দারুণ খেলেও বঞ্চিত ডাচ ফুটবলের সাতকাহন

আহমেদ দীন রুমি

ছবি: রয়টার্স

পিম মুলারের বয়স সবে চৌদ্দ। কিন্তু আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর। অনেক দিন ধরেই ভাবছিলেন ক্লাব প্রতিষ্ঠার। ১৮৭৯ সালে সেই পরিকল্পনা দেখল আলোর মুখ। প্রতিষ্ঠিত হলো হারলেমশে ফুটবল ক্লাব। যদিও প্রথম দিকে রাগবি খেলার জন্য যাত্রা শুরু করেছিল ক্লাবটি। ক্রমে অর্থনৈতিক ঘাটতি ও অন্যান্য কারণে রাগবি ছেড়ে ফুটবল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন কে জানত, এই ছোট টিনএজারের পদক্ষেপই নতুন করে তৈরি করবে ডাচদের ইতিহাস!

স্পার্টা রোটারডাম ক্লাব দিয়ে শুরু

ওই শতকের শেষ দিকে ক্রমশ ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকায় জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে ফুটবলের। ডাচরাও সেই অগ্রযাত্রায় পিছিয়ে  থাকেনি। ১৮৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় স্পার্টা রোটারডাম ক্লাব। ডাচ ভূমিতে সবচেয়ে পুরোনো ফুটবল ক্লাব এটি। তখন জনমনে বিপুল সাড়া ফেলে ফুটবল। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ক্লাবের সংখ্যাও। ১৯০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এএফসি অ্যাজাক্স, ১৯০৮ সালে ফিয়েনুর্ড রোটারডাম এবং ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পিএসভি।

এনভিএবির প্রতিষ্ঠা, ফুটবলের নতুন ঝড়  

পিম মুলারের নেতৃত্বেই নেদার‍ল্যান্ডস ফুটবল অ্যান্ড অ্যাথলেটিক্স অ্যাসোসিয়েশন (এনভিএবি) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৯ সালে। পরবর্তীতে অ্যাথলেটিক্স থেকে আলাদা করে ১৮৯৫ সালে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে নেদারল্যান্ডস ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন।

আরেক দফা পরিবর্তন আসে ১৯২৯ সালে। প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে নতুন নাম নিয়ে প্রকাশ করে দ্য রয়েল ডাচ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বা কেএনভিবি। ডাচরাও আগ্রহ দেখাতে শুরু করে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। যে কারণে দ্রুত বাড়তে থাকে সদস্য। ১৮৮৯ সালে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনে সদস্য সংখ্যা ছিল ২৫০ জন। চার দশক পর ১৯২৯ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৫ হাজারে। ১৯৭৮ সালে দেশটির একমাত্র ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেএনভিবির সদস্য সংখ্যা দশ লাখ অতিক্রম করে। কয়েক বছর আগে ২০১৫ সালেই সেই সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ২৭ হাজার ১৫৭ জন।

পিম মুলার

বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডস

১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফিফা। প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, স্পেন, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ড ছিল। তারপাশে যুক্ত হয় নেদারল্যান্ডসের নাম। তবে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের আসরে অংশগ্রহণ করে ১৯৩৪ সালের আসরে। ডাচদের হয়ে প্রথম গোল করেন কিক স্মিথ। কিন্তু প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিতে হয়। ১৯০৮ সালে প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে।

খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক না দেয়ায় বিতর্ক

এমন জমজমাট অবস্থার মাঝে দীর্ঘদিন কেএনভিবি প্রফেশনাল ফুটবলের প্রতি অনীহা দেখিয়েছে। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের সময় কেএনভিবি খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক দিতে নারাজ ছিল। যার প্রভাব পড়ে ব্যাপক।

বিপুল সংখ্যক খেলোয়াড় দেশের বাইরে চলে যেতে শুরু করে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর কেএনভিবি অদ্ভুত এক সিদ্ধান্ত নেয়। যারা বাইরে চলে যাবে, তারা আর জাতীয় দলে খেলতে পারবে না। স্থানীয় ফুটবলের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে শুরু করে এই সিদ্ধান্ত। ফলাফল বিবেচনায় দেশের অভ্যন্তরেই সমালোচনার জন্ম নেয়। নানাভাবে আসতে থাকে প্রতিবাদ। কেএনভিবির নির্দেশনা অমান্য করে অন্তত দশটি ক্লাব চালু রাখে পেশাদার ফুটবলের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা। শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়ে কেএনভিবি।

পেশাদার খেলোয়াড়দের নিয়ে সংস্থা

১৯৫৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর ডাচ প্রফেশনাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা হয়। প্রথম প্রফেশনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় অ্যালকামার-৫৪ এবং এসসি ভেনলো ক্লাবের মধ্যে। ডাচ ফুটবল ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ১৯৭১ সালে। ওই সময় নারীরা আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেয় কেএনভিবিতে।  

বিশ্বকাপ কিংবা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন লিগে ডাচদের ফুটবল আলাদা অবস্থান তৈরি করে রেখেছে। দীর্ঘ অভিযাত্রায় কিংবদন্তি অনেক নাম যুক্ত হয়েছে ডাচ একাদশে। জোহান ক্রুইফ, ডেনিস বার্গক্যাম্প ও মেম্ফিস ডিপে একেকটা নক্ষত্র যেন।

ফুটবলে নেদারল্যান্ডসের যত অর্জন

১৯৮৮ সালে নেদারল্যান্ডস ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ানশিপ জয় করে। ১৯৭৪, ১৯৭৮ ও ২০১০ সালের বিশ্বকাপ আসরে ফাইনালে ওঠেও হাতছাড়া হয় বিশ্বকাপ। ১৯৭৪ সালে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাকে হারিয়েও পশ্চিম জার্মানির কাছে পরাজিত হয় এই দল। ১৯৭৬ উয়েফা ইউরো, ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ, ২০০০ সালের ইউরো, ২০০৪ সালের ইউরো এবং ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ আসরে সেমিফাইনাল থেকে ছিটকে পড়ে। ফুটবলে নেদারল্যান্ডস এমন অল্প কয়েকটি দলের একটি, যারা দারুণ খেলা উপহার দিয়েও বিশ্বকাপের শিরোপা জয় থেকে বঞ্চিত রয়েছে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন