দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতায় জাপানকে শীর্ষে রেখে বিদায় নিচ্ছেন রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি

সাইফ বাপ্পী

জাপানের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি আর কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ ছাড়ছেন। প্রায় তিন বছর দায়িত্ব পালনের পর জাপানে ফিরে যাচ্ছেন তিনি। রেওয়াজ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে গতকাল তিনি বিদায়ী সাক্ষাৎ করেছেন।

ইতো নাওকি বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত হয়ে আসেন ২০১৯ সালের অক্টোবরে। সে সময়ে বেশ অস্থিতিশীলতার মধ্যে যাচ্ছিল দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি। তার দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিনের মধ্যেই গোটা বিশ্বে কভিড মহামারীর প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ে। অন্যান্য দেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয় জাপান বাংলাদেশের অর্থনীতিও। কভিডের প্রাদুর্ভাবজনিত দুর্যোগের মধ্যেও শ্লথ হয়নি দুই দেশের সহযোগিতার গতি। এমনকি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনীতি ব্যাপক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরেও বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে দেশটি।

বাংলাদেশসহ অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলায় জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত শিনজো আবের উদ্যোগে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট বা বিগ-বি কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল জাপান। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হয়ে আসার পর উদ্যোগটিকে পূর্ণ গতিতে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়িত্ব বর্তায় ইতো নাওকির কাঁধে। সবচেয়ে বড় দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগী দেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। বিদায়বেলায়ও জাপানকে সে অবস্থানে রেখেই বাংলাদেশ ছাড়ছেন তিনি। বিদায়ের আগে শেষ মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তার কিছু বক্তব্য নানাভাবে অস্বস্তি তৈরি করলেও জাপানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এর প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অঞ্চলের দেশগুলোয় গত কয়েক বছরে চীন আগ্রাসীভাবে ঋণ বিনিয়োগ করে গেলেও বাংলাদেশে এখনো শীর্ষ ঋণদাতা দেশ জাপান। দেশের বিদ্যুৎ জ্বালানি, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামো, পরিবেশ, মানবসম্পদ উন্নয়নসহ অন্যান্য খাতে বড় অংকের বিনিয়োগ রয়েছে জাপানের। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সির (জাইকা) মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহযোগিতা (ওডিএ) হিসেবে বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ বিতরণসহ নানাভাবে বাংলাদেশকে উন্নয়ন সহযোগিতা করে আসছে টোকিও। বর্তমানে বিগ-বির আওতায় সহযোগিতার গতি আরো বেড়েছে।

ইতো নাওকি জাপানের রাষ্ট্রদূত থাকাকালে জাইকার ঋণ বিনিয়োগের বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে জাইকার বৈশ্বিক ঋণ প্রতিশ্রুতির গন্তব্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। জাইকার মোট বৈশ্বিক ঋণ প্রতিশ্রুতির ২৬ দশমিক শতাংশেরই গন্তব্য হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরেও (২০২১-২২) বাংলাদেশকে মোট ১৭৩ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ঋণ অনুদান হিসেবে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দেশটি।

এখন পর্যন্ত দেশে সবচেয়ে বেশি দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা এসেছে জাপান থেকে। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন হয় ১৯৭২ সালে। ওই সময় থেকে পর্যন্ত জাপানের কাছ থেকে ঋণ, অনুদানসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সহায়তা হিসেবে মোট হাজার ৮৭৮ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বাংলাদেশ। শুধু ঋণ হিসেবে প্রতিশ্রুত অর্থ হাজার ৫১৫ কোটি ডলারের সমপরিমাণ। এর মধ্যে গত অর্থবছর পর্যন্ত হাজার ৪৯১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ ছাড় হয়েছে।

বিগ-বির আওতায় গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে জাপান। কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র গভীর সমুদ্রবন্দর, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল মেট্রোরেল নির্মাণের মতো বৃহৎ মেগা প্রকল্পগুলো কর্মসূচির আওতায়ই বাস্তবায়ন হচ্ছে। এছাড়া প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে কানেক্টিভিটি বাড়ানোর তাগিদে গৃহীত সড়ক যোগাযোগ প্রকল্পগুলোয়ও এখন সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী দেশ জাপান।

জাপানের কাছ থেকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত্তিতে পাওয়া ঋণ বাংলাদেশের জন্য তুলনামূলক লাভজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো উন্নয়ন সহযোগী অন্য সব দেশের চেয়ে জাপানের কাছ থেকে নেয়া ঋণের শর্তগুলো তুলনামূলক বেশি শিথিল। আবার প্রদত্ত ঋণের ওপর দেশটির নির্ধারিত সুদের হার তুলনামূলক কম। এসব ঋণ পরিশোধের সময়সীমা ধরা হয় বেশি। আবার সময়সীমা পেরোনোর পর অতিরিক্ত গ্রেস পিরিয়ডের পরিমাণও বেশি।

ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে গত মাসে প্রকাশিত এক পলিসি পেপারে (মার্চ পর্যন্ত হালনাগাদকৃত) উঠে আসে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত্তিতে বাংলাদেশের গৃহীত মোট ঋণে শুধু জাপানেরই অবদান ৪৫ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা রাশিয়ার অবদান ২২ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে রয়েছে চীন। দেশের মোট দ্বিপক্ষীয় ঋণে চীনের অবদান ২১ শতাংশ। সে হিসেবে দেশের মোট দ্বিপক্ষীয় ঋণ পোর্টফোলিওতে তিন দেশের অবদান ৮৫ শতাংশেরও বেশি। দিল্লিভিত্তিক থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ) গত মাসে গেম অব শ্যাডোজ: গ্রোথ, ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড সিস্টেমেটিক শকস ইন দ্য বাংলাদেশ ইকোনমি শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

দ্বিপক্ষীয় ঋণের ক্ষেত্রে জাপানকেই সবচেয়ে সুবিধাজনক উৎস হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালকের ভাষ্যমতে, অন্যান্য ঋণের তুলনায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত্তিতে পাওয়া ঋণ তুলনামূলক বেশি নিরাপদ। আবার সবচেয়ে বেশি নিরাপদ দ্বিপক্ষীয় ঋণ পাওয়া যায় জাপানের কাছ থেকে। বিশেষ করে চীন বা রাশিয়ার কাছ থেকে পাওয়া ঋণের তুলনায় জাপানি ঋণের নিরাপত্তা অনেক বেশি।

তবে বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের অংশীদারত্ব সবসময় একই রকম থাকবে, এমনটা ধরে নেয়া ঠিক হবে না বলে কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছেন ইতো নাওকি। গত ১৪ নভেম্বর ঢাকার একটি হোটেলে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স (সিজিএস) ফ্রেডরিখ এবার্ট স্টিফটুং (এফইএস) আয়োজিত মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ করছে। এখন দুই দেশের সম্পর্ককে উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে দ্বিপক্ষীয় ঋণের অন্যান্য বৃহৎ উৎস দেশের মধ্যে রাশিয়া ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশকে ঋণ, অনুদান অন্যান্য মাধ্যমে মোট হাজার ২৩২ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশেরই ( হাজার ১৩৮ কোটি ডলারের সমপরিমাণ) গন্তব্য হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রয়োজনীয় ঋণ হিসেবে। ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুত ঋণের প্রায় ৪৬৫ কোটি ১৬ লাখ ডলার ছাড় করেছে রাশিয়া।

চীন পর্যন্ত বাংলাদেশকে ঋণ, অনুদান অন্যান্য মাধ্যমে সহযোগিতা হিসেবে হাজার ৭৭ কোটি ডলারের বেশি অর্থ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বর্তমানেও দেশের বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বিনিয়োগ রয়েছে চীনের। ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশকে ৬৪৩ কোটি ৭২ লাখ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ছাড় করেছে দেশটি। এর মধ্যে শুধু ঋণ হিসেবে ছাড় করেছে ৬৩৬ কোটি ডলার।

অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীর মধ্যে ভারত গত অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশকে শুধু ঋণ হিসেবে ছাড় করেছে ১৩৯ কোটি ডলার। দক্ষিণ কোরিয়া বাবদ ছাড় করেছে ১১২ কোটি ডলার।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবিরের মতে, দ্বিপক্ষীয় ঋণের বিষয়টি নির্ভর করে ঋণগ্রহীতা দেশের চাহিদা ঋণদাতার সামর্থ্যের ওপর। আমরা অবকাঠামোগত সহায়তা চাইলে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ তা দিতে পারবে না। কিন্তু জাপান চীন পারবে। তবে ঋণের উৎসে যত বৈচিত্র্য আনা যায়, ততই ভালো। আমাদেরও কূটনৈতিক তত্পরতাকে সে পর্যায়ে নিতে হবে। এজন্য আমাদের কূটনৈতিক সক্ষমতা বাড়াতেই হবে। এক্ষেত্রে আমাদের সৃজনশীল কূটনীতি খুবই প্রয়োজন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন