ব্যাংক খাতে সংকটের প্রভাব ভোগ্যপণ্যের বাজারে

সুজিত সাহা, চট্টগ্রাম ব্যুরো

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে ঋণ জালিয়াতি, তারল্য সংকট, টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারাসহ নানা অস্থিরতা বিরাজ করছে। ব্যাংক খাতের পরিস্থিতির প্রভাব পড়েছে ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজারেও। বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম কমার পাশাপাশি দেশীয় সংকটের মধ্যে পাইকারি পর্যায়ে সরবরাহ আদেশ (এসও) ক্রয়-বিক্রয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। গত এক সপ্তাহে পাইকারি পর্যায়ে সব ধরনের এসওর দাম কমেছে।

দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ। এখানকার আমদানিকারক, ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান ব্রোকার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বেঁধে দেয়া দামের ওপর সারা দেশের পণ্যমূল্য ওঠানামা করে। প্রধান প্রধান ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারকদের ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনজনিত গুজবের কারণে বিক্রি হওয়া এসওর দাম কমছে। শীর্ষ আমদানিকারকদের অনেকেই এসও সরবরাহের পরও পর্যাপ্ত ঋণপত্র খুলতে না পারার খবরে ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান ব্রোকারদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, টিকে কিংবা মেঘনা গ্রুপের বিক্রি করা ভোগ্যপণ্য ভবিষ্যতে সরবরাহ করা সম্ভব হবে কিনা আতঙ্কে পণ্যের দাম কমছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

এদিকে দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও ভোগ্যপণ্যের দাম কমতির দিকে। দু-একটি ছাড়া প্রধান প্রধান ভোগ্যপণ্যের দাম ২০২০ সালের চেয়েও কমে লেনদেন হচ্ছে। যদিও দেশে ডলারের ঊর্ধ্বমুখী দাম, আমদানি সংকট, বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন সংকটে পণ্যের আশানুরূপ দাম কমেনি। পাইকারি বাজারে ট্রেডিং পর্যায়ে দাম কমলেও খুচরা বাজারে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ভোগ্যপণ্যের দাম।

খাতুনগঞ্জের একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনজনিত গুজব আমদানি সংকটের বিষয়টি দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক গ্রুপের পণ্য লেনদেনে সংকট তৈরি করেছে। আমদানিকারকরা অনেক আগেই বাজারে এসও বিক্রি করে দেয়ায় ভবিষ্যতে মিলগেট থেকে পণ্য উত্তোলন করা যাবে কিনা সংশয়ে পাইকারি পণ্যের দাম নিম্নমুখী হয়েছে, যার কারণে এক সপ্তাহ ধরে পাইকারি বাজারে বিক্রি হওয়া এসওর বিপরীতে স্লিপ সংগ্রহ করে বড় আকারের লোকসান দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পাইকারি পর্যায়ে এসও কিংবা স্লিপ বিক্রির পরিমাণ কমে গিয়েছে অস্বাভাবিক হারে। এসও কিংবা স্লিপ বিক্রির হার কমে গেলে দেশের প্রান্তিক অঞ্চলে পণ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার ম্যানেজার রঞ্জন বড়ুয়া বলেন, দেশের ব্যাংক খাত ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সংকটের মুখে রয়েছে। ঋণপত্র খুলতে না পারার কারণে পণ্যবাজারে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহ পর্যাপ্ত মজুদের মাধ্যমে পণ্যের দাম নির্ধারিত হয় বলে এসব সংবাদ বাজারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাত নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মুখে ব্যবসায়ীরা সতর্ক অবস্থায় লেনদেন করছেন বলেও মনে করছেন তিনি।

শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডের (সিবিওটি) তথ্যমতে, বিশ্ববাজারে ২০২০ সালে থাইল্যান্ডের চালের টনপ্রতি গড় দাম ছিল মানভেদে ৪৯৬ দশমিক , ৪৮১ দশমিক ৪৭৪ দশমিক ডলার। সর্বশেষ অক্টোবরে একই মানের চালের দাম নেমে এসেছে যথাক্রমে ৪৩১ ডলার, ৪২০ ৪১১ দশমিক ডলারে। ভিয়েতনামের চালের দাম ২০২০ সালে ৪২৮ ডলারে লেনদেন হলেও সর্বশেষ অক্টোবরে লেনদেন হয়েছে গড়ে ৪০৯ দশমিক ডলারে। অন্যদিকে ২০২০ সালে বিশ্ববাজারে পাম অয়েলের দাম ছিল টনপ্রতি ৭৫২ ডলার, ২০২১ সালে হাজার ১৩১ ডলার। সর্বশেষ অক্টোবরে পাম অয়েলের দাম ছিল ২০২০ সালের প্রায় কাছাকাছি, অর্থাৎ ৮৮৯ ডলার। ২০২০ সালে অপরিশোধিত সয়াবিনের দাম ছিল টনপ্রতি ৮৩৮ ডলার। ২০২১ সালে তা উঠে যায় হাজার ৩৮৫ ডলারে। যদিও সর্বশেষ অক্টোবরে বিশ্ববাজারে গড়ে সয়াবিন বিক্রি হয়েছে হাজার ৫৭৬ ডলারে। ২০২২ সালের শুরুতে সয়াবিনের দামে স্মরণকালের রেকর্ড হাজার ডলারে উঠেছিল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে গমের দাম বাড়তি অবস্থায় স্থির রয়েছে। ২০২০ সালে বিশ্ববাজারে গমের টনপ্রতি দাম ছিল ২৩১ দশমিক ডলার। ২০২১ সালে তা বেড়ে ৩১৫ দশমিক ডলার এবং সর্বশেষ অক্টোবরে গমের দাম আরো বেড়ে ৪৩৮ ডলারে লেনদেন হয়। গম চিনি ছাড়া বর্তমানে বিশ্ববাজারে কোনো ভোগ্যপণ্য ঊর্ধ্বমুখী না থাকলেও দেশীয় নানা পরিস্থিতির কারণে ভোক্তারা ন্যায্যমূল্যে পণ্য পাচ্ছে না।

নাম প্রকাশ না করে খাতুনগঞ্জের একাধিক ব্রোকার (এসও ব্যবসায়ী) বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যাংক খাত নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনায় বিশেষ বিশেষ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে ব্যবসায়ীরা দ্বিধায় রয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ঋণপত্র খুলতে না পারার ঘটনায় অগ্রিম পণ্য বিক্রির এসও সরবরাহ কমে গিয়েছে। কারণে চিনি, ভোজ্যতেল-জাতীয় পণ্যের এসও, স্লিপের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে অস্বাভাবিকভাবে কমেছে। কারণে ওইসব পণ্য নতুন করে কেনাবেচাও কমেছে।

পাইকারি বাজার সূত্রে জানা গিয়েছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাম অয়েল, সয়াবিন, চিনিসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম মণপ্রতি ২০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। পাইকারি বাজারে এসও পর্যায়ে দাম কমলেও সরাসরি মিলগেট থেকে উত্তোলনযোগ্য পণ্যের দাম সেভাবে কমেনি। কারণে নতুন করে এসও সংগ্রহ কিংবা অগ্রিম পণ্য কেনা কমেছে।

সিটি গ্রুপের চট্টগ্রাম ভোজ্যতেল পরিশোধন সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত উপমহাব্যবস্থাপক প্রদীপ কারন বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, সরকার ভোজ্যতেলের নতুন দর নির্ধারণ করলেও পাইকারি বাজার নিম্নমুখী, যার কারণে যেসব প্রতিষ্ঠান এসও কিনেছে তারা চাহিদা থাকলেও লোকসান এড়াতে মিল থেকে পণ্য তুলছে না। মিলগুলোর পর্যাপ্ত পণ্য মজুদ পরিশোধন সক্ষমতা থাকলেও পাইকারি বাজারের নিম্নমুখী প্রবণতা পণ্যবাজারকে নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি করেছে। 

খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ ছগীর আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, খাতুনগঞ্জের বাণিজ্য বিশ্ববাজারের কমোডিটি একচেঞ্জ, দেশীয় আমদানি, সরবরাহ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কারণে ওঠানামা করে। আবার পাইকারি বাজারে দাম ওঠানামার সঙ্গে খুচরা বাজারে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাবও পড়ে না। সকাল-বিকাল দাম ওঠানামা করলেও খুচরায় সরকারি বেঁধে দেয়া দাম মোড়কজাতকারী প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত দামই কার্যকর থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশীয় পরিস্থিতিতে শীর্ষ গ্রুপগুলোর আমদানি কমে যাওয়া, ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ট্রেডিং পর্যায়ে দামের নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এতে ট্রেডাররা বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছে বলে স্বীকার করেছেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন