ঝুঁকিতে জীববৈচিত্র্য

টঙ্গী খাল ও বালু নদে সবচেয়ে বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি

আল ফাতাহ মামুন

রাজধানী ও আশপাশের সব কয়টি ভূগর্ভস্থ পানির উৎসেই রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মিলেছে টঙ্গী খালে ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

দৈনন্দিন কাজে যেসব পণ্য ব্যবহার করা হয় তার সর্বত্রই ছেয়ে আছে প্লাস্টিক। যে টুথপেস্টে দাঁত মাজছে মানুষ তাতেও প্লাস্টিক, শ্যাম্পু-সাবানের মধ্যেও রয়েছে অতিসূক্ষ্ম প্লাস্টিকের বল। মাটি, পানি বা বাতাসের সঙ্গে সহজেই এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক মিশে যাচ্ছে। বৃষ্টি, বন্যা, স্রোতবিভিন্ন উপায়ে এগুলো পুকুর, নদী সমুদ্রে গিয়ে জমা হচ্ছে। উষ্ণতা বাড়ছে। পানিতে আশঙ্কাজনক হারে কমছে অক্সিজেনের পরিমাণ। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের বাস্তুসংস্থান। ধ্বংসের মুখে বহু প্রজাতি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের তিন শিক্ষক সম্প্রতি একটি গবেষণা করেন। তাতে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকা আশপাশের সব কয়টি ভূগর্ভস্থ পানির উৎসেই রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মিলেছে টঙ্গী খাল বালু নদে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঝুঁকি কমাতে পরিবেশসম্মত উপায়ে এর রিসাইকেল নিশ্চিত করা না গেলে ভয়াবহতা দিন দিনই বাড়বে।

রাজধানী এর আশপাশের নিত্যব্যবহার্য প্লাস্টিক বর্জ্য, কলকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য পদার্থে মিশে থাকা প্লাস্টিক প্রতিনিয়ত মিশছে পরিবেশে। তাপমাত্রা, অণুজীব এবং নানা কারণে এগুলো ভেঙে পরিণত হচ্ছে ক্ষুদ্র প্লাস্টিকে। মাছ কিংবা অন্য কোনো প্রাণীর পেট হয়ে সহজেই তা ঢুকে পড়ছে প্রাকৃতিক খাদ্যশৃঙ্খলে। পর্যায়ক্রমে মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করছে মানবদেহে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, যে ১০টি বস্তু মানবদেহে ক্যান্সারের ক্ষেত্রে প্রধানত দায়ী এর মধ্যে প্লাস্টিক প্লাস্টিকজাত দ্রব্যাদি অন্যতম। মাইক্রোপ্লাস্টিক এরই অংশ। এরই মধ্যে দেশের পুঁটি, টেংরা-জাতীয় মাছের পেটে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছে। সে গবেষণাটাও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করা। আমরা অনুমান করছি, মুরগি-পাখিসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর দেহেও এটি পাওয়া যেতে পারে। মাইক্রোপ্লাস্টিক একদিকে ক্যান্সার তৈরি করে, অন্যদিকে এটি হজম না হওয়ায় মানুষের পাকস্থলী পরিপাকতন্ত্রে বিঘ্ন ঘটায়। এটি রক্তে আটকে কিডনি লিভারকেও অকার্যকর করে দিতে পারে। বাতাসে ভাসমান মাইক্রোপ্লাস্টিক নিশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে ফুসফুসেরও ক্ষতি করতে পারে। আমরা দেখছি, বর্তমানে মানুষের অ্যালার্জি-জাতীয় সমস্যা বেড়ে গিয়েছে। আমাদের অনুমান, এজন্য মাইক্রোপ্লাস্টিকই বড় দায়ী।

রাজধানীর নদ-নদী লেকে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পরীক্ষায় দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণাটি চালান জাবির তিন শিক্ষক। প্রতিবেদন আকারে সেটি প্রকাশ করেন গত নভেম্বরে। গবেষক দলের সদস্য অধ্যাপক ফাহমিদা পারভীন জানান, গবেষণায় ঢাকা শহরের পার্শ্ববর্তী চারটি নদী, তিনটি লেক দুটি খালের ১৯টি স্থান থেকে নমুমা সংগ্রহ করা হয়। নদ-নদীগুলো হলো বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ বালু। আর খালের মধ্যে টঙ্গী ডেমরা খাল এবং হাতিরঝিল, ধানমন্ডি গুলশান লেক এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। গবেষণার ফলাফলে দেখা গিয়েছে, প্রতিটি নমুনাতেই ছিল মাইক্রোপ্লাস্টিক। এর মধ্যে ধানমন্ডি লেক, টঙ্গী খাল বালু নদে ক্ষতিকারক ক্ষুদ্র প্লাস্টিকের উপস্থিতি মিলেছে সবচেয়ে বেশি। বিশ্বের অন্যতম দূষিত নদী চীনের সাংহাই এবং ইয়াংঝাংয়ের চেয়েও বেশি পরিমাণে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছে তিন পানির উৎসে।

গবেষণার তথ্যমতে, সাংহাই নদীর তলদেশে জমাকৃত প্রতি কেজি পলিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ ৮০২টি এবং ইয়াংঝাং নদীর পলিতে ২৮৫ পিস। ধানমন্ডি লেকের প্রতি কেজি পলিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছে ৩০ হাজার পিস, টঙ্গী খালে ৬৫ হাজার এবং ২০ হাজার পিস বালু নদে। তবে বুড়িগঙ্গা নদী, গুলশান লেক টঙ্গী খালের ভাসমান পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি আরো বেশি মিলেছে।

গবেষণায় দেখা গিয়েছে, রাজধানীর পানির ভূ-উপরিস্থ উৎসগুলো থেকে ক্রমেই মাইক্রোপ্লাস্টিক তলদেশে গিয়ে জমা হচ্ছে। সেই সঙ্গে নানা উপায়ে তা ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে। এমনকি দেশের অন্যান্য জলাশয়েও মাইক্রোপ্লাস্টিক ভয়ংকর আকার ধারণ করছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। এতে জলজ জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে ঝুঁকি বাড়ছে মানবস্বাস্থ্যেরও।

মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঝুঁকি কমানোর জন্য সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে উল্লেখ করে অধ্যাপক ফাহমিদা পারভীন বণিক বার্তাকে বলেন, প্লাস্টিক বর্জ্যসহ সব ধরনের বর্জ্য উৎস থেকে আলাদা করতে হবে। পাশাপাশি প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইকেলের প্রতি জোর দিতে হবে। এছাড়া মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য সরকারকে নিতে হবে নানা পদক্ষেপ। প্রয়োজনে খাল-নদী উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য ফেলার দায়ে জরিমানা শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

রাজধানী পার্শ্ববর্তী এলাকার পানির উৎসগুলোতে মাইক্রোপ্লাস্টিক বৃদ্ধির কারণ হিসেবে প্রসাধনী শিল্পবর্জ্য ভূমিকা রাখছে বলে মন্তব্য করেছেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মো. এজাজ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ঢাকা শহরে প্রসাধনী ব্যবহারের পরিমাণ অনেক বেশি। বাসাবাড়ির সুয়ারেজ লাইনের পানি পরিশোধন না হওয়ার কারণে এগুলো সহজেই নদী, খাল লেকে চলে যাচ্ছে। বালু নদের পাড়ের প্রচুর কেমিক্যাল কসমেটিক্স কারখানা এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্লাস্টার রয়েছে। সেখানে প্রচুর শিল্প-কারখানার বর্জ্য আসার কারণে মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি হওয়ারই কথা।

বহির্বিশ্বে মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন জলবায়ু পরিবর্তনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে। যদিও এর ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার এখনো তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। দেশের আইনে প্লাস্টিক ব্যবহারের ব্যাপারে কড়াকড়ি থাকলেও তা বাস্তবায়ন করতে না পারা দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, সরকার মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে ভাবছেই না। বিশ্বের অনেক দেশ পলিথিন বন্ধ করলেও আমরা বন্ধ করতে পারিনি। অথচ আমাদের হাতে প্রচুর বিকল্প ছিল। সরকারের এখন উচিত হবে, উচ্চ আদালতের নির্দেশ মেনে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা এবং নদীর পাড়ের এলাকায় সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকপণ্য বহন নিষেধ করা। আর যেগুলো করা যাবে না তাদের নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে আসা জরুরি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সেন্টমার্টিন এলাকায় যেসব চিপসের প্যাকেট বিক্রি হবে, সেগুলো যেন আবার ফেরত আনা যায়। এর সহজ উপায় হলো, চিপসটার যে দাম গ্রাহকের কাছ থেকে তার চেয়ে টাকা বেশি রাখা। প্যাকেট ফেরত দিয়ে অতিরিক্ত সেই টাকাটা নিয়ে যাবে। এভাবে শুধু কালেক্ট করলেই হবে না সেটা রিসাইকেলও করতে হবে।

মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের ব্যাপারে এখনো সচেতন নয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের বৈঠকগুলোতে মাইক্রোপ্লাস্টিক বিষয়টি এখনো খুব একটা আলোচনায় আসছে না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী . মোহাম্মদ সফিউল্লাহ সিদ্দিক ভুঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা মূলত কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে থাকি। সে হিসেবে মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে এখনো বড় কোনো উদ্যোগ আমাদের নেই। তবে বেশ কিছু প্রজেক্ট নিচ্ছি, যেগুলো বাস্তবায়ন করলে প্লাস্টিক দূষণ কমার পাশাপাশি রিসাইকেলও বাড়বে। ফলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঝুঁকিও কমে আসবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন