সিলেটের প্রায় শতবর্ষী সরকারি দুগ্ধ খামারটি ধুঁকছে নানা সমস্যায়

নূর আহমদ, সিলেট

সিলেট জেলা দুগ্ধ খামারে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় ঘাস উৎপাদন নিয়ে ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

দেশে গরুর জাত উন্নয়নে ১৯৩০ সালে টিলাগড়ে ৭০০ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা হয় সিলেটের একমাত্র সরকারি দুগ্ধ খামার। কিন্তু এত বড় একটি দুগ্ধ খামারের কার্যক্রম চলছে মাত্র ২৫ শতাংশ জনবল দিয়ে। খামারের জন্য অনুমোদিত ৪৭টি পদের বিপরীতে ৩৪টি পদই শূন্য রয়েছে। ১৩ জনকে কর্মরত দেখালেও আরো সাতজনকে প্রেষণে বিভিন্ন স্থানে বদলি করা হয়েছে। অর্থাৎ রাজস্ব খাতের একজন উপপরিচালক এবং পাঁচজন কর্মচারীর বাইরে দৈনিক হাজিরাভিত্তিক ২৪ জন কর্মচারীই খামারটির একমাত্র ভরসা। পর্যাপ্ত জনবল ছাড়াও সীমানাপ্রাচীর না থাকা, ঘাস উৎপাদনের পানির অপ্রতুলতাসহ নানা সমস্যায় ভুগছে খামারটি। ফলে মিলছে না দুগ্ধ উৎপাদন কিংবা গরুর জাত উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত সুফল।

খামারসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাড়ে চারশ গবাদিপশু পালনের সুযোগ থাকলেও রহস্যজনক কারণে খামারে গবাদিপশুর সংখ্যা বাড়েনি। এমনকি জাত উন্নয়নেও উল্লেখ্যযোগ্য কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। বতর্মানে ২৩৬টি গবাদিপশু পালন করা হচ্ছে সিলেট জেলা দুগ্ধ খামারে। বিগত ৪০ বছরে খামারে কোনো ফিমেল লাইনের জিন সংগ্রহ করা হয়নি। জিন হায়ারিংয়েরও কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি।

সরেজমিনে জেলা দুগ্ধ খামার ঘুরে দেখা গেছে, পুরনো জরাজীর্ণ বাংলো টাইপের ঘরে চলছে দাপ্তরিক কার্যক্রম। গরুর শেডগুলোও বেশ পুরনো। তবে ইউএনডিপির অর্থায়নে নতুন দুটি শেডের নির্মাণকাজ চলছে। বয়সভেদে গবাদিপশুগুলোকে আলাদা শেডে রাখা হলেও সীমানাপ্রাচীর না থাকায় তা অরক্ষিত। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় ঘাস উৎপাদন নিয়ে। গভীর নলকূপ না থাকায় ছড়ার পানি দিয়ে ঘাস উৎপাদন করায় খরা মৌসুমে প্রবল সংকটে পড়ে খামারটি।

এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির প্রধান সমস্যা জনবল ঘাটতি। অনুমোদিত রাজস্ব খাতের ৪৭টি পদ রয়েছে। তার মধ্যে উপপরিচালক একজন ডেইরি অ্যাটেন্ডেন্ট, একজন মিল্কম্যান, দুজন স্টোর অ্যাটেন্ডেন্ট একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ছাড়া ৩৪টি পদই শূন্য রয়েছে। কাগজপত্রে ১৩ জনকে কর্মরত দেখালেও সাতজনকে প্রেষণে বিভিন্ন স্থানে বদলি করা হয়েছে। এছাড়া দৈনিক হাজিরাভিত্তিক অনুমোদিত ৩২টি পদের মধ্যে ২৪ জন কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। সাতটি পদ শূন্য রয়েছে। একজনকে বিভাগীয় অফিসে প্রেষণে বদলি করা হয়েছে।

খামারে কথা হয় দৈনিক হাজিরাভিত্তিক কাজে নিয়োজিত আব্দুল মান্নান নামে বয়োবৃদ্ধ এক কর্মচারীর সঙ্গে। ২৮ বছর ধরে খামারে কাজ করছেন তিনি। আব্দুল মান্নান জানান, পরিত্যক্ত ভবনে অবস্থান করলেও কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না তিনি। আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, চাকরি ছেড়ে যাওয়ার সময় চলে এসেছে, এখনো চাকরিটি সরকারি হয়নি।

১৮ বছর ধরে কর্মরত রয়েছেন আরেক কর্মচারী ইকবাল আহমদ। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন থাকার কারণে পশুর জন্য মায়া হয়ে গেছে, তাই চাকরি ছেড়ে যেতে পারি না। যা বেতন পাই তা দিয়ে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করতে পারি।

সিলেট জেলা দুগ্ধ খামার থেকে প্রতিদিন প্রায় চারশ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। যার ১৩৫ লিটার বাছুর পান করে। বাকি দুধ গ্রাহকদের মধ্যে বিক্রি করা হয়। যদিও দুধ বিক্রি নিয়েও অনিয়মের নানা অভিযোগ রয়েছে।

হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ আউশকান্দি এলাকার শুকুর মিয়া সিলেট জেলা দুগ্ধ খামারের রাজস্ব খাতের কর্মচারী। তিনি বলেন, চাকরি সরকারি হলে কী হবে, থাকা-খাওয়ার অবস্থা খুবই খারাপ। আবাসন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এখানে অনেকটা মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে।

জেলা দুগ্ধ খামার, সিলেটের বর্তমান উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. শহিদুল ইসলাম জানান, খামারের ১২০০ কার্ডধারী গ্রাহক রয়েছেন। প্রতিদিন উপস্থিত গ্রাহকদের প্রত্যেককে আধা লিটার করে দুধ দেয়া হয় ৫০ টাকা লিটার দরে। কোনো কোনো দিন উৎপাদিত দুধের চেয়ে অতিরিক্ত গ্রাহক উপস্থিত হলে লটারি করে দুধ বিক্রি করা হয়।

তিনি জানান, হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান গাভি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুধ উৎপাদনকারী গাভি। বিশ্বের মোট উৎপাদিত দুধের প্রায় ৫০ শতাংশ হোলস্টাইন থেকেই উৎপাদিত হয়। সিলেট দুগ্ধ খামারে হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান জাত উন্নয়নে কাজ চলছে। সফলতাও পাওয়া যাচ্ছে।

প্রত্যাশার কথা জানিয়ে এই কৃষিবিদ বলেন, মাত্র ২৫ শতাংশ জনবল নিয়ে সিলেট দুগ্ধ খামার চলছে। অনেকটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম খামারটিকে মূল কাজে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলছে। জাত উন্নয়নেও কাজ চলছে। সরকারের দিক থেকে সহযোগিতা পেলে খামারকে জাত উন্নয়নের মডেল প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপ দেয়া সম্ভব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন