বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ বিশ্ব ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। এশিয়া মহাদেশে ভারতের পর জাপানের সঙ্গেও অবিচ্ছেদ্য মৈত্রীবন্ধনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এ যুদ্ধ। কিন্তু ইতিহাসটা সঠিকভাবে তুলে ধরা যায়নি সাধারণ মানুষের কাছে বিগত ৫০ বছরেও। সরকারি ও বেসরকারিভাবে যথার্থ উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। ফলে বাংলাদেশ, ভারত ও জাপান এই তিন দেশের বর্তমান প্রজন্ম জানেই না, ১৯৭১ সালে এশিয়া মহাদেশে কী ঘটেছিল? কে বা কারা ঘটিয়েছিল? ফলাফলই বা কী হয়েছে? তেমনি অনেকেই সঠিকভাবে জানে না, কেন জাপান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন ও সহযোগিতা করেছিল? এশিয়ায় ভারত ছাড়া তো অন্যান্য আরো দেশ ছিল, তাদের কেন কোনো ভূমিকা ছিল না? কেন চীন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে নীরব রইল? বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও কেন স্বীকৃতি দিল না? কেনই বা স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতির শত্রু পাকিস্তানিদের সজ্ঞানে সমর্থন দিল?
প্রকৃতপক্ষে, এসব প্রশ্নের উত্তর সহজভাবে দেয়া কঠিন, কারণ গবেষণার বিষয়। কিন্তু আদৌ গবেষণা হয়নি বাংলাদেশে, ভারতে এমনকি জাপানেও। নানাবিধ কারণ বা পটভূমি যে বিদ্যমান ছিল তা অস্বীকার করার উপায় নেই। পৃথিবীর এক কোণে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধটি সংঘটিত হলেও সারা বিশ্বজুড়েই সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল। অনেক দেশের সচেতন মানুষের সমর্থন উপচে পড়েছিল মূলত প্রভাবশালী গণমাধ্যমের বদৌলতে। বরং কোনো কোনো প্রভাবশালী দেশ আমেরিকা ও চীনের অনুসারী হয়ে পাকিস্তানকেই সমর্থন করেছিল। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় স্বীকৃতিও প্রদান করেনি। অবশ্য স্বীকার্য যে তত্কালীন স্নায়ুযুদ্ধ এবং ভূরাজনীতির প্রভাবে অনেক দেশই বিভ্রান্ত, ভীত এবং হতাশাগ্রস্ত ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। অনেকে আবার এ যুদ্ধকে ছোটখাটো যুদ্ধ বলেও বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু আজ যেভাবে দেশ-বিদেশে সুপ্ত বা অবরুদ্ধ তথ্য-উপাত্ত অবমুক্ত হচ্ছে, তাতে সুস্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বিপুল এবং প্রচুর রক্তক্ষয়ী। একে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। এ যুদ্ধে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। এ কথা বলেছিলেন আমাকে জাপানের বিশিষ্ট গবেষক, লেখক ও আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের প্রাক্তন প্রধান ফুকিউরা তাদামাসা (১৯৪১-), ২০১০
সালে এক সাক্ষাত্কারে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের মে পর্যন্ত বাংলাদেশে ছিলেন, সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। ১৯৭৩ সালে যুদ্ধসংক্রান্ত অভিজ্ঞতালব্ধ একটি মূল্যবান গ্রন্থও লিখেছেন। তার সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে জাপানের সম্পৃক্ত হওয়ার পেছনে একাধিক কারণ বা পটভূমি যে ছিল, তার আভাস পেয়েছিলাম।
মুক্তিযুদ্ধে
জাপানি সমর্থনের
পটভূমি
প্রথম
পটভূমি
জাপান এবং বাংলা অঞ্চলের শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ভাব বিনিময় সম্পর্ক। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে জাপানের উদীয়মান চিন্তাবিদ, পণ্ডিত, দার্শনিক শিল্পাচার্য ওকাকুরা তেনশিন (১৮৬৩-১৯১৩) ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী কলকাতায় যান তার এক শিষ্য তরুণ বৌদ্ধভিক্ষু হোরি শিতোকুকে নিয়ে। তাকে ভারত পর্যন্ত পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন তারই বিদেশী ছাত্রী, আমেরিকার নাগরিক, স্বামী বিবেকানন্দশিষ্যা জোসেফিন মাকলাউড (১৮৫৮-১৯৪৯)। উল্লেখ্য, বিবেকানন্দ ১৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে যোগদানের সময় পথিমধ্যে জাপানে দিন দশেক অবস্থান করেছিলেন। আমেরিকায় বিপুল সাফল্য ও সংবর্ধনার সংবাদ জোসেফিনের মাধ্যমে অথবা গণমাধ্যমের কল্যাণে ওকাকুরার কাছেও পৌঁছেছিল। তিনিও অনুরূপ এশিয়াভিত্তিক একটি ধর্ম সম্মেলন জাপানের প্রাচীন রাজধানী কিয়োতো শহরে অনুষ্ঠানের স্বপ্ন দেখেন এবং একই সঙ্গে একাধিক লক্ষ্য নিয়ে ভারতবর্ষে যান স্বামীজিকে অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানাতে। বেলুর মঠে তিনি পরিচিত হন স্বামীজির সঙ্গে। স্বামীজি পরিচয় করিয়ে দেন তার প্রধান শিষ্যা ভগিনি নিবেদিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের সঙ্গে। গড়ে ওঠে গভীর বন্ধুত্ব তাদের মধ্যে।
দ্বিতীয়
পটভূমি হচ্ছে জার্মানিতে পলাতক সুভাষচন্দ্র বসুর জাপান আগমন বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর প্রাণান্ত প্রচেষ্টার মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪৩ সালে। ‘নেতাজি’ উপাধি ধারণ, আজাদ হিন্দ ফৌজ পুনর্গঠন, আন্দামানে জাপানের সহযোগিতায় প্রবাসী ভারত সরকার গঠন ইত্যাদির পেছনে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী জেনারেল তোজো হিদেকি সরকারের সার্বিক সাহায্য ও সহযোগিতা অনস্বীকার্য। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জাপান হেরে গেলেও ভারতসহ পরাধীন এশিয়ার সবগুলো দেশ ও জাতি শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদের দখল থেকে মুক্তিলাভ করে। ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি জাপানের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি তথা আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে জাপানি সামরিক বাহিনীর যৌথ অভিযান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে যারপরনাই ক্রুদ্ধ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তুলেছিল। ইহুদি প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের সঙ্গে ইহুদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের গোপন আঁতাত হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আণবিক বোমা ফেলতে প্ররোচিত করেছিল। ব্রিটিশকে তার সবচেয়ে বড় উপনিবেশ ভারতকে হারাতে হয়েছিল, এটা সে সহ্য করতে পারেনি। যে ভারতের ধনসম্পদ দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গঠিত হয়েছে।
বলাই বাহুল্য, জাপানে ‘এইইউ নো চানদোরা বোউসু’ তথা ‘বীর সুভাষচন্দ্র বসু’ এক কিংবদন্তি বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর মতোই। অগণন তাদের ভক্ত। রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতিসেবী থেকে শিক্ষাবিদ পর্যন্ত। সবার একটাই আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা রবীন্দ্রনাথ, বিহারী বসু, নেতাজির দেশ স্বাধীন হোক। লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত জাপানি ভক্তদের সহযোগিতা অব্যাহত ছিল ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। স্বাধীন বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করা ছিল জাপানের আরেক পদক্ষেপ।
তৃতীয়
পটভূমি
জাপানি-বাঙালিকে আরো নৈকট্য করেছে ১৯৪৬-১৯৪৮ সাল পর্যন্ত মিত্রশক্তিপ্রধান আমেরিকা কর্তৃক পরাজিত এবং তথাকথিত যুদ্ধাপরাধী জাপানের বিচার। যার নাম ‘দি ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ফার ইস্ট’ সংক্ষেপে ‘টোকিও ট্রাইব্যুনাল’ নামে এ বিচারের অন্যতম প্রধান বিচারপতি ছিলেন আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ড. রাধাবিনোদ পাল ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে। তার জন্ম অবিভক্ত ভারতের নদিয়া জেলার শালিমপুর গ্রামে, যা বর্তমানে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলায়। তার উচ্চশিক্ষা ও বৃদ্ধি কলকাতায়। কর্মজীবন কেটেছে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে গণিতের অধ্যাপনা, দিল্লিতে ভারত সরকারের আয়কর উপদেষ্টা হিসেবে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতির দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে।
চতুর্থ
পটভূমি ১৯৬১
সালে
রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ১৯৫৭ সাল থেকেই উদ্যোগ গৃহীত হয়। ১৯৫৯ সালে গঠিত হয় ‘টেগোর মেমোরিয়াল অ্যাসোসিয়েশন’ তার ভক্ত শতাধিক বিশিষ্ট জাপানি নাগরিকদের দ্বারা। নেতৃত্ব দেন প্রভাবশালী প্রকাশক, শিক্ষাবিদ ও মৃিশল্পী বিচারপতি পালের ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধু শিমোনাকা ইয়াসাবুরোও, কাগজ ব্যবসায়ী, আচার্য ও আধ্যাত্মিক গবেষক রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের বন্ধু ড. কুনিহিকো ওওকুরা, রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য ভক্ত দোভাষী, রবীন্দ্রগবেষক এবং শিক্ষাবিদ ড. কোওরা তোমি প্রমুখ। এ উপলক্ষে জাপানে আগমন করেন কৃষ্ণা কিপালনী, অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসু, আনন্দশঙ্কর রায় প্রমুখ। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত বিপুল পরিকল্পনা অনুয়ায়ী বহু অনুষ্ঠান, সেমিনার, বাংলা ভাষা শিক্ষা, প্রকাশনা, অনুবাদ, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী, রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় টোকিও, ওসাকা, নাগাসাকি, য়োকোহামা প্রভৃতি শহরে। সে এক বিস্ময়কর ঘটনা। রবীন্দ্র জন্মোৎসব উপলক্ষে ‘আপোরোন’ ম্যাগাজিন প্রকাশনা সংস্থা থেকে আট খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলি জাপানি ভাষায় প্রকাশ হয়। ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুনীর চৌধুরী, ড. আনিসুজ্জামান প্রমুখ জাপানে আগমন করেন শিক্ষা কার্যক্রম উপলক্ষে। তাদের সঙ্গে মতবিনিময় ঘটে রবীন্দ্রনাথভক্ত, বাংলা ভাষা শিক্ষার্থী তরুণ অধ্যাপক কাজুও আজুমা, অধ্যাপক নারা সুয়োশি প্রমুখের। ঢাকায় পাকিস্তানি সরকারের বিরোধিতা সত্ত্বেও রবীন্দ্র জন্মোৎসব অনুষ্ঠানের খবর জাপানে আসে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সংবাদ, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, ছয় দফা আন্দোলনের খবরাখবর বাঙালিভক্ত জাপানিরা জানতে পারেন।
পঞ্চম
পটভূমি ছিল বাঙালির প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ জাপানিদের প্রতিদান। জাপানিদের রাজনৈতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ও সহযোগিতা জোগানোর পেছনে প্রণোদিত করেছিল বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের জাপানের প্রতি অমূল্য অবদানের বিনিময়ে তার প্রতিদানস্বরূপ বাঙালির শত শত বছরের কাঙ্ক্ষিত স্বাধিকার অর্জনে ভূমিকা রাখা। জাপানের সরকার ও জনগণ সে ভূমিকা রেখেছিল দুবারই—প্রথমবার ১৯৪৩ সালে নেতাজির নেতৃত্বে ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং দ্বিতীয়বার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। টোকিও ট্রাইব্যুনাল সমাপ্তির বছর ১৯৪৮-১৯৭১ সাল পর্যন্ত—এই ২৩ বছরের ব্যবধানে তখনকার বিভিন্ন স্তরের বহু জাপানি রবীন্দ্রনাথ, বিপ্লবীদ্বয় রাসবিহারী বসু, হেরম্বলাল গুপ্ত, নেতাজি এবং বিচারপতি পালের স্মৃতি বিস্মৃত হননি। বাঙালির স্বাধীনচেতা তেজস্বী মনোভাব তখনো জাপানি বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ১৯৮৪ সালে জাপানে এসেও আমি সে উত্তাপ কিছু প্রবীণ শিক্ষক, শিল্পী, গবেষক, লেখক, ব্যবসায়ী, পুরোহিত ও রাজনীতিকদের মধ্যে লক্ষ করেছি। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু যখন জাপান সফরে আসেন, তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন প্রচণ্ড প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ তানাকা কাকুয়েই। বঙ্গবন্ধুকে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী তানাকার জাঁকজমকপূর্ণ সংবর্ধনায় তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তার সূচনা ছিল ওকাকুরা ও রবীন্দ্রনাথের ঐতিহাসিক সাক্ষাত্কারের প্রসঙ্গ দিয়ে।
জাপানের
চিন্তায় পূর্ব
বাংলা : জাপানিরা বরাবরই জানতেন যে পূর্ব বাংলা প্রাকৃতিকভাবে অত্যন্ত উর্বর, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ধনসম্পদের দিক দিয়ে প্রাচুর্যশালী—প্রচুর সম্ভাবনাময়। সুতরাং বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পরে জাপানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন হবে ব্যাপকভাবে। আর সে সুদূরপ্রবাসী পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের মধ্য দিয়ে। যা ১৯৭৫ সালের পর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ‘ওয়াতাশি তো বানগুরাদেশু’ অর্থাৎ ‘আমি এবং বাংলাদেশ’ শিরোনামে ঢাকায় প্রাক্তন কনস্যুলেট প্রধান এবং তোওয়োও ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির উপদেষ্টা তাকেনাকা কিনইচি তার ‘বাংলাদেশের স্মৃতি (২)’ পর্বের
৩ নম্বর অধ্যায় ‘অর্থনৈতিক সমস্যা এবং জাপানের ভূমিকা’ লিখতে গিয়ে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীন পাকিস্তান দিয়ে শুরু করেছেন। সে ভূমিকা থেকে জানা যাচ্ছে যে বিশ্বশ্রেষ্ঠ সোনালি আঁশ তথা পাটের উৎপাদনস্থল পূর্ব পাকিস্তান যখন ভারী শিল্প, কলকারখানাবহুল পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা হয়ে গেল, তখন এ দেশেও কলকারখানা স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। পাট, সুতো ও দিয়াশলাই—এ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প জাপানের কাঁচামাল ও প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, কারিগরিতে দক্ষ প্রযুক্তিবিদ না থাকায় জাপানের খ্যাতিমান প্রযুক্তিবিদ, যিনি এর আগে কলকাতায় কাজ করেছেন তাকে পাকিস্তান সরকারের কারিগরি দপ্তরের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তার নাম নাকাতা ইচিও, তত্কালীন টোকিওতে মিত্রবাহিনীপ্রধান জেনারেল ডগলাস ম্যাক-আর্থারের অনুমোদন নিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করে ঢাকায় যান নাকাতা। এ নিয়ে পত্রিকায় সংবাদও প্রকাশ হয়। তিন বছর সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেন নাকাতা। তিনি তখনকার ঢাকায় ‘জাপানি নাগরিক সমিতি’র সভাপতি ছিলেন। আরেকজন জাপানির কথাও তাকেনাকা কিনইচি জানাচ্ছেন, তিনি কাতাগাতা গেনহাচি, ১৯ বছর বয়সে এ কাচ প্রস্তুতকারী প্রযুক্তিবিদ ঢাকায় গিয়ে এক হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তির কাচ ব্যবসার ব্যবস্থাপক হিসেবে ৫০ বছর কাজ করেছেন। সুতরাং বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বড় শিল্প-কলকারখানা স্থাপনে এ দুজন জাপানির অবদান যে কত গুরুত্ব পাবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
মুক্তিযুদ্ধে
জাপান : ১৯৭১
সালের
২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অতর্কিতে ‘সার্চলাইট’ অভিযান ও আক্রমণ চালায় সারা দেশের নিরীহ, ঘুমন্ত জনসাধারণের ওপর। এ ঘটনা সমগ্র বিশ্ববাসীকে গভীরভাবে মর্মাহত করে। জাপানিরাও তার ব্যতিক্রম নন। জাপান সরকার তীব্র নিন্দা জানায় এবং দ্রুত পাকিস্তানে চলমান সব প্রকল্পের সাহায্য ও সহযোগিতা স্থগিত করে। অকারণ হত্যা বন্ধের আহ্বান জানায়। তাত্ক্ষণিক এ সাহসী ভূমিকা রাখার পেছনে যে রাজনীতিবিদ হায়াকাওয়ার উদ্যোগ ছিল বলাই বাহুল্য। এর মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের নিন্দা ও প্রতিবাদ প্রকাশ হতে থাকে। সবার আগে এগিয়ে আসেন রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা, রাজনীতিবিদ ও সংসদ সদস্য মাদাম কোওরা তোমি, ভাষাবিদ অধ্যাপক নারা সুয়োশি, মাদাম হায়াশি তাকাকো, নেতাজির সহযোদ্ধা ইতোও কেইসুকে, সাংবাদিক তানাকা তোশিহিসা, তিব্বতি ছাত্র পেমা গিয়ালপো প্রমুখ। পত্রপত্রিকায় মতামত দিতে থাকেন তারা। এছাড়া সাধারণ মানুষ জড়ো হতে থাকে রাজপথে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি নিধনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ক্ষোভ জানাতে। ভারতে আশ্রিত এক কোটি শরণার্থীর দুরবস্থার সংবাদে বিচলিত হয়ে ওঠে জাপানিরা। ক্রমে ক্রমে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব শক্তিশালী হতে থাকে। গঠিত হয় ‘নিহোন বেনগারু ইউ নো কাই’, ‘বাংলাদেশ
সলিডারিটি ফ্রন্ট’সহ একাধিক সংস্থা। মে মাসের দিকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আবেদন আসে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন ও শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ সাহায্য পাঠানোর জন্য। জাপান প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে তখন উচ্চশিক্ষারত শেখ আহমেদ জালাল অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। তিনি জাপানি নাগরিক ও সরকারের কাছে আবেদন জানান এগিয়ে আসার জন্য। তার আহ্বানে সাড়া দিতে থাকেন সাধারণ জাপানিরা। এগিয়ে আসেন রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য হায়াকাওয়া তাকাশি। সার্বিকভাবে নেতৃত্ব দিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে পথে নামেন। টোকিওর পথে পথে চাঁদা সংগ্রহ অভিযান, তহবিল গঠনের উদ্যোগ আন্দোলনে রূপ নেয়। আহমেদ জালালের আহ্বানে অন্যান্য প্রবাসী বাঙালিও রাজপথে নামেন, তাদের মধ্যে পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি কর্মকর্তা এমএস মাসুদ, সাংবাদিক ইসকান্দার আহমেদ চৌধুরী ছিলেন। ১৯৯২ সালে ইসকান্দার চৌধুরীর কাছে একটি অ্যালবাম ছিল, তাতে অনেক ছবি দেখেছি সে সময়ের। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে এগিয়ে আসে ‘কিয়োতো মোমোয়ামা লায়নস ক্লাব’। অসামান্য ভূমিকা রাখে সংগঠনটি। নেতৃত্ব দেন তখনকার গভর্নর তাসুগি কিয়োশি। তিন দফায় অর্থ সংগ্রহ করা হয় তার নেতৃত্বে। প্রথম দফায় ১০০,০০০,০০ ইয়েনের সমপরিমাণ পণ্যসামগ্রী সংগৃহীত হয়। দ্বিতীয় দফায় ২০০,০০০,০০ ইয়েন। এ টাকা জাতিসংঘের মাধ্যমে প্রেরিত হয়।
জাপানের
কূটনৈতিক সাফল্য
: ক্রমাগত
মুক্তিযুদ্ধে যখন তখনকার সব পরাশক্তি জড়িয়ে যেতে থাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে, জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় পরাশক্তি সোভিয়েত রাশিয়ারও, তখন আমেরিকা প্রমাদ গুনতে থাকে। দল ভারী করার জন্য নিক্সন সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের পরিকল্পনায় চীনকে ভেড়াতে উদ্যোগী হয়। কিসিঞ্জার ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে গোপনে পাকিস্তান ও চীন সফর করে সাক্ষাৎ করেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এনলাইয়ের সঙ্গে। এ ঘটনা জেনে যায় জাপান সরকার। এটা ছিল জাপান সরকারের জন্য সুপ্ত কানে জল ঢেলে দেয়ার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। একে ‘নিক্সন শক’ বলে অভিহিত করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ২৬ বছর অতিক্রান্ত হলেও চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি জাপানের। পুরনো উপনিবেশ সমস্যা নিয়ে চীনকে আমেরিকা উসকে দেয় কিনা বা নতুন কোনো চাপ প্রয়োগ করে কিনা, ভেবে বিচলিত ছিল জাপান। আমেরিকার চাতুর্যে চীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, পশ্চিম পাকিস্তানকে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে জাতিসংঘের প্রতিনিধি এবং নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ লাভ করে। জাপান তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন অব্যাহত রেখে চলেছে।
১৯৭২ সালে ভুটান, ভারতের পর জাপান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে ১০ ফেব্রুয়ারি। এর পেছনে যিনি নিরলস সাহসী ভূমিকা রেখেছেন, তিনি হায়াকাওয়া তাকাশি। বলা যায়, একদা গুরু তোওয়ামা মিত্সুরুর দুঃসাহসী ভূমিকাই যেন পালন করেছেন তিনি। ১৯০২ সালে ভারত শাসক ব্রিটিশের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ ইম্পেরিয়াল জাপান সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুকে রক্ষা করেছিলেন তিনি। তেমনি
আমেরিকার ছত্রছায়ায় থেকেও মুক্তিযুদ্ধে জোরালো সমর্থন অব্যাহত রেখে দ্রুত স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান ছিল যুদ্ধোত্তর জাপানের প্রথম এবং একমাত্র কূটনৈতিক সাফল্য।
১৯৭২ সালের মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী সাতোও এইসুকে (প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কিশি নোবুসুকের অনুজ) হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় পাঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাপান সফরের আমন্ত্রণ জানাতে। এ দলে দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যথাক্রমে রাজনৈতিক গবেষক, লেখক এবং বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের স্নেহধন্য শিষ্য তানাকা আসাআকি এবং ভূতপূর্ব রাজকীয় সেনাবাহিনীর ‘এফ কিকান’ ইন্টেলিজেন্স ইউনিট প্রধান এবং নেতাজির সহযোদ্ধা লে. জেনারেল ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি।
প্রবীর বিকাশ সরকার: শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক