আলোকপাত

ভোটাররা এখন খেলার মাঠের সমর্থকের রূপ নিয়েছে

কৌশিক বসু

বিশ্ব রাজনৈতিক অঙ্গনের অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাজনৈতিক দার্শনিকরা আজ হিমশিম খাচ্ছেন। রাজনৈতিক মেরুকরণের এমন দৃশ্য এর আগে খুব কমই দেখা গিয়েছে। তুরস্ক থেকে ব্রাজিল, ফিলিপাইন থেকে শ্রীলংকা কিংবা ভারত যুক্তরাষ্ট্রে এখনো মধ্যমপন্থী রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এসব অঞ্চলে জনগণ হয় বামপন্থী না হয় ডানপন্থী রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বেছে নিয়েছে।

উত্তর কোরিয়া চীনের মতো কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোয় জনগণের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক অধিকারসংক্রান্ত দাবি খুব একটা দেখা যায় না। তবে এসব দেশে রাজনীতি যে একেবারে নেই তাও বলা যাবে না। আছে সুপ্ত অবস্থায়। সংকটকালীন সেটা প্রকাশ্যে আসতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে চীনা সরকারের জিরো কভিড নীতির বিরুদ্ধে দেশটিতে সংঘটিত হওয়া ব্যাপক গণবিক্ষোভ এর বাস্তব উদাহরণ। রকম পরিস্থিতিগুলো আমাদের শেখায়, বিপক্ষ দলকে যতটা দুর্বল বা ক্ষুদ্র মনে করা হোক না কেন তারা সে তুলনায় অনেক বড় শক্তিমান।

রাজনৈতিক মেরুকরণ কোনো না কোনোভাবে কর্তৃত্ববাদকে পোষণ করে এবং আত্মপ্রচারে ব্রতী নেতাদের ক্ষমতায়নের পথ খুলে দেয়। এসব বক্তৃতাবাজ নেতা কট্টর জাতীয়তাবাদী চেতনার আড়ালে তাদের সমর্থক বৃদ্ধিতে অত্যন্ত দক্ষ। এর পরিণতি যে মর্মান্তিক তার বাস্তব মঞ্চায়ন ইউক্রেনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আগ্রাসন এবং মিয়ানমারে সংখ্যালঘুর ওপর সামরিক জান্তার দমন-পীড়ন অভিযানের মধ্য দিয়ে।

বিষয়গুলো বৈশ্বিক রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আনার প্রশ্নকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। আইন, অর্থনীতি রাজনৈতিক ক্ষেত্রগুলোকে বিস্তৃত করতে সহায়ক সংশোধনমূলক নীতি গ্রহণে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানায়। যদিও হস্তক্ষেপগুলো কেমন হওয়া উচিত তা স্পষ্ট নয়। এজন্য রাজনৈতিক মেরুকরণের মূলে কী রয়েছে সেটা বুঝতে হলে আমাদের কিছুটা পেছন ফিরে দেখতে হবে।

এক্ষেত্রে কাতারের ফিফা বিশ্বকাপ থেকে পরোক্ষভাবে দারুণ এক ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে। মূলধারার অর্থনীতি আমাদের জানান দেয়, মানুষের লক্ষ্য উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলো বাহ্যিক প্রভাবে গড়ে ওঠে। এর মানে হলো, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে একে অন্যের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। আমরা ভালো খাবার, জামাকাপড়, গাড়ি, ইলেকট্রিক গ্যাজেট ছাড়াও অনেক ভালো কিছু পেতে চাই। যেহেতু এগুলো পাওয়ার জন্য অর্থের প্রয়োজন, তাই স্বাভাবিকভাবেই মানুষ আরো বেশি উপার্জন করতে চায়। আরো বেশি সম্পদ অর্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে, প্রতিযোগিতা করে। পুঁজিবাদের সুপরিচিত সমালোচক মার্কিন অর্থনীতিবিদ সমাজবিজ্ঞানী থোরস্টেইন ভেবলেন থেকে ভোগবাদ মানুষের সুখের প্রকৃতিবিষয়ক বিখ্যাত লেখক এবং মার্কিন অর্থনীতিবিদ টিবর সিটোভস্কি পর্যন্ত বিশিষ্ট দার্শনিকরা একটি বিষয় অনেক আগে থেকেই অনুধাবন করেছিলেন। আর তা হলো, আমাদের অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষা অভ্যন্তরীণভাবে তৈরি হয়। যদিও  ধারণাটি স্বীকৃত নয়। তবে দার্শনিকদের সময়ে জন্ম নেয়ার পরিবর্তে আমরা তাদের ধারণ করে চিন্তাজগতের সঙ্গেই পথ চলছি।

খেলাধুলা এর একটি চমত্কার উদাহরণ। পেশাদার ফুটবলাররা যখন সফলতা পায় তখন তাদের আর্থিক পুরস্কার দেয়া হয়। তবে তারা আর্থিক পুরস্কারের আশা ছাড়াই যতটা সম্ভব ম্যাচ জিততে চেষ্টা করে। গোল করাটাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকে। এখন যদি কেউ বিশ্বাস করে, অধিক অর্থপ্রাপ্তির আশা কিছু খেলোয়াড়কে সীমাবদ্ধতার দিকে ঠেলে দেয়, তখন ভক্ত-সমর্থকদের অবস্থা কী হবে? যারা দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে দীর্ঘ সময় অর্থ ব্যয় করে খেলা দেখতে যায়। সমর্থিত দলের জয় দেখাই যাদের একমাত্র লক্ষ্য আকাঙ্ক্ষা।

সম্প্রতি ভারতে ব্রাজিল আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হওয়ার পর দেখা গিয়েছে, ভক্তরা কতদূর যেতে প্রস্তুত। এরা ছিল সাধারণ ভারতীয়। কোনো দেশের সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। তবু তারা এসব দলের সমর্থন নিয়ে বিবাদে জড়ায়। সমর্থিত দলের জন্য সংঘাতে জড়িয়ে নিজেদের নিরাপত্তাঝুঁকিতে ফেলতেও তারা প্রস্তুত। যদি অন্য কিছু না হয়, তবে ফুটবল সমর্থন নিয়ে দ্বন্দ্ব-বিবাদ হলো রাজনৈতিক মেরুকরণের আরেকটি প্রদর্শনী।

বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করে সেটা বোঝাতে দীর্ঘকাল চলে আসা ভোটের রাজনীতির সংস্কৃতিকে স্মরণ করা যেতে পারে। মার্কিন গণিতবিদ হ্যারল্ড হটেলিংয়ের ১৯২৯ সালের প্রজনন সম্পর্কিত গবেষণাপত্রটি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। গবেষণাটি আমাদের গণতান্ত্রিক ভোটের রাজনীতি বুঝতে গভীরভাবে প্রভাবিত করে, যা ডানকান ব্লেইক অ্যান্থনি ডাউনস কর্তৃক প্রণীত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাবশালীমেডিয়ান ভোটার থিওরিবা মধ্যমপন্থী ভোটার তত্ত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। হটেলিং তার দর্শনে অনুপ্রাণিত তাত্ত্বিকদের মতে, আপনি যদি ধরে নেন, উগ্র বামপন্থী থেকে উগ্র ডানপন্থী পর্যন্ত সব রাজনৈতিক-পছন্দ মানুষ বাহ্যিকভাবে প্রভাবিত হয়ে নির্ধারণ করে, তাহলে সহজেই দেখা যাবে রাজনৈতিক দল দুটি সর্বাধিক ভোট পেতে কী কী কৌশল করতে পারে। ডানপন্থী দল তখন কিছু বিষয়ে বামপন্থী দলের নীতি গ্রহণ করে ভোটার টানার চেষ্টা করবে। কেননা তারা জানে, ডানপন্থী ভোটাররা এগুলো সমর্থন করবে। আবার বামপন্থী দলগুলোও অন্যদিক থেকে একই কাজ করবে।

তাত্ত্বিকভাবে দলগুলোর মাঝখানে তখন মধ্যমপন্থী ভোটার বাড়তে থাকে। মধ্যমপন্থী সংজ্ঞায় সেখানে অর্ধেক বামপন্থী অর্ধেক ডানপন্থী ভোটার অবস্থান করেন। এজন্য ভোটের রাজনীতিতে জিততে রাজনৈতিক দলগুলোকে মধ্যমপন্থী ভোটারদের সন্তুষ্ট করতে হয়। এটি এমন একটি প্রবণতা, যা দেশকে বড় ধরনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এনে দেয়, এমনকি রাজনৈতিক উত্তেজনাকেও নিস্তেজ করে দেয়।

কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোর রাজনৈতিক প্রবণতা থেকে বোঝা যায়, ভোটারদের আদর্শগত পছন্দগুলো বাহ্যিক প্রভাবে নয় বরং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়েই গড়ে উঠেছে। একজন ভোটার ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকানদের সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেয়ার পরে তার দলীয় প্রতিশ্রুতি ধীরে ধীরে ক্রীড়াপ্রেমী সমর্থকদের চরিত্র ধারণ করে। রিপাবলিকান ভোটাররা চায় রিপাবলিকানরা জিতুক, আর ডেমোক্র্যাটরা চায় ডেমোক্র্যাটরা জিতুক। কেননা সমর্থকরা মৌলিক কোনো পরিবর্তন জীবনে প্রত্যাশা করেন না। তারা শুধু অন্য পক্ষকে পরাজিত করতে চান। ফুটবল খেলার মতো যে করেই হোক গোল করাই যেন মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে।

তাই অভ্যন্তরীণ কারণে মানুষের পছন্দ-অপছন্দ নির্ধারণ হয় বক্তব্যকে স্বীকৃতি দিলে রাজনীতি রাজনৈতিক মেরুকরণের বিষয়টি বিশ্লেষণের নতুন দ্বার উন্মোচন হতে পারে। এর মধ্যে আরেকটি বিষয়, রাজনৈতিক দলগুলো কেবল পূর্ব-পরীক্ষিত ভোটারের সমর্থন নিয়েই পড়ে থাকে না। ভিন্ন কৌশলে নতুন ভোটারের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে। যেমনটি আমরা দেখে আসছি, রকম পদক্ষেপ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে নিকৃষ্ট পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার ভয়াবহ ফাঁদের যুগে যেখানে ফিল্টারিংয়ের মাধ্যমে প্রকৃত সংবাদ পাঠকের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য তৈরি করা হয়। পক্ষপাতমূলক সমর্থন আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়াকে বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়।

ফাঁদ থেকে বাঁচতে সম্ভবত অভিনব কোনো নীতি গ্রহণের প্রয়োজন হবে। তবে এর সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক সমাধানগুলো এখনো স্পষ্ট নয়। ভোটারদের সমর্থন নিয়ন্ত্রণেরও কোনো উপায় জানা নেই। এজন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সামাজিক কাঠামো টিকিয়ে রাখতে কী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন সে ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে হবে।

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ২০২২]

 

কৌশিক বসু: কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের অনাবাসিক জ্যেষ্ঠ ফেলো। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং ভারত সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা

ভাষান্তর: আল আমিন হাওলাদার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন