আমি এখানেই বড় হয়েছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অনেক জায়গায় কাজ করার পর এখন ভিলেজের ন্যাশনাল ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমরা নানাভাবে শিশুদের বিকাশে কাজ করছি। বর্তমানে আমাদের দাতা সংস্থাগুলো স্বাবলম্বী হওয়ার কথা বলছে। তাই চেষ্টা করছি দেশীয় সোর্স থেকেই ব্যয়ভার নির্বাহ করতে। এক্ষেত্রে বিত্তশালীদের অনুদান জাকাতের অর্থ এখন আমরা কালেকশন করি। এখানে একজন শিশুর দায়িত্ব নেয়ার জন্য মাসে হাজার টাকা হলেই যথেষ্ট। অনেকেই এগিয়ে আসছেন। সবার সহযোগিতা পেলে আমাদের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন