আলোকপাত

আইএমএফের ঋণ ও দেশের ব্যাংক খাতের সংস্কার

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

বিশ্বজুড়েই কভিড-১৯-এর পর যে আঘাত এসেছে, সেটা মোটামুটি অন্য দেশের মতো বাংলাদেশও কাটিয়ে উঠছিল; কিন্তু অর্থনীতির গতি হয়েছে ধীর। তারপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়েছে। মাঝখানে চালসহ অন্যান্য পণ্যের দাম আনপ্রেডিক্টেবল হয়ে গিয়েছে। পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, যা সাধারণ কোনো বিষয় নয়।

বাংলাদেশের অর্থ ব্যবস্থাও নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে, যার শুরু কভিডের আগে থেকেই। তবে কভিড রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ একে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থনৈতিক সংকট শুধু বৈদেশিক কারণে সৃষ্টি হয়েছে তা নয়; দেশের অভ্যন্তরীণ কারণও কম দায়ী নয়, যা বহু আগে থেকেই ছিল। ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব, জবাবদিহিতা স্বচ্ছতার ঘাটতি, সরকারি ব্যয়ের স্বচ্ছতার অভাব, সরকারি ট্যাক্স আদায়ে দুর্বলতা ইত্যাদি কারণ ছিলই। বড় কোম্পানিকে সহায়তা, ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোগকে ভিন্ন চোখে দেখার নীতি এখনো বহাল রয়েছে। কৃষি খাতও অবহেলিত। সবকিছু ছাপিয়ে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উচ্চ মূল্যস্ফীতি। সরকারি হিসাবেই এটি শতাংশ। বাজার পরিস্থিতি বলছে, হার আরো বেশি। 

ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। সাত-আট লাখ মানুষ এরই মধ্যে বিদেশে গিয়েছে, কিন্তু রেমিট্যান্স আশানুরূপ আসছে না। এটা খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার। ফলে অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। অভ্যন্তরীণ সম্পদও সীমিত, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর আহরণও বাড়াতে পারেনি। সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনাও দুর্বল হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছে না। পাশাপাশি কর্মসংস্থান কমে গিয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কমে গিয়েছে, সামাজিক জীবনে বিশেষ করে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এখন আমাদের দরকার কীভাবে আমরা সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি, তার একটি সঠিক রোডম্যাপ। প্রসঙ্গে আসছে বৈদেশিক রিজার্ভ কীভাবে বাড়ানো যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। বিলাসপণ্য আমদানিতে কঠোরতা আরোপ। কিন্তু ডলারের মূল্য নির্ধারণ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আমদানির ক্ষেত্রে এক রকম আবার রফতানিতে আরেক রকম দাম, রেমিট্যান্সে আবার অন্য রকম। একাধিক রেট মানুষকে দ্বিধান্বিত করে। এর কিন্তু সুফল আমরা দেখতে পাচ্ছি না।   

বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মূল বিষয় হলো প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। কারণেই বেশির ভাগ সংকটের শুরু। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে হবে। ৪৫০ কোটি ডলার দিতে এসে তারা নানা শর্ত যুক্ত করছে। কিছু ব্যবস্থা নেয়ার কথা অনেক আগে থেকেই আমরা বলে আসছিলাম। কিছু শর্ত আছে যা বাংলাদেশের জন্য মুহূর্তে বাস্তবায়ন কঠিন। তারা দেশের আর্থিক খাতে কিছু সংস্কারের কথা বলেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, দেশের আর্থিক খাতের যে অবস্থা এটা অন্যান্য ঋণদাতা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে ভুল বার্তা দেয়। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বা জাইকার কাছে সরকার অর্থ চাইবে তারাও জানতে চাইবে বাংলাদেশের কী কী ইতিবাচক বার্তা রয়েছে আর কী কী চ্যালেঞ্জ। তারা মূল্যায়নের জন্য মিশন পাঠাবে। সবাই আর্থিক খাতে সংস্কার, এনবিআরের ট্যাক্স বাড়ানোর কথা বলছেন। এসবের পরও আমাদের অর্থনীতিতে কিছু ভঙ্গুরতা বিদ্যমান। এগুলো প্রধানত প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। মুদ্রাপাচার জবাবদিহিতার অভাব আরো দুটি বড় সংকট। সংস্কার আইএমএফ বলুক বা না বলুক একান্তভাবে করা দরকার। সমস্যাগুলো এত বড় হতো না, যদি আগে থেকেই সংস্কার করা হতো। আগে আমরা এগুলো পাশ কাটিয়ে এসেছি। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে পলিসিমেকারদের অস্বীকার করার প্রবণতা। আমলাদের মধ্যেও সংকটকে অস্বীকার করার প্রবণতা বিদ্যমান। কয়েকদিন আগেও বলা হলো, রিজার্ভ সমস্যা মিটে গিয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, জানুয়ারির মধ্যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে তারা বলছেন, তার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন না।

সংকট সমাধানে দ্রুত কিছু দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণগুলো মোটামুটি সবার জানা। কিন্তু কার্যকর যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। সেখানে কতগুলো মাইলস্টোন থাকতে হবে। আমরা এটা করব, তার পরের ধাপে এটা করব, এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। ২০২৬ সালে আইএমএফের ঋণের শেষ কিস্তির অর্থ মিলবে, তার আগেই সংস্কার কার্যক্রম শেষ করতে হবে। আইএমএফের ঋণের প্রক্রিয়াটি কেবল শুরু হয়েছে। এরপর সেটি তাদের বোর্ডে পাস হবে। তারা দেশে আসবে শর্ত পালন হচ্ছে কিনা, সেটি তদারক করবে। 

প্রথম সংস্কার আনতে হবে ব্যাংক খাতে। এক্ষেত্রে ব্যাংক খাতকে শৃঙ্খলায় আনা, ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধন, সুদের হার বাজারের হাতে ছেড়ে দেয়া, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ব্যাংকের বোর্ডকে ব্যবস্থাপনা থেকে পৃথক করতে হবে। ব্যাংক পরিচালনায় চেয়ারম্যান বোর্ড সদস্যদের ভূমিকা কী হবে, তা নির্ধারণ করতে হবে। ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ কর্মকর্তাদের সঠিকভাবে কাজ করতে দিতে হবে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মনিটরিং, অডিটকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে হবে।

যেসব ব্যাংক খারাপ পারফরম্যান্স করছে সেগুলো একেবারে বন্ধ করে দিতে বলছি না, কিন্তু দৃশ্যমান ব্যবস্থা তো নিতে হবে। উন্নতি করতে হবে। খেলাপি ঋণের বিষয়টি আবারো শিথিল করা হয়েছে। নতুন নিয়মে বলা হয়েছে পুরো খেলাপি ঋণের ব্যবস্থাপনা ব্যাংকগুলো নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারবে। বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ সমসাময়িক যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকের পারফরম্যান্স নিয়ে আমানতকারীদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। সুযোগে সুযোগসন্ধানীরা বিভিন্ন গুজব ছড়াচ্ছে। এটি বন্ধে শুধু নির্দেশনা দিলেই হবে না। তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি গুজব সৃষ্টি হতে না পারে সেজন্য ব্যাংকের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। অ্যাডহক ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়া বদলাতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মুদ্রানীতি। আগে এটি ছয় মাস অন্তর ঘোষণা করা হলেও এবার সেটি এক বছরের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে। আইএমএফ বলছে, তিন মাস অন্তর মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যুক্তি দেখিয়েছে অর্থনীতির তথ্য তারা পান না। বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। আর মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রতি মাসেই আসার কথা। ব্যবসার ক্ষেত্রে রফতানির হিসাব প্রতি সপ্তাহেই চলে আসে। মেজর ইন্ডিকেটরগুলোর তথ্য আমরা নির্ধারিত সময়ে পাই। অতএব হালনাগাদ তথ্য পাই না বলে মুদ্রানীতির ঘোষণার সময় প্রলম্বিত করার কোনো যুক্তি নেই। 

এবার আসা যাক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায়। আমাদের আরইই এখনো অনেক বেশি। পাশের দেশ ভারত, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডও মুদ্রার মান স্থিতিশীল রাখতে সংগ্রাম করছে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে টাকার মান ধরে রেখেছে, কোনো অবমূল্যায়ন করেনি। অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে এসে সেখানে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। আগে থেকেই যদি আমাদের মুদ্রা অবমূল্যায়ন করা হতো তাহলে আজ একেবারে এত বড় ধাক্কা লাগত না। এতে রফতানিকারক আমদানিকারক উভয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। রেমিট্যান্স প্রেরণকারীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আইএমএফ বলছে মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের হাতে ছেড়ে দিতে। হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত না নিয়ে ধীরে ধীরে বাজার নিয়ন্ত্রিত মুদ্রা বিনিময় হারে আমাদের যেতে হবে।

এবার আসি ব্যাংকের সুদের হারের ক্যাপ প্রসঙ্গে। করোনার আগে থেকে বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলে সুদের হার - শতাংশে বেঁধে রাখা হয়েছে। শতাংশ মূল্যস্ফীতিতেও এটি উঠিয়ে নেয়া হয়নি। আইএমএফ বলছে সুদের হার নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের হাতে ছেড়ে দিতে। সংস্কারটি দ্রুতই করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে হঠাৎ করে ক্যাপ তুলে না দিয়ে ধীরে ধীরে বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সুদের হার নির্ধারণ করা উচিত এবং সেটি বাজারের হাতে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর তদারকি বজায় রাখতে হবে যাতে কেউ অধিক সুদে অর্থ সংগ্রহ ঋণ প্রদান করতে না পারে। তবে সেটি অবশ্যই বাজার অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।  আইএফএম জাতীয় সঞ্চয় সার্টিফিকেটের সুদের হার কমাতে বলেছে। এটির পক্ষে আমি নই। কারণ আমাদের দুর্বল সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের মধ্যে মধ্যবিত্তরা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। তাদের রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্র পালন করছে না। ফলে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর সময় এখনো আসেনি। 

 

. সালেহউদ্দিন আহমেদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন