স্বজনতোষী পুঁজিবাদ বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে আরো ঘনীভূত করছে

. রিজওয়ানুল ইসলাম লব্ধপ্রতিষ্ঠ অর্থনীতিবিদ আইএলওর এমপ্লয়মেন্ট সেক্টরের প্রাক্তন বিশেষ উপদেষ্টা। অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। . ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক স্নাতকোত্তর এবং অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের তত্ত্বাবধানে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। শিক্ষাজীবনে তিনি মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক, স্নাতকোত্তরসব স্তরে প্রথম স্থান অর্জন করার বিরল কৃতিত্বের অধিকারী। . ইসলামের গবেষণার বিষয় প্রধানত উন্নয়ন অর্থনীতি। রিজওয়ানুল ইসলামের সাম্প্রতিক গ্রন্থ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা: সুবর্ণজয়ন্তীতে ফিরে দেখা, ইউপিএল, ২০২২ (রুশিদান ইসলাম রহমান এবং কাজী সাহাবউদ্দিনের সঙ্গে যৌথভাবে রচিত); করোনাঘাতে অর্থনীতি শ্রমবাজার (দ্বিতীয় সংস্করণ), বাতিঘর, ২০২২। বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এমএম মুসা

বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী? কেন এটি তৈরি হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? এর কতটা অভ্যন্তরীণ আর কতটা বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কিত?

প্রশ্নের জবাব দিতে হলে দেখতে হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন কী ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে এবং তাদের মূল কোথায়। প্রথমেই বলতে হয় যে বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কভিড মহামারীর অভিঘাতে বৈশ্বিক অর্থনীতি ২০২০ সালে গভীর মন্দায় পড়েছিল। ২০২১ সালে মন্দা থেকে বের হয়ে এলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আরেকটি ধাক্কা লাগে। মহামারীর সময় সৃষ্ট হওয়া সরবরাহ শৃঙ্খলের সমস্যার সঙ্গে যোগ হয় বিভিন্ন পণ্যের, বিশেষ করে জ্বালানি খাদ্যপণ্য সরবরাহে বাধাবিঘ্ন। একদিকে ছিল পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি, তার ওপর যোগ হয় সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার ফলে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি।

মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে গতানুগতিক ধারার হাতিয়ার, সুদহার বাড়ানো। ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রধান দুই চালিকাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ হয়ে পড়েছে নিস্তেজ। শোনা যাচ্ছে মন্দার পদধ্বনি। তৃতীয় ইঞ্জিন চীনেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারে বিশাল পতন ঘটেছে।

মন্দার সম্ভাবনা আর মূল্যস্ফীতির সঙ্গে যোগ হয়েছে খাদ্যপণ্য সরবরাহে অনিশ্চয়তা এবং খাদ্য সংকটের আশঙ্কা। ইউক্রেন থেকে খাদ্যবাহী জাহাজ চলাচলে অনিশ্চয়তা চলমান থাকায় আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে।

ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রে বাংলাদেশের অর্থনীতির সামনে চ্যালেঞ্জ এখন বিশাল এবং বহুমুখী। আন্তর্জাতিক লেনদেনের ভারসাম্যে অবনতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নিম্নগতি এবং বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতা, আর অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতির চাপ। সব মিলিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা হয়ে পড়েছে দুরূহ।

তবে বাইরের আঘাতের কথার সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলতে হবে যে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় কিছু ঘাটতি আগে থেকেই ছিল, যা এখনকার অবস্থা সৃষ্টিতে কিছুটা হলেও ভূমিকা রেখেছে। যেমন গত বেশ কয়েক বছরে মুদ্রার বিনিময় হারে কোনো সমন্বয় করা হয়নি। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় দেখা গিয়েছে নিম্নমুখী ধারা এবং এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের মুদ্রার বিনিময় হারে অবমূল্যায়ন হয়েছে।

তদুপরি সুদহার সরকার নির্দিষ্ট করে দেয়ায় একদিকে সঞ্চয় নিরুৎসাহিত হয়েছে, অন্যদিকে ঋণপ্রাপ্তিতে বিভিন্ন আকারের উদ্যোক্তার মধ্যে বৈষম্য আরো বেড়েছে। যদিও আমি মনে করি না যে বাংলাদেশের মতো দেশে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। তবু যে বিষয়গুলো বললাম সেসব বিবেচনায় নিলে দেখা যায় যে সুদহার নির্দিষ্ট করে দেয়াটা সঠিক পদক্ষেপ ছিল না।

আমরা এখন যে ব্যবস্থাপনা দেখছি তাতে স্বজনতোষী পুঁজিবাদের (ক্রনি ক্যাপিটালিজম) একটা প্রবণতা বিরাজ করছে। এই স্বজনতোষী পুুঁজিবাদই বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে আরো ঘনীভূত করছে। বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীকে বেশি সুবিধা দেয়া হচ্ছে। কাগজপত্রে সবাই সমান পায়, কিন্তু বাস্তবে নয়। সবচেয়ে বড় কথা, বৈষম্যের বিষয়টিতে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। আগেই আলাপ করেছি, উৎপাদন বৃদ্ধিতে পুঁজির অংশ বাড়ছে, শ্রমের অংশ বাড়ছে নাএগুলো সংকটের আলামত। এসব কারণে আয়ের বৈষম্য বাড়ছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও বৈষম্য বাড়ছে। বৈষম্য কমানোর জন্য যেসব ব্যবস্থা নেয়া দরকার, সেগুলো কিন্তু আমরা নিচ্ছি না। আরেকটা বিষয় সবাই বলেন তা হলো সর্বক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি কমানো, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এসব বিষয়ে কিন্তু তেমন মনোযোগ আমরা দিচ্ছি বলে আমার মনে হয় না। অর্থনীতির বিভিন্ন পর্যায়ের আনুষঙ্গিক বিষয় যেমনশ্রমের দক্ষতা, শিক্ষার গুণগত মান এগুলোর দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে। এতদিন পর্যন্ত আমরা নিম্ন দক্ষ শ্রমিক দিয়ে এক ধরনের শিল্পায়ন করেছি। এটা কিন্তু আর বেশিদিন চলবে না। এসব দিকে নজর না দিলে আমরা পরের ধাপগুলোয় সফলভাবে পৌঁছতেও পারব না, অতিক্রমও করতে পারব না। শিক্ষা, শিল্প, কৃষিসহ বেশকিছু ক্ষেত্রে আমাদের বড় ধরনের রূপান্তর ঘটাতে হবে। সামনের জন্য কী ধরনের উন্নয়ন কৌশল নেয়া প্রয়োজন তা নিয়ে আমাদের এখনই ভাবতে হবে।

সংকট মোকাবেলায় সরকার আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণের দিকে ঝুঁকছে। এটি কি ঠিক আছে? অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে কী কী সংস্কার দরকার?

ধরনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিশেষ করে আইএমএফ থেকে ঋণ নেয়া একটি স্বীকৃত পন্থা। তবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সুদক্ষ হলে এবং নিজের শক্তিতে আস্থা থাকলে সেই পথে না গিয়েও যে অবস্থার মোকাবেলা করা যায় সেটা দেখিয়েছিল মালয়েশিয়া, ১৯৯৮ সালের আর্থিক সংকটের সময়। স্মরণ করা যেতে পারে যে সে সময় পূর্ব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ গভীর অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল, যা থেকে বের হওয়ার জন্য কোনো কোনো দেশ, যেমন ইন্দোনেশিয়া থাইল্যান্ড আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছিল এবং পরে দেখা গিয়েছিল যে মালয়েশিয়া সেই পথে না গিয়েও সাফল্যের সঙ্গে সংকট থেকে বের হতে পেরেছিল। তাছাড়া অন্যান্য দেশের চেয়ে সেখানে সামাজিক ক্ষেত্রে, যেমন বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া, শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি কমে যাওয়ার মতো বিরূপ প্রতিক্রিয়া কম হয়েছিল।

আইএমএফের শর্ত থাকুক বা না- থাকুক, কয়েকটি ক্ষেত্রে সংস্কার আগেই করা উচিত ছিল। প্রথমেই বলতে হয় আর্থিক খাতের, বিশেষ করে খেলাপি ঋণের কথা। ধরনের ঋণ অর্থ পাচারসহ অর্থনীতিতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করছে। সুতরাং বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে সামলাতে হবে। দ্বিতীয়ত, রাজস্ব আয় বাড়াতে না পারলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ খাতে সরকারের ব্যয় বাড়ানো যাবে না। সুতরাং লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। তৃতীয়ত, সামাজিক সুরক্ষার জন্য সরকারের বরাদ্দ এমনিতেই কম। অনেক সময় দেখা যায় যে সহায়তা পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার প্রক্রিয়ায়ই গলদ। তাছাড়া রয়েছে প্রশাসনিক দুর্বলতা। যে তিনটি সমস্যার কথা বললাম তা সমাধানের পথে অন্যতম বাধা প্রশাসনিক দক্ষতা সুশাসনের অভাব।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির হিসাব নিয়ে আপনার অভিমত কী? মূল্যস্ফীতিতে প্রকৃত মজুরি তো কমার কথা? বিষয়ে আপনার বিশ্লেষণ কী বলে? সাধারণ মানুষ কী ধরনের সংকটে রয়েছে? এতে কি আমাদের সামাজিক অর্জন ক্ষতিগ্রস্ত হবে?

কভিড মহামারীর আগ পর্যন্ত বেশ কয়েক বছর ধরে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ নিম্ন মূল্যস্ফীতির সুবিধা ভোগ করেছে এবং বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু ২০২১ সাল থেকেই মূল্যস্ফীতিতে ঊর্ধ্বগতি দেখা দেয় এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জ্বালানি খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। তার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের ওপরও। সঙ্গে যোগ হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে টাকার অবমূল্যায়ন। এতে আমদানীকৃত পণ্যের দাম দেশের বাজারে আরো বেড়ে যায়।

বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির প্রকৃতির দিকে তাকালে দেখা যায় যে এর পেছনে অতিরিক্ত চাহিদার চেয়ে সরবরাহের সমস্যাই বেশি সক্রিয়। শুধু সুদহার বাড়িয়ে ধরনের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হবে না।

তাছাড়া সাম্প্রতিক মাসগুলোতে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি অন্যান্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে ২০২১ সালেই শ্রমিকের প্রকৃত মজুরিতে নিম্নগতি দেখা দিয়েছিল। আর এখনকার প্রবণতা চলতে থাকলে দরিদ্র নিম্ন আয়ের (বিশেষ করে নির্দিষ্ট আয়ের) মানুষের দুর্গতি আরো বাড়বে। কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে তাদের জীবনযাত্রার ওপর বিভিন্ন ধরনের প্রভাব পড়ে। একদিকে যারা দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি তারা নতুন করে দরিদ্র হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের পেছনে ব্যয় বেড়ে গেলে শিক্ষা স্বাস্থ্যের মতো খাতে ব্যয় করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হতে পারে। ফলে সামাজিক অর্জনগুলো ধরে রাখা দুষ্কর হতে পারে।

সুতরাং মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি নিম্ন আয়ের, বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য অবিলম্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত মজুরি সমন্বয় করা উচিত। অন্যদিকে টিসিবির মাধ্যমে বিক্রির জন্য পণ্যের সংখ্যা পরিমাণ দুই- বাড়ানো, অন্যন্য খরচের যেমনপরিবহন, চিকিৎসা ইত্যাদির জন্য এককালীন নগদ হস্তান্তর এবং ধরনের কিছু সাময়িক পদক্ষেপের কথা ভাবা যেতে পারে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষ সঙ্গিন অবস্থায় রয়েছে। তাদের আয় বাড়ছে না। অবস্থা সামাল দিতে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতার কারণে সেটিও বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়ছে। বিদেশের অভিজ্ঞতার আলোকে সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে?

ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা বাংলাদেশে একটি বড় সমস্যা। স্মরণ করা যেতে পারে যে করোনা মহামারীর সময় নগদ সহায়তার জন্য বরাদ্দ দেয়ার পরও শুধু বাস্তবায়নে ব্যর্থতার কারণে যাদের উদ্দেশ্যে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল তাদের একটা বড় সংখ্যা সহায়তা পায়নি। একই রকমভাবে টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থাও পুরোপুরি সফল হতে পারছে না মূলত ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে। ধরনের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে। প্রসঙ্গে ভারতের সরকারি খাদ্য বিতরণের ব্যবস্থার দিকে তাকানো যেতে পারে। সেখানে একটি কার্ডের মাধ্যমে দরিদ্র নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য বিক্রির ব্যবস্থা আছে। দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রেও সে দেশের অভিজ্ঞতার দিকে তাকানো যেতে পারে।

করোনার সময় অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, এখন অর্থনৈতিক সংকটের কারণেও কর্মচ্যুতির ঘটনা ঘটছে এবং চাকরি হারানোর হার আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক অস্থিরতা শ্রমবাজারে কোনো ধরনের প্রভাব ফেলবে কি? এর সমাধান আসতে পারে কীভাবে?

অর্থনৈতিক সংকটের নেতিবাচক প্রভাব শ্রমবাজারে পড়তে খুব বেশি সময় লাগে না এবং তার ফল হয় শ্রমিক ছাঁটাই। বাংলাদশের শ্রমবাজারে, বিশেষ করে রফতানিমুখী শিল্পগুলোতে বড় সংখ্যায় ছাঁটাই হয়েছিল করোনা মহামারীর সময়। এখন আবার ছাঁটাই শুরু হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতে মন্দা ঘনীভূত হলে রফতানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব আরো জোরদার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং রফতানিমুখী খাতগুলোতে আরো বেশি সংখ্যায় শ্রমিক ছাঁটাই হতে পারে। ছাঁটাই না হলেও শ্রমিকদের মজুরির ওপর নেতিবাচক পড়তে পারে। একদিকে অতিরিক্ত কাজের সুযোগ কমে যাবে, অন্যদিকে মজুরি বৃদ্ধির হার কমে যাবে। এদিকে মূল্যস্ফীতিতে রয়েছে ঊর্ধ্বগতি। সুতরাং প্রকৃত মজুরি কমে যাওয়ার বর্তমান ধারা চলতে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বেশি হওয়ায় অর্থনৈতিক সংকটে মানুষ কি বেশি প্রভাবিত হচ্ছে?

আসলে অনানুষ্ঠানিক খাত কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের সময় মানুষের আশ্রয়ের জায়গা হতে পারে। সাধারণভাবে অর্থনৈতিক সংকটে আনুষ্ঠানিক খাতগুলোই প্রথমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখান থেকে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিক আশ্রয় খোঁজে কৃষি অন্যান্য অনানুষ্ঠানিক খাতে। কিন্তু মহামারীর সময় অনানুষ্ঠানিক খাতগুলোই প্রথমে এবং বেশি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পরে যখন সরকার ঋণ অন্যান্য কর্মসূচির মাধ্যমে প্রণোদনা দিয়েছিল তখন ছোট অনানুষ্ঠানিক খাতের ব্যবসাগুলো সেসব কর্মসূচি থেকে তুলনামূলকভাবে কম সহায়তা পেয়েছিল। সুতরাং বর্তমান সংকটে বিশাল অনানুষ্ঠানিক খাত শ্রমজীবী মানুষকে কতটা আগলে রাখতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তাছাড়া খাতের বড় অংশ এমনিতেই মানুষকে কম আয়ে কোনো রকমে টিকে থাকার সুযোগ দেয়। সেখানে চাপ আরো বেড়ে গেলে অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে যাবে।

গত বছর বিপুল সংখ্যায় মানুষ বিদেশে গেছেন কাজের জন্য জন্য, কিন্তু রেমিট্যান্সে তার প্রতিফলন ঘটছে না কেন? হুন্ডি প্রক্রিয়ায় কি অর্থ আসছে বেশি? এটি বন্ধ বা আইনি ভিত্তি দেয়া যায় কি?

হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশ থেকে দেশে টাকা পাঠানো অনেককালের পরিচিত পথ। এর একাধিক কারণ আছে। সেগুলো অনুসন্ধান করলেই বোঝা যাবে পথের ব্যবহার কেন বাড়ে। হুন্ডি ব্যবহারের একটি বড় কারণ প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সীমাবদ্ধতা, বিশেষ করে প্রক্রিয়ার জটিলতা এবং তাতে কতটা সময় লাগে। তাছাড়া মনে রাখতে হবে যে অভিবাসী কর্মীদের কাজের জায়গা অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন দেশের বড় শহরের বাইরে। সে রকম হলে সবচেয়ে কাছের ব্যাংকের শাখাই তাদের কাছ থেকে অনেক দূরে। আর দেশে যার কাছে টাকা পাঠানো হচ্ছে তিনিও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক দূরে থাকতে পারেন। সেসব ক্ষেত্রে অনেক সহজ হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো। তাছাড়া এভাবে পাঠানো অর্থ দ্রুত সরাসরি প্রাপকের কাছে পৌঁছে যায়। যখন প্রাতিষ্ঠানিক পথে পাঠানো অর্থের বিনিময় হার খোলাবাজারের হারের মধ্যকার পার্থক্য বেড়ে যায় তখন হুন্ডির ব্যবহার আরো বেড়ে যায়। সুতরাং হুন্ডির ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে হলে এসব বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিময় হারের পার্থক্য যতদিন না কমবে ততদিন হুন্ডির ব্যবহার কমানো সহজ হবে বলে মনে হয় না। তবে প্রাতিষ্ঠানিক পথের যেসব সীমাবদ্ধতার কথা বললাম সেগুলো দূর করার চেষ্টা করতে হবে।

অর্থ পাচার কি ডলার সংকটের পেছনে কোনো ভূমিকা রেখেছে? এটি বন্ধ করার কি কোনো পথ নেই?

বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের পেছনে কারণ একাধিক, যা মোটামুটিভাবে জানা আছে। তার মধ্যে অর্থ পাচার নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য কারণ এবং এটি পুরোপুরি বন্ধ করা দুষ্কর হলেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হলে অনেকটাই কমানো যেতে পারে। অর্থ পাচারের একটি প্রধান পন্থা আমদানি রফতানি মূল্য বেশি বা কম দেখানো। দুই ধারাকে কঠোর নজরদারির মধ্যে রখতে হবে। সম্প্রতি গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা গেল যে বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে ব্যাপারে তত্পর হয়েছে এবং ফলও পাওয়া গিয়েছে। এর সঙ্গে অবশ্য সম্পৃক্ত আছে ব্যাংকঋণ। বড় বড় ঋণগ্রহীতা খেলাপি হচ্ছেন এবং তাদের ঋণের অর্থ কোথায় ব্যবহূত হচ্ছে তাও নজরদারিতে আনা দরকার।

বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের একটি বড় উৎস ছিল তৈরি পোশাক শিল্প। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি কমে এসেছে যান্ত্রিকীকরণের কারণে। অর্থনীতি কর্মসংস্থানের বাজারে এর কী প্রভাব পড়বে? বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান তৈরির আর কোনো পথ আছে কি?

এখানে দুটি প্রশ্ন। প্রথমটির বিষয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি বলে জবাব খুব নির্দিষ্টভাবে দেয়া যায় না। তবে গণমাধ্যমের বিশ্লেষণধর্মী খবর থেকে জানা যায় যে কিছু কিছু জায়গায়, বিশেষ করে বড় আকারের কারখানায় শ্রমসাশ্রয়ী যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। সুতরাং কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার কমে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আর এখন তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে রফতানি বাজারে মন্দার কারণে ক্রয়াদেশে নিম্নগতি। সুতরাং তৈরি পোশাক শিল্পে আর আগের মতো বড় সংখ্যায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। অবস্থায় দেশের বিপুল শ্রমশক্তির জন্য শিল্প খাতকে বহুমুখী করা ছাড়া বিকল্প নেই। আর তার সুযোগ সম্ভাবনাও রয়েছে। প্রয়োজন যথাযথ নীতিমালা এবং তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। দক্ষিণ-পূর্ব পূর্ব এশিয়ার সফল দেশগুলোর উদাহরণ দেখিয়ে কথা আমি আগেও অনেকবার বলেছি।

দেশের গার্মেন্ট খাত রফতানি আয়েরও বড় উৎস। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব তাতে পড়লে কী ধরনের প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে পারে? সংকট উত্তরণে দ্রুত কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে আগের চেয়ে বেশি সম্পৃক্ত। সুতরাং সেখানে ওঠানামা হলে দেশের বিভিন্ন খাতে তার প্রভাব পড়া স্বাভাবিক। উদ্যোক্তাদের সেভাবে প্রস্তুতি রাখা ভালো। তারা যদি এখনো সেটা শিখে না থাকেন তবে শুধু তাদের নয়, সঙ্গে তাদের কর্মী এবং দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিশ্চয়ই নিতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তারা যেন সহজে ঋণ নিতে পারেন সে ব্যবস্থা করা যেতে পারে। করোনা মহামারীর সময় ধরনের সহায়তা দেয়া হয়েছিল। তবে সে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। প্রথমত, ঋণসহায়তা হওয়া উচিত কর্মী ছাঁটাই না করার শর্তসাপেক্ষে এবং সে শর্ত পালন করা হচ্ছে কিনা তা সতর্ক পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, মাঝারি ছোট আকারের উদ্যোগগুলোও যেন সহায়তা পায় সেদিকে নজর দিতে হবে। [চলবে]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন