মুক্তিযুদ্ধের শেষ তিন মাস

বণিক বার্তা ডেস্ক

কুষ্টিয়া মুক্ত হওয়ার পর মিত্রবাহিনীর ভারতীয় সেনাদের ঘিরে স্থানীয় বাসিন্দাদের উল্লাস ছবি: ভারতীয় হাইকমিশন, ঢাকা

দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর আজকের দিনে স্বাধীনতার দেখা পেয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যার যা কিছু আছে তা নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া বাঙালি জানত না, কী আছে পথের শেষে। কেমন ছিল সে সময়টা? ব্রিটিশ বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছিল বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামের নানা ঘটনার বর্ণনা। মুক্তিযুদ্ধের শেষ তিন মাসের ঘটনাপ্রবাহের উল্লেখযোগ্য অংশগুলো ব্রিটিশ নিউজ আর্কাইভ থেকে বণিক বার্তার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো

সীমান্তে সৈন্য বাড়াচ্ছে পাকিস্তান

১৯৭১ সালের ১৬ অক্টোবর। কভেন্ট্রি টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে ভারত পাকিস্তানের সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধির খবর পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়, গত দুই সপ্তাহ সীমান্ত এলাকায় ক্রমাগত আর্টিলারি হামলা চলছে। ঢাকাস্থ একজন পাকিস্তানি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এর ফলে সাধারণ জনগণ সীমান্ত এলাকা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরের অংশে চলে গিয়েছে। সীমান্তবর্তী ৩৪টি গ্রামে ভারতীয় বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলায় তখন পর্যন্ত ৩৮ জন নিহত এবং ৫৭ জন আহত হয়েছে।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পাকিস্তান সীমান্তে সৈন্য জড়ো করছে। এর দুদিন আগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী অভিযোগ তুলেছিলেন, পাকিস্তান তার দেশকে যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানসংলগ্ন ভারত সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থান নিতে শুরু করেছে পাকিস্তানি সেনারা। গত কয়েকদিনে ব্যাপক আকারের সামরিক ঘাঁটি তৈরির ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে।

ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে।

ঢাকায় ১৫ ঘণ্টার কারফিউ

১৯৭১ সালের ১৮ নভেম্বর। যুক্তরাজ্যভিত্তিক রিডিং ইভিনিং পোস্ট পত্রিকায় ঢাকায় ১৫ ঘণ্টার কারফিউ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। শহরে গেরিলা হামলা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে তা মোকাবেলায় কারফিউ ঘোষণা করা হয়। গেরিলাদের লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন বিপণি বিতান, মসজিদ, স্কুল, বাণিজ্যিক ভবন, সরকারি দপ্তর এবং শিল্পসংশ্লিষ্ট স্থাপনা।

সাধারণ মানুষের মধ্যে গেরিলা যোদ্ধাদের প্রতি সমর্থন বাড়ছিল, ফলে প্রশাসনের চোখে সহজেই ধুলো দিতে পারছিল তারা। কারফিউ জারির মাধ্যমে মূলত তাদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছিল।

১৭ নভেম্বর ১৯৭১। গেরিলাদের পাকড়াও করতে তাদের অস্ত্রের খোঁজে পাকিস্তানি সেনারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি চালায়। পাকিস্তান রেডিওর সংবাদে জানা যায়, অভিযানে ১৩৮ জনকে আটক করা হয়েছে। গ্রেফতারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় চারজনকে হত্যা করা হয়। কারো কাছে অস্ত্র বা গোলাবারুদ থাকলে তা বাড়ির সামনে রেখে দিতে শহরের বাসিন্দাদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়। তাহলে বিষয়ে তাদের কোনো জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হবে না বলেও আশ্বস্ত করা হয়।

পাকিস্তানে আক্রমণ করেছে ভারতীয় বাহিনী

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর। স্কটল্যান্ডের ইভিনিং এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানে হামলা চালিয়েছে ভারত। ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা বলেছেন, তাদের দুটি উদ্দেশ্য; ৮০ হাজার পাকিস্তানি সেনাকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করা। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, শত্রুর যুদ্ধজাহাজ লক্ষ্য করে আক্রমণ চালাতে হবে এবং পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে।

জনগণের উদ্দেশে পশ্চিম পাকিস্তানের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, ‘বর্তমান যুদ্ধ হবে ভারতের সঙ্গে চূড়ান্ত যুদ্ধ

ইভিনিং এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে যুদ্ধের উভয় পক্ষের বক্তব্য অবস্থান উঠে আসে। জেনারেল অরোরা অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো সীমা বেঁধে দেননি। তবে তার নির্দেশ ছিল, হামলায় অপ্রয়োজনে যেন পূর্ব পাকিস্তানের কোনো অবকাঠামোর ক্ষতি করা না হয়। যুদ্ধের বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বক্তব্য ছিল, তার দেশ অখণ্ডতা সম্মানের জন্য লড়ছে। ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ শুরু করেছিল। পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়া খানের বিশ্বাস ছিল, শত্রুর বিপক্ষে যুদ্ধে সৃষ্টিকর্তা পাকিস্তানের পাশেই আছেন।

পূর্ব পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ শহর ভারতীয় মুক্তিবাহিনীর দখলে

ডিসেম্বর, ১৯৭১। ব্রিটিশ গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, সেদিন ভারতীয় বাহিনী যশোরের পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ঘাঁটি দখল করে এবং সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নেয়। ঢাকা থেকে প্রায় ৮০ মাইল দূরের শহর যশোরে ছিল পূর্বাঞ্চল পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান তিন সামরিক ঘাঁটির একটি। এর মাধ্যমে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কোনো শহরের নিয়ন্ত্রণ হারায় পাকিস্তান।

ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধবিমান খুলনার বন্দরে আক্রমণ করে দুটি গানবোট ধ্বংস করে এবং অন্য দুটির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। পাকিস্তানি বাহিনী জানায়, বেনাপোল থেকে সরে গিয়ে বিকল্প স্থানে অবস্থান শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হচ্ছে। একই সময়ে, ভারতীয় সূত্রগুলো জানায়, পাকিস্তানি সৈন্যরা কাশ্মীরে ব্যাপক আক্রমণ চালিয়েছে।

পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং পূর্ব পাকিস্তানের ডানপন্থী রাজনৈতিক নেতা নুরুল আমিনকে একটি জোট সরকার গঠনের পরামর্শ দেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। এরই মধ্যে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের এক মুখপাত্র জানান, কানাডার সি-১৩০ হারকিউলিস মডেলের একটি উড়োজাহাজ সামরিক হামলার শিকার হয়েছে। ঢাকায় অবস্থানরত ২৬৫ জন বিদেশী কূটনীতিক কর্মকর্তাকে সরিয়ে নিতে শহরটির বিমানবন্দরে অবতরণ করা নিরাপদ কিনা তা দেখতে উড়োজাহাজটি পাঠানো হয়েছিল। যুদ্ধবিরতির জন্য জাতিসংঘের প্রচেষ্টাও সে সময় ব্যর্থ হয়। 

১৪ ডিসেম্বর: বুদ্ধিজীবীদের হত্যা

বাংলাদেশের বিজয় আসন্ন জেনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার সহযোগীদের শেষ আঘাতটি ছিল বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের তালিকা ধরে ধরে হত্যাকাণ্ড। এদিন হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়াদের তালিকায় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী ও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা। ১৪ ডিসেম্বর রাতে একযোগে সহস্রাধিক বুদ্ধিজীবীকে তাদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়।

১৬ ডিসেম্বর: পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ

সেদিন দুপুরে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জেএফআর জ্যাকব। এর পরই শুরু হয় আত্মসমর্পণের দলিল তৈরির বৈঠক। যেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যৌথবাহিনীর বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, আত্মসমর্পণের দলিলে সই করবেন জেনারেল অরোরা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজী।

বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে রেসকোর্স ময়দানে জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন। আর তার আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও মূল নায়ককে ছাড়া, মহান নেতাকে ছাড়া বিজয়ের প্রকৃত আনন্দ যেন

উদযাপন করতে পারছিলেন না বাংলাদেশের মানুষ। নানা ঘটনার পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। লন্ডন হয়ে ভারতে যাত্রাবিরতি নিয়ে বাংলাদেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। জানুয়ারি সকালে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের একটি বিশেষ ফ্লাইটে হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছান বঙ্গবন্ধু। পরের দিন ব্রিটেনের বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ ফ্লাইটে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেন। পথে ১০ জানুয়ারি সকালে ভারতে পৌঁছান তিনি। সেখানে দেশটির রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, তার গোটা মন্ত্রিসভা, সশস্ত্র বাহিনীর তিন বাহিনী অন্যরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিকপালকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। সেখান থেকে সংবর্ধনা শেষে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেন শেখ মুজিব। সেদিন বেলা ১টা ৪২ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর বিশেষ উড়োজাহাজটি ঢাকায় অবতরণ করে।

১০ জানুয়ারি, ১৯৭২; রক্তের অক্ষরে বিজয়ী বাঙালির বিজয়ের পরিপূর্ণতার দিন। স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ফিরলেন তার নিজের দেশে। বিজয়ী বেশে স্মরণীয় প্রত্যাবর্তন হলো মহানায়কের। সমগ্র জাতি সেদিন উপচে পড়েছিল খুশিতে। জনগণের চোখে ছিল আনন্দের অশ্রু। দেশে ফিরেই বিমানবন্দর থেকে তিনি রওনা দেন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে।

জনস্রোতের ভেতর দিয়ে শেখ মুজিবের মোটর শোভাযাত্রা বিমানবন্দর থেকে রমনার রেসকোর্স পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে পুরো ঘণ্টা সময় নেয়। সেখানে বিশাল জনসভায় শেখ মুজিব বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং এর একটি মানুষ বেঁচে থাকতেও স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন