২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানির অর্থ দেশে আসেনি

তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নিক কেন্দ্রীয় ব্যাংক

কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত তিন দিনব্যাপী কনফারেন্সের উদ্বোধনীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আমদানি রফতানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে বলে জানালেন। ওভার আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের কারণে কিছু এলসি স্থগিতও করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন অবস্থাতেই গতকাল বণিক বার্তার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে হোম টেক্সটাইলের ৫৮, পোশাকের ২৩ চামড়ার ৪১ শতাংশ রফতানির অর্থ দেশে আসেনি। বিশেষজ্ঞরা একে তথ্যের গরমিল অথবা রফতানির আড়ালে অর্থ পাচার হয়েছে বলে সন্দেহ করছেন। এমন এক সময়ে তথ্য প্রকাশ হলো যখন ডলারের স্বল্পতায় ভুগছে বাংলাদেশ। রফতানির চেয়ে আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ায় রিজার্ভ থেকে অর্থ জোগাতে হচ্ছে। আর এতেই রিজার্ভের পতন ঘটছে, যা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রফতানির সমপরিমাণ অর্থ দেশে না আসার পেছনের প্রকৃত কারণ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এর সঙ্গে অর্থ পাচারের কোনো যোগসাজশ থাকলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে আগামীতে এমন প্রবণতা বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তদারকি আরো বাড়াতে হবে।

রফতানি আয় কম আসার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ অর্থ পাচার। সাধারণত আমদানি-রফতানির আড়ালে অর্থ পাচার হয় বেশি। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) এবং রফতানির ক্ষেত্রে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং) অর্থ পাচারের অন্যতম কৌশল। এছাড়া ভুয়া রফতানি এলসি এবং ক্রয়চুক্তির মাধ্যমেও অর্থ পাচার হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নজরদারি তদন্ত প্রক্রিয়া জোরদার প্রয়োজন। পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার কাজটি যেহেতু অপেক্ষাকৃত জটিল, সেহেতু পাচার রোধের বিষয়টিতে জোর দেয়া উচিত সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে -সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য বিদেশে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। সর্বাগ্রে প্রয়োজন সঠিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নে রফতানি আয়ের পরিপূর্ণ যথাযথ তথ্য নিশ্চিত করা। রফতানি আয় প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশকিছু নিয়ম, শর্ত নির্দেশনা রয়েছে। বিদ্যমান নিয়মে রফতানি পণ্য জাহাজীকরণের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্থ দেশে আনতে হয়। কারো অর্থ না এলে তিনি নগদ সহায়তা ব্যাংকিং সুবিধা পান না। কিন্তু নিয়মটি খুব বেশি কড়াকড়ি করে অনুসরণ করা হয় না। তাছাড়া রফতানির আড়ালে দেশ থেকে অর্থ পাচার প্রতিরোধে রফতানি পণ্যবাহী যানগুলো ট্র্যাকিং স্ক্রিনিং জোরদার করতে হবে। রফতানি পণ্য পাঠাতে ব্যবহূত জাহাজ কনটেইনারের ওপর বিশেষ নজর দিতে বৈদেশিক লেনদেনে জড়িত অনুমোদিত ডিলার (এডি) ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন সময়ে নির্দেশনা দেয়া হয়। এগুলোর সঠিক পরিপালনে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি জোরদার করতে হবে। নিয়মিতভাবেই রফতানির উদ্দেশ্যে জাহাজীকৃত পণ্যের পরিসংখ্যান প্রকাশ করে ইপিবি। আর সে রফতানির বিপরীতে আয় প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাণিজ্য খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, বাণিজ্য বিরোধের প্রেক্ষাপটে মূল্যহ্রাসের কারণে দুই পরিসংখ্যানে পার্থক্য থাকতেই পারে। সেক্ষেত্রে রফতানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থের পরিমাণও কম হতে পারে। তবে তা কোনোভাবেই ১০ শতাংশের বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। আবার অর্থ পরিশোধের সময়সীমাও বাড়তে পারে। তবে তা নির্ধারিত সময়ে সমন্বয় হয়ে যায়। সব মিলিয়ে রফতানির বিপরীতে অর্থপ্রাপ্তির পার্থক্য খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। এক্ষেত্রে অর্থ পাচারসহ অনৈতিক ব্যবসায়িক চর্চা বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে বলে স্বীকার করে নিলেও ব্যবসায়ীরা বলছেন, রফতানি হওয়া পণ্য এবং সেগুলোর বিপরীতে প্রাপ্ত অর্থের পার্থক্য হওয়ার কারণ হলো অনেক সময়েই দেখা যায়, জাহাজীকরণের পরও ক্রেতাপক্ষ ডিসকাউন্ট চেয়েছে। বিধান আছে ১০ শতাংশের বেশি ডিসকাউন্ট করা যাবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, রফতানিকারকদের দরকষাকষির সক্ষমতায় ঘাটতির কারণে ডিসকাউন্টের হার অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া সঠিক সময়ে পণ্য না দেয়ার কারণে বা মান যথাযথ না হওয়ার কারণেও ক্রেতারা ডিসকাউন্ট চেয়ে বসেন। আবার নানা সময় দেখা গিয়েছে, ক্রেতা কোনো না কোনো কারণে পণ্যের চালান গ্রহণই করেননি। অর্থাৎ ডেলিভারি না নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ধরনের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, রফতানি হওয়া পণ্যের বিপরীতে কোনো অর্থই আসেনি, যা উদ্বেগজনক।

রফতানির অর্থ দেশে না আসা তথ্যের গরমিলের সমস্যা শুধু বাংলাদেশের একার নয়, পাশের দেশ ভারত পাকিস্তানও সমস্যা মোকাবেলা করছে। এক্ষেত্রে উভয় দেশই তিন মাস পর রফতানি আয়ের তথ্য প্রকাশ করে। অর্থাৎ এপ্রিলের রফতানি আয়ের তথ্য জুলাইয়ে প্রকাশিত হয়। এতে আয়ের সমন্বয় ঘটে এবং ওই মাসের প্রকৃত তথ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশ হিসাব করে মাসভিত্তিক রফতানি আয়। এটি এপ্রিল না মে মাসের রফতানি আয় তা স্পষ্ট হওয়া যায় না। তাছাড়া যেসব কারণে রফতানি আয় কম আসতে পারে সেগুলো আমলে নিয়ে পরিসংখ্যান শুদ্ধ করার প্রচেষ্টাও লক্ষ করা যায় না। বিশ্বের প্রতিটি দেশ রফতানি আয়ের একটি তথ্য প্রকাশ করে। আর বাংলাদেশে দুটি উৎস থেকে এটি প্রকাশ করায় জটিলতা তৈরি হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), ইপিবি বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দ্রুতই এটি দূর করা প্রয়োজন। কোনো রফতানিকারক কর্তৃক অর্থ ফেরত আনতে না পারা বা বিলম্ব হওয়ার যৌক্তিক কারণ উপস্থাপন করতে না পারলে সরকারের সুবিধা বন্ধ করে দেয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে যৌক্তিক উপযুক্ত কারণে কেউ অর্থ ফেরত আনতে না পারলে তার সব ধরনের স্থানীয় আন্তর্জাতিক সহায়তার জন্য আলাদা সেল থাকা আবশ্যক। সেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের দক্ষ প্রতিনিধিদের সক্রিয় উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে রফতানি আয়ের প্রত্যাবাসন তদারকি এবং উদ্ভূত সমস্যা দ্রুত সমাধানের পদক্ষেপ নিতে হবে।

উদ্যোক্তাদের বক্তব্য, রফতানিতে ডিসকাউন্টের চর্চাও রফতানি অনুযায়ী অর্থ না পাওয়ার অন্যতম কারণ। নির্ধারিত পণ্যের সঙ্গে রফতানি হওয়া পণ্যের মানে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে ক্রেতারা ডিসকাউন্টেড মূল্যে পণ্য গ্রহণ করেন। প্রক্রিয়ায় জাহাজীকরণ হওয়া পণ্যের বিপরীতে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ কম হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ইপিবি যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে, সেখানে ডিসকাউন্টের কোনো হিসাব থাকে না। তবে প্রাপ্ত অর্থে ডিসকাউন্টের প্রতিফলন দেখা যায়। আবার অনেক সময় মূল ঋণপত্রের বিপরীতে আংশিক রফতানি হয় আমদানিকারকের অনুমতি নিয়ে। এক হাজার পিস পণ্যের ঋণপত্রের রফতানির বিপরীতে রফতানি হয়েছে ৬০০ পিস। কিন্তু বিল অব এন্ট্রির ঘোষণা অনুযায়ী রফতানি হয় এক হাজার পিস হিসেবে। কিন্তু যখন অর্থ পরিশোধ হয় ৬০০ পিসের, স্বাভাবিকভাবেই তা কম হয়। এনবিআর তার অধীন সংস্থার মাধ্যমে রফতানি পণ্যের জাহাজীকরণ বা শিপমেন্টের পরিসংখ্যান আধুনিক সফটওয়্যার ব্যবস্থার মাধ্যমে সংগ্রহ করে। আর এনবিআর থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেশের সামগ্রিক রফতানির পরিসংখ্যান প্রকাশ করে ইপিবি। তাছাড়া রফতানির বিপরীতে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থপ্রাপ্তির হিসাব করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু অর্থবছর শেষে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে মেলে তিন ধরনের পরিসংখ্যান। এতে নানা জটিলতা তৈরি হচ্ছে, বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে। ইপিবি, বাংলাদেশ ব্যাংক এনবিআরের দেখা উচিত তারা রফতানির পরিমাণ-সংক্রান্ত কী তথ্য পাচ্ছে। কম বা বেশির বিষয়গুলো শনাক্তের পর কারণগুলো পর্যালোচনা করতে হবে। রফতানি অর্থপ্রাপ্তির পার্থক্য কমিয়ে আনতে তিন সংস্থার সমন্বিত প্রয়াস জরুরি।

আমদানি বিল পরিশোধ রফতানি বিল দেশে আনছে কিনা তা তদারক করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১১ সালে ড্যাশ বোর্ড চালু করে। ওই সময় থেকে অনলাইনে রফতানি তথ্য সংগ্রহ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল রফতানির অর্থ যথাসময়ে ফেরত নিয়ে আসা। এটি একটি মনিটরিং টুলস। এর মাধ্যমে একটি ব্যাংকের কোন এলসিতে কী পণ্য কেনাবেচা হচ্ছে, কী পরিমাণ অর্থায়ন করতে হচ্ছে, কবে পেমেন্ট হবেসব তথ্যই জানা যাবে। সহযোগিতার অভাবে ব্যবস্থাটি পরিপূর্ণ কাজ করছে না বলে মনে হয় না। রফতানি বাবদ প্রাপ্য অর্থের একটি অংশ সবসময়ই স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দেরিতে আসে। কভিডের সময়ে অর্থ পরিশোধের সময়সীমা অনেক ক্ষেত্রে বাড়ানো হয়েছে, যার প্রতিফলন দেখা যেতে পারে প্রাপ্ত অর্থে। প্রত্যাবাসন সক্ষমতা বাড়াতে রফতানিকারকদের চুক্তিগুলোর আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করা জরুরি।

বাংলাদেশ ব্যাংক, এলসি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক, এনবিআর, কাস্টমস চাইলেই অর্থ পাচার ঠেকানো কঠিন নয়। এটা তাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে কোন পণ্যের দাম কত সেটা যে কেউ জানতে পারে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দায়িত্ব হলো তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় প্রকৃত দাম যাচাই করা। সেটা করলেই কোনটার দাম বেশি দেখানো হয়েছে কোনটার কম তা জানতে পারবে। সেখানে অস্বাভাবিক কিছু পেলে সন্দেহজনকদের আমদানি-রফতানি বন্ধ করে দিতে পারে। আশার কথা, বাংলাদেশ বিষয়ে সজাগ হয়েছে। প্রত্যাশা থাকবে রফতানি আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক আরো সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন