একাত্তরে জাপানে বসবাসরত বাংলাদেশীদের তৎপরতা

আবদুর রহমান

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চরম অসন্তোষ উসকে ওঠে ১৯৭০ সালের নভেম্বরে। সেই সময়ে একটি প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় দেশের দক্ষিণাঞ্চল। কিন্তু পাকিস্তানের সেনা সরকার বিষয়টা মোটেও গুরুত্ব সহকারে নেয়নি। ফলে পরের মাস ডিসেম্বরে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। এই বিজয়ের ফলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যান তিনি। পাকিস্তানে সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে সবার প্রত্যাশা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে। কিন্তু আদতে ঘটনা তেমন ঘটেনি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে রাজনৈতিক আলোচনার পর ঢাকায় চলতে থাকা ষড়যন্ত্রের পর ষড়যন্ত্র ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত জাপানিদের গভীর মনোযোগ আকর্ষণ করে। পাকিস্তানের সংলাপের খেলায় জাপানি জাতি, সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তান এবং সারা বিশ্বের বড় একটা অংশ প্রতারিত হয়। আর তারপর যখন ২৫ মার্চ নিরীহ পূর্ব পাকিস্তানিদের ওপর গণহত্যা চালানো হয় তখন সারা বিশ্বের মতো জাপানি জাতি এবং গণমাধ্যমও হতভম্ব হয়ে যায়। 

জাপানে থাকা বাঙালিদের বেশির ভাগই ছিলেন শিক্ষার্থী এবং ট্রেইনি। হুট করে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়ে গণহত্যা শুরুর ঘটনায় বাকরুদ্ধ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তারা। ২৬ মার্চ সকালে টোকিওতে থাকা বেশকিছু বাঙালি কোমাবিয়ার মেগুরোর ফরেন স্টুডেন্ট হাউজে একত্র হন এবং নিজেদের করণীয় নিয়ে আলোচনা করেন। সেখানেই তারা সিদ্ধান্ত নেন দিনের পর থেকে আমরা আর পাকিস্তানি নই, আমরা সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক। ওই একই সভায় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ইন জাপান জন্ম নেয়। সেদিনই সংস্থাটির মুখপাত্র একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বাংলাদেশের প্রতি আমাদের আনুগত্য ঘোষণা করেন। আবার আমাদের কোনো কোনো সদস্য গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেন নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করে। এসব বিবৃতি এবং সাক্ষাৎকার এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তোলার সংবাদ সেই সময়ে টোকিওর খবরের কাগজগুলোতে প্রকাশিত হয়।

মার্চের শুরুর দিকে টোকিওতে বসবাসরত বাঙালিরা টোকিওতে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত মোতাহার হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি পূর্ববঙ্গের মানুষ ছিলেন। তার মাধ্যমে আমরা নৃশংস পাকিস্তানি সেনাদের হাতে জয়দেবপুরে বাঙালি বেসামরিক জনগণকে হত্যার ঘটনায় শোক, উদ্বেগ ক্ষোভ প্রকাশ করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে স্মারকলিপি পাঠাই।

জাপানের টোকিওতে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন, টোকিওতে প্রফেসর নারার বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ এবং ওসাকায় প্রফেসর সুরুশিমার বাংলাদেশ সলিডারিটি ফ্রন্ট গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন তহবিল সংগ্রহের প্রচারণা শুরু হয় আরো জোরেশোরে।

বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য টোকিওতে তহবিল সংগ্রহ প্রচারণা জাপানি জনগণকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত করার  ফোকাল পয়েন্ট হয়ে ওঠে। জাপানের বিভিন্ন গণমাধ্যম টিভি চ্যানেল ধরনের কার্যক্রমের বিস্তারিত কভারেজ দিতে শুরু করে এবং জাপানের সাধারণ জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিষয়ে সহানুভূতিশীল হতে শুরু করে।

এভাবেই বাংলাদেশের জন্য একটি সহানুভূতিশীল জনমত তৈরির ক্ষেত্রে জাপানের গণমাধ্যম খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১৯৭১ সালে জাপানে বসবাসকারী মাত্র ৩০ জনের মতো বাঙালির মাধ্যমেই জাপানজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করা সম্ভব হয় খুব সফলভাবেই। সফলতার পেছনে আরো কাজ করে জাপানি রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ধর্মীয় দল সাধারণ জনগণের কার্যকর স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন।

জাপানিদের জনমত সরকারি সংস্থাগুলোকে বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূলে আনা, তহবিল সংগ্রহ এবং গণমাধ্যমকে ব্রিফ করার ক্ষেত্রে আমরা মুজিবনগর সরকারেরও নির্দেশনা পেতে থাকি।

পাকিস্তানের বাঙালি রাষ্ট্রদূত এবং টোকিওতে বসবাসরত বাঙালিদের মধ্যেও একটি অঘোষিত অপ্রতিসমযুদ্ধশুরু হয়। পাকিস্তানি দূতাবাসের চালানো প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য জাপানি বুদ্ধিজীবীদের সহায়তায়বাংলাদেশ ইনফরমেশন সার্ভিসপ্রতিষ্ঠা করা হয়। জাপানি ভাষায় প্রকাশিতবাংলাদেশ নিউজ’, জাপানি বুদ্ধিজীবীদের নিরলস প্রচেষ্টা এবং মুজিবনগর সরকারের ক্রমাগত সমর্থনের মাধ্যমে পাকিস্তানি দূতাবাসের প্রোপাগান্ডা অকার্যকর করে দেয়া সম্ভব হয়। ১৯৭১ সালের মে থেকে পাকিস্তানে সাহায্য দেয়া বন্ধ করে দেয় জাপান। সেই সঙ্গে গানবোট কেনা এবং ঘোড়াশাল সার ফ্যাক্টরির কমিশনিংও ব্যর্থ করে দেয়া হয়। জাপানে কোনো ধরনের সরকারি বা বেসরকারি সমর্থন পায়নি পাকিস্তান, তার বদলে বরং তাদের প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। সেগুলো ছিল আমাদের সফলতা।

আমাদের তৎপরতা অব্যাহত থাকে। জাপানের সংবাদমাধ্যম, রাজনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবীদের ইতিবাচক ভূমিকার কারণেই পরবর্তী সময়ে জাপানি সরকারও নিউইয়র্কে জাতিসংঘে একটি অনুকূল ভূমিকা পালন করে। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের আগে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে উদার অর্থনৈতিক সহায়তার দ্বার খুলে দেয় জাপান।

শরণার্থীদের জন্য অর্থসহায়তা তুলতে আমরা টোকিওর বিভিন্ন স্থানে নিয়মিতভাবে প্রচারাভিযান চালাই। পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ত্রাণসহায়তা পাঠানোর জন্য আমরা বেশ ভালো অংকের অর্থ সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছিলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আমরা ওয়্যারলেস ইকুইপমেন্ট ওয়াকিটকি কিনি। মুজিবনগর সরকারের কাছেও তহবিল প্রেরণ করা হয় যাতে তারা প্রয়োজন অনুযায়ী তা ব্যবহার করতে পারে।

শুরু থেকেই বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকাণ্ডে যারা অংশ নিয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন ব্রডকাস্টার জাপান সরকারের স্কলার মরহুম ইসকান্দার আহমেদ চৌধুরী; সাংবাদিক, কূটনীতিবিদ জাপান সরকারের স্কলার মরহুম আহমেদ জালাল; অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী, ব্রডকাস্টার জাপান সরকারের স্কলার আনওয়ারুল করিম; ঢাকার ব্যবসায় জাপান সরকারের স্কলার মমতাজ ভুঁইয়া; ব্যবসায়ী জাপান সরকারের স্কলার মরহুম মুস্তাফিজুর রহমান; ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী আবদুর রহমান; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সৈয়দ মকবুল মুর্তাজা; অবসরপ্রাপ্ত ইউএন এজেন্সি অফিসার মরহুম আবদুল ফাত্তাহ; জাপান সরকারের স্কলার আবদুর রশিদ (বর্তমানে নিউইয়র্কে বসবাসরত); অবসরপ্রাপ্ত ইউএন এজেন্সি কর্মকর্তা আবদুল কাদের প্রামাণিক; টোকিওতে একটি প্রকৌশল ফার্মে কর্মরত নুরুল ইসলাম; সৌদি আরবের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাইফুল আলম; অবসরপ্রাপ্ত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ওয়াজির আহমেদ শেখ; চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম। এছাড়া তখন পাকিস্তান শিপিং করপোরেশনের টোকিও ম্যানেজার জনাব জুবায়েরও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন এবং তিনি সংগঠনের জন্য ভালো অংকের আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন।

 

আবদুর রহমান: একাত্তরে জাপানে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে চালানো তৎপরতায় অংশগ্রহণকারী। ছয় দশক ধরে জাপানে বসবাসরত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন