মুক্তিযুদ্ধে জাপানি নাগরিকদের অবদান

নিজাম আশ শামস

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একেবারে শুরুতেই ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ জাপানের সব শ্রেণীর নাগরিক আন্দোলনকে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করেন। বিভিন্ন ব্যক্তি সংগঠন জাপানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনুকূল একটি পরিবেশ তৈরিতে অবদান রাখে। সম্মুখ সারিতে থাকা ধরনের দুটি সংগঠন ছিলনিহোন বেনগারু ইউনো কাই’ (জাপান-বাংলা মৈত্রী সংস্থা) জাপান-বাংলাদেশ সলিডারিটি ফ্রন্ট’ (জাপান-বাংলাদেশ সংহতি সংঘ)ফ্র্যাতিকান অ্যাগন পোর লেগান্তোজ এন অরিয়েন্তা বেঙ্গলিও’ (চলো পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ভাই বোন হিসেবে কাজ করি) নামক সংগঠনটিও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।জাপান-বাংলাদেশ সলিডারিটি ফ্রন্টগঠিত হয় আগস্ট মাসে। কানসাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেত্সুরেই তুরুশিমার নেতৃত্বে এটি গঠিত হয়। সংগঠনবাংলাদেশ সংবাদনামে একটি সাময়িকী প্রকাশ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সাময়িকীটিতে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশ হয়।ফ্র্যাতিকান অ্যাগন পোর লেগান্তোজ এন অরিয়েন্তা বেঙ্গলিওসংগঠনটির প্রধান ছিলেন তোশিহিরো কাতাওকা। তার নেতৃত্বে সংগঠনের সদস্যরা জাপান সরকার, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, জাপান সোশ্যালিস্ট পার্টি, কুমেই ক্লিন পার্টি, ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট পার্টি জাপান কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি বাংলাদেশকে সহায়তা করার আবেদন জানিয়ে চিঠি পাঠান। তারা জাপানে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসে গিয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত কূটনীতিকদের সঙ্গে আলাপ করেন। বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য দাবিকে সমর্থন করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কিছু বইও প্রকাশ করেন। বাংলাদেশে চলমান গণ-আন্দোলনের পক্ষে জাপানের নাগরিকদের মধ্যে জনমত তৈরিতেনিহোন বেনগারু ইউনো কাই’ (জাপান-বাংলা মৈত্রী সংস্থা) ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এর সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক সুয়োশি নারা। জনমত তৈরির পাশাপাশি সংগঠন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও বাংলাদেশের বিষয়টি উত্থাপন করে। এর সদস্যরা বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর আয়োজিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভায় অংশগ্রহণ করেন। তারা ভারতে এসে শরণার্থী শিবিরগুলোও পরিদর্শন করেছিলেন। সেকিগুচি নামে এক ধর্মগুরুর নেতৃত্বে টোকিওতে অবস্থিত বৌদ্ধ ধর্মীয় সংগঠনবুশো গোনেন কাইশরণার্থীদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রচারাভিযান চালায়।

কেবল জনমত গঠনই নয়, বাংলাদেশকে জাপানের দ্রুত স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রেও জাপানি নাগরিকদের অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মহান কীর্তির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এখানে আমরা বেশকিছু উদাহরণ তুলে ধরব।

জাপানে বাংলাদেশের পক্ষে ব্যাপক জনমত গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন অধ্যাপক সুয়োশি নারা। তিনি ১৯৭১ সালের এপ্রিলেনিহোন বেনগারু ইউনো কাই’ (জাপান-বাংলা মৈত্রী সংস্থা) গঠন করেন। ১৯৬৮-৬৯ সালে তিনি ঢাকা শহরে বাস করতেন। সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানি ভাষা সংস্কৃতির শিক্ষক ছিলেন। ফলে বাংলাদেশের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ জানতেন। তিনি ছিলেন ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষদর্শী। ৭১-এর জুলাইয়ে তার উদ্যোগেনিহোন বেনগারু ইউনো কাইবাংলাদেশে চলমান সহিংসতার গবেষণামূলক প্রতিবেদন সংবলিত একটি বই প্রকাশ করে। জাপানের তত্কালীন বিরোধী দল জাপান সোশ্যালিস্ট পার্টির সংসদ সদস্য কেনিশি নিশিমুরা বইটি পড়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাঙালি শরণার্থীদের দুর্দশার কথা জানতে পারেন। এতে তিনি এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সংসদ সদস্য ইয়োশিও সাকুরাওচি একটি প্রতিনিধি দলের প্রধান হিসেবে কলকাতার সল্ট লেকে অবস্থিত শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। অধ্যাপক নারার নেতৃত্বে গঠিত মৈত্রী সংস্থাটিতে ১৩৯ জন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার চালানোর পাশাপাশি তাদের নিয়মিত আর্থিক অংশগ্রহণও ছিল।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অধ্যাপক মিনোরু কিরিয়ু টোকিওতে অবস্থিতইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ’-এর পাকিস্তান মিয়ানমার বিষয়ক গবেষণা কর্মকর্তা ছিলেন। একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে প্রকাশ্যে কোনো প্রচার চালানোর অনুমতি তার ছিল না। তাই তিনি গোপনে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ চালিয়ে গিয়েছেন। ১৯৬৮-৭০- দুই বছর তিনি ঢাকা কুমিল্লায় ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি অর্থনীতি নিয়ে গবেষণার জন্য সময় তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বেকসুর খালাস পেয়ে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এক জায়গায় বিপুলসংখ্যক মানুষ একত্র হয়ে একজন মানুষের কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে, এটি ছিল তার জন্য সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতা।

১৯৭১ সালে তাদামাসা ফুকিওরা আন্তর্জাতিক রেড ক্রস সোসাইটির প্রতিনিধি হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান করছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জাপানি নাগরিকদের যখন ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছিল, তখন তিনি জাপানে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানান। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশে ছিলেন। উপকূলীয় এলাকায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণের সময় তিনি মুক্তিবাহিনীর সরাসরি সংস্পর্শে আসেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের দোসররা যেসব এলাকায় হানা দেয়ার পরিকল্পনা করত, মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা তাকে সে সব জায়গায় ক্যাম্প করার অনুরোধ জানাতেন। যেহেতু তিনি ছিলেন একজন বিদেশী নাগরিক, আবার একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য, তাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তার উপস্থিতি এড়িয়ে চলতে চাইত। একবার এক গ্রামে হানাদার বাহিনীর আক্রমণের সম্ভাব্যতা জানতে পেরে বেলা ২টার মধ্যে তিনি সে গ্রামে তার ক্যাম্প স্থানান্তর করেন এবং ত্রাণসামগ্রী বিতরণ শুরু করেন। বিকাল ৪টার মধ্যে গ্রামবাসীরা তাকে জানায় যে মেশিন গান সংবলিত দুটি পাকিস্তানি গানবোট গ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তিনি তার সহযোগীরা সতর্ক অবস্থান নেন। গানবোট থেকে এক পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা নেমে ক্যাম্পে আসেন। তার রাগান্বিত চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল যেন তার মুঠি থেকে শিকার হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। কোনো রকমে সৌজন্য বিনিময় করে তিনি ফিরে যান। পরবর্তী সময়ে তাদামাসা ফুকিওরা জানতে পেরেছিলেন, গানবোটে মর্টার লঞ্চারও ছিল। ঠাণ্ডা মাথায় সম্পূর্ণ গ্রামটিকে ধূলিসাৎ করে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানিদের। তা এড়াতে পেরে তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য তিনি ঢাকায় অবস্থিত রেড ক্রসের গুদাম থেকে বিপুল পরিমাণে ওষুধ নিয়ে আসতেন। মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা মহান বন্ধুকে তারাজাপানি মুক্তিবলে ডাকতেন।

৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকামাসা সুজুকি ছিলেন টগবগে যুবক। কম্পিউটার প্রকৌশলের ওপর ডিগ্রিপ্রাপ্ত প্রকৌশলী তখন টোকিওতে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণার উদ্দেশ্যে তিনি তাদের পারিবারিক একটি ভ্যান নিয়ে আসেন। গাড়িটির চারপাশে ছাদে বড় বড় প্ল্যাকার্ড লাগানো হয়েছিল। প্ল্যাকার্ডে জাপানি ভাষায় লেখা ছিলবাংলাদেশকে সাহায্য করুন পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে গিয়ে তিনি মাইক্রোফোনে জোরে জোরেবিটলসব্যান্ডেরবাংলাদেশগানটি বাজাতেন এবং বাংলাদেশে চলমান গণহত্যার বিপক্ষে বক্তৃতা দিতেন। ভ্যান নিয়ে টোকিও থেকে কোবে যাওয়ার পথে ইয়োকোহামা, নাগোইয়া ওসাকাসহ অনেকগুলো ছোট-বড় শহর তিনি অতিক্রম করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মিদোরি ইয়ামানাকা জাপানের একটি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন। ৭১-এর জুন কিংবা জুলাইয়ের কোনো একদিন তিনি তার বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশে চলমান মুক্তিযুদ্ধের ফলে শরণার্থীদের দুর্বিষহ জীবনযাপনের কথা বলেন।। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে তা গভীর রেখাপাত করে। তোশিকো হোত্তা নামে এক ছাত্রী তার সহপাঠীদের সঙ্গে বিষয়ে আলোচনা করে এবং শরণার্থীদের সহায়তায় অবদান রাখার জন্য তাদের আহ্বান জানায়। প্রত্যেকে সে আহ্বানে সাড়া দেয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, নিজেদের টিফিনের টাকা থেকে কিছু অংশ সঞ্চয় করবে। এভাবে তারা এক মাস টিফিনের টাকা জমিয়ে তাদের শিক্ষিকার হাতে তুলে দেয়।

বাংলাদেশের প্রতি জাপানের আপামর জনসাধারণের অকুণ্ঠ সমর্থনের কারণে বিজয়ের মাত্র দুই মাসের মধ্যে ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জাপান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। আজ মহান বিজয় দিবসে তাদের প্রতি জানাই শ্রদ্ধা কৃতজ্ঞতা।

 

নিজাম আশ শামস : লেখক অনুবাদক

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন