একাত্তরে ভিন্নমতের মার্কিন কূটনীতিক আর্চার কে ব্লাড

সাইফ বাপ্পী

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কর্মকর্তাদের নিজ দেশের সরকারি নীতিমালায় দ্বিমত পোষণের সুযোগ আছে। প্রয়োজনে নিয়ে গঠনমূলক উপায়ে বিরোধিতাও করতে পারেন তারা। এজন্য আলাদা একটি মেসেজিং ফ্রেমওয়ার্কও তৈরি করা আছে, যা কূটনীতিক মহলে পরিচিত ডিসেন্ট চ্যানেল হিসেবে।

ডিসেন্ট চ্যানেলটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৭১ সালে। মার্কিন কূটনীতিকদের বড় একটি অংশ সে সময় রিচার্ড মিলহাউস নিক্সন প্রশাসনের ভিয়েতনাম যুদ্ধসংক্রান্ত নীতিমালায় অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। তাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভকে প্রশমনের উদ্দেশ্যেই চ্যানেলটি স্থাপন করা হয়। ডিসেন্ট চ্যানেলে কূটনীতিকদের পাঠানো প্রতিক্রিয়া বা সমালোচনাগুলো সরাসরি পৌঁছে যেত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে পর্যন্ত মার্কিন প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতিসংক্রান্ত নানা অভিযোগ সমালোচনা জমা হয়েছে ডিসেন্ট চ্যানেলে। তবে চ্যানেলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর প্রথম বার্তাটিই নিক্সন প্রশাসনের ভেতরে তোলপাড় তুলে দিয়েছিল। চাঞ্চল্যকর কঠোর সমালোচনাপূর্ণ বার্তাটি ছিল মূলত একটি টেলিগ্রাম। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বর্বরতা নিয়ে নিক্সন প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কূটনীতিকদের হতাশা প্রকাশ করে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো টেলিগ্রামটিতে অনুমোদন দিয়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কেন্ট (কে) ব্লাড। স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর ভয়াবহ নির্মমতার পরেও নিক্সন প্রশাসনের নির্লিপ্ততার তীব্র সমালোচনা ছিল টেলিগ্রামটিতে। গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে টেলিগ্রামটিতে আর্চার কে ব্লাড তার সহকর্মীদের ক্ষোভ উঠে এসেছিল। ইতিহাসে বহুল আলোচিত টেলিগ্রাম সর্বসাধারণের কাছে পরিচিতব্লাড টেলিগ্রামহিসেবে।

আর্চার কে ব্লাড ঢাকায় মার্কিন কনসাল নিযুক্ত হন ১৯৭০ সালে। সে সময় পূর্ব বাংলার ওপর থেকে পাকিস্তান তখন ক্রমেই নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিল। পূর্ব বাংলায় ক্রমেই সৈন্য সমাবেশ বাড়িয়ে চলছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। ২৫ মার্চের গণহত্যার দৃশ্য সে সময় ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের অনেক কর্মীর জন্যই মানসিক পীড়ার কারণ হয়ে উঠেছিল। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার মার্কিন কনসুলেটের দুই কর্মকর্তা একটি ওয়্যারলেস ট্রান্সমিটার জোগাড় করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে ওই বর্বরতার কথা জানিয়েছিলেন। বিষয়টি তত্কালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল। তারা সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভূরাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে চীনের সঙ্গে সখ্যতা বাড়ানোর উপায় খুঁজছিলেন। আর এতে তাদের সরাসরি সহযোগিতা করছিল পাকিস্তানের জান্তা সরকার।

ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন নিয়ে ওয়াশিংটনে বারবার টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন আর্চার কে ব্লাড। বিষয়টি নিয়ে নিক্সন প্রশাসনের ঔদাসীন্য আর্চার কে ব্লাডকে দিনে দিনে আরো ক্ষুব্ধ করে তুলছিল। তার সে সময়কার টেলিগ্রামগুলোয় এর স্পষ্ট ছাপও ছিল।সিলেকটিভ জেনোসাইডশিরোনামে এক বার্তায় তিনি লিখেছেন, আজ হোক কাল হোক পাকিস্তানি মিলিটারির বর্বরতার ভয়াবহ চিত্র পূর্ণরূপে সামনে আসবেই।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার মুহূর্তটির ঘটনাবলি নিয়ে ১৯৮৯ সালে আর্চার ব্লাডের সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন হ্যারি প্রেশট নামে মার্কিন বৈদেশিক সেবা বিভাগের এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। ওই সাক্ষাত্কারে তিনি জানিয়েছেন, সত্তরের নির্বাচনের ফলাফল সামনে আসার পর পরই মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের মধ্যে তুমুল আলোচনা শুরু হয়। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্ক শুরু হয়। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়ন শুরুর আগ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই গোটা বিষয়টির সমাধানের সুযোগ ছিল। মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা সে সময় পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হলে অর্থনৈতিক সহযোগিতার নতুন একটি ক্ষেত্র তৈরি হওয়া ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার মতো আর কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

সাক্ষাত্কারে আর্চার ব্লাড আরো জানান, ২৫ তারিখে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ক্র্যাকডাউন শুরুর পর তারা ওয়াশিংটনে যেসব প্রতিবেদন পাঠাচ্ছিলেন সেগুলোয় কূটনৈতিক বাতাবরণ তেমন একটা ছিল না। একটিতে জানানো হয়েছিল, শুধু ২৫ মার্চের রাতে ঢাকায় কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের হাতে হত্যাকাণ্ডের প্রমাণও ছিল। নিজের চোখে হত্যাযজ্ঞ না দেখলেও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্যাথলিক যাজকদের কাছ থেকে নানা তথ্যপ্রমাণ পাচ্ছিলেন তারা। এমনকি ক্যাথলিক চার্চে আশ্রয় নেয়ার পথে অনেক মানুষের মেশিনগান দিয়ে গুলি চালানোর ঘটনাও ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে আহতদের মার্কিন চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিয়েছিলেন। অনেক মার্কিন নাগরিক এসব হত্যাকাণ্ডের চাক্ষুস সাক্ষী ছিলেন। এসব ঘটনার তথ্য পাঠানোর পরেও ওয়াশিংটনের কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টিকে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। কারণ তারা যা শুনতে চাচ্ছিলেন, তেমন কিছু এসব তথ্যে ছিল না।

বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা নিয়ে একের পর এক বার্তা পাঠানোর পরেও ওয়াশিংটনের নির্লিপ্ততার পরিপ্রেক্ষিতে কনস্যুলটের তরুণ কর্মকর্তা স্কট বুচার একটি আনুষ্ঠানিক ডিসেন্ট মেসেজ তৈরি করেন। এতে সইকারী হিসেবে নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেন মোট ২০ কর্মকর্তা। তবে ঢাকা মিশনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে আর্চার কে ব্লাড বার্তাটিতে অনুমোদন দেবেন কিনা, সে বিষয়ে একটু দ্বন্দ্বে ছিলেন সংশ্লিষ্টদের অনেকেই। কারণ সেক্ষেত্রে তার নানাভাবে বিড়ম্বিত হওয়ার সুযোগ ছিল।

বিষয়ে ব্লাড সাক্ষাত্কারে বলেছেন, ‘ঢাকা থেকে মার্কিনদের সরিয়ে নেয়ার আগে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে একটি ডিসেন্ট মেসেজ তৈরি করা হয়। এর খসড়া করেছিলেন আমার ১২-১৩ জন স্টাফ। আমি নিজে এর খসড়া করিনি। আমাদের কর্মকর্তারা আমার কাছে এসে বললেন, তারা এটি পাঠাতে চান। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র বর্বরতার নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হওয়ায় আমরা সবাই হতাশ ছিলাম। যারা এসেছিলেন তারা সবাই ইউএসএআইডি, ইউএসআইএর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। যাদের মতামতকে আমি শ্রদ্ধা করতাম, তারা সবাই ছিলেন। সুতরাং, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এটি পাঠাতে হবে এবং আমি পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু এর সঙ্গে সহায়ক হিসেবে শক্ত ভাষায় কিছু কথাও লিখে পাঠালাম। আমি বলেছিলাম, আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এটি তৈরি করিনি। এটি আমার কাছে নিয়ে আসা হয়েছে এবং যারা এনেছেন, তারা আমার সেরা অফিসার। তারা যা বলছেন, তা আমি বিশ্বাস করি। আমি তাদের মনোভাবের সঙ্গে একমত।

ঢাকার মার্কিন কনসুলেট থেকে পাঠানো ডিসেন্ট মেসেজই পরে পরিচিত হয়ব্লাড টেলিগ্রামনামে। নিক্সন প্রশাসনের জন্য টেলিগ্রামটি ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। হেনরি কিসিঞ্জার অভিযোগ করেন, আর্চার ব্লাড টেলিগ্রামটি পাঠানোর সময়ে যথাযথভাবে গোপনীয়তার নীতি অনুসরণ করেননি। সুতরাং, তা পরে কোনো না কোনোভাবে ফাঁস হবেই। যদিও আর্চার ব্লাড পরে জানিয়েছেন, অভিযোগটি সত্য ছিল না। পরে টেলিগ্রামের বিষয়বস্তু ঠিকই ফাঁস হয়ে নতুন করে আলোড়নের জন্ম দেয়।

টেলিগ্রামটিতে বলা ছিল, ‘বৈদেশিক দপ্তরে সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে টাস্ক ফোর্সেরখোলা দৃষ্টিভঙ্গিবজায় রাখার সুপারিশ সম্পর্কে সচেতন থেকে এবং পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে মার্কিন নীতি যে কোনোভাবেই বৃহৎ পরিসরে আমাদের নৈতিক স্বার্থ বা ক্ষুদ্র পরিসরে জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়; সে বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান ধরে রেখে ঢাকার মার্কিন কনসুলেট জেনারেল, ইউএসএআইডি ইউসিসের অনেক কর্মকর্তা মনে করছেন, নীতির মূল বিষয়বস্তু নিয়ে কঠোর আপত্তি উত্থাপন করাটা তাদের নৈতিক দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। আমাদের সরকার গণতন্ত্রের ওপর দমন-পীড়নের নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার বর্বরতার নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি নিজ নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানেও শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলেও একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত সরকারকে শান্ত রাখতে উল্টো দিকে ঝুঁকছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের (পাকিস্তানি সরকারের) প্রাপ্য নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রশমনেরও চেষ্টা চালাচ্ছে আমাদের সরকার।

টেলিগ্রামটি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরেঢাকা ১১৩৮(DACCA 1138) ক্রমিকে নথিভুক্ত হয়েছিল। সে সময় পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক আরো নয় বিশেষজ্ঞ টেলিগ্রামের বক্তব্যটিতে একমত পোষণ করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তত্কালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম পি রজার্সকে আহ্বান জানিয়েছিলেন।

মার্কিন ফরেন সার্ভিসের ডিরেক্টর জেনারেলের দপ্তর থেকে প্রকাশিত মাসিক নিউজলেটার স্টেট ম্যাগে গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিতচ্যানেলিং ডিসেন্টশীর্ষক এক নিবন্ধে জানানো হয়, টেলিগ্রামটির প্রতিক্রিয়ায় আর্চার কে ব্লাডের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিলেন উইলিয়াম পি রজার্স হেনরি কিসিঞ্জার। আত্মজীবনীতে হেনরি কিসিঞ্জার জানিয়েছেন, ক্ষুব্ধ প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন নিজে সে সময় আর্চার কে ব্লাডকে ঢাকা থেকে বদলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

শিকাগোয় ১৯২৩ সালে জন্মগ্রহণকারী আর্চার কে ব্লাড মার্কিন প্রশাসনের কাছ থেকে বৈরী আচরণ পেলেও তার সহকর্মীরা তাকে দেখেছেন বীরের চোখে। বিভিন্ন সময়ে নানা স্থানে দেয়া বক্তব্যে বরাবরই তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন তারা। ২০০৪ সালে কলোরাডোর ফোর্ট কলিন্স শহরে মৃত্যু হয় তার।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন