সার সংকটে চাষাবাদ নিয়ে কৃষকের দুশ্চিন্তা

সরবরাহ নিশ্চিত করতে কৃষি মন্ত্রণালয় সক্রিয় হোক

দেশের বিভিন্ন স্থানে সার পাওয়া যাচ্ছে না বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হচ্ছে নিয়মিত। সার সংকটের কারণে রবিশস্য চাষেও বিঘ্ন ঘটছে। সরকার অনেক দিন ধরেই বলে আসছে, দেশে সারের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। কিন্তু বাস্তবে কৃষক সঠিক সময়ে যথামূল্যে তা পাচ্ছেন না। এখন যেমন রবি মৌসুম শুরু হয়েছে, সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে সারের জন্য হাহাকার। পাশাপাশি সামনে আসছে বোরো মৌসুম। তখন কী হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে সারের সংকট নেই দাবি করা হলেও বাস্তবতা হচ্ছে সারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষকের এমন হয়রানির শিকার হওয়া মোটেও কাম্য নয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এমনিতেই কৃষক হিমশিম খাচ্ছেন। ধারদেনা করে কৃষিকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া বিদ্যুৎ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে জমি তৈরি এবং সেচের খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে। তার ওপর সারের মূল্যবৃদ্ধি সার না পাওয়া চিন্তার কারণ। এতে উৎপাদন খরচ বাড়ার সঙ্গে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে। আরো বেড়ে যাবে খাদ্যপণ্যের দাম, যাতে নষ্ট হবে দেশের অর্থনীতির ভারসাম্য।

দেশে যেহেতু সারের বড় অংশই আমদানি করতে হয়, তাই ব্যবসায়ীরা সহজেই বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। আমদানি কারখানা পর্যায় থেকে ক্ষুদ্র বিক্রেতা পর্যায় পাঁচটি ধাপ পেরিয়ে সার যায় কৃষকের হাতে। আমদানি কারখানার সার থাকে বিসিআইসির হাতে, এরপর যায় সারা দেশের বাফার গুদামে, সেখান থেকে নিয়ে যায় সারা দেশের ডিলাররা, এরপর পান বিক্রয় প্রতিনিধিরা, তার পর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের হাত হয়ে কৃষকের কাছে। কৃষক যেন সময়মতো প্রয়োজন অনুযায়ী সার সংগ্রহ করতে পারেন সেজন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও বাজারে সারের সংকট দেখা দিয়েছে। সার ডিজেলের বাড়তি ব্যয়ের কারণে কৃষকের জন্য উৎপাদন খরচ তোলাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারের দাম বৃদ্ধি কৃত্রিম সংকটের কারণে বিপাকে পড়েছেন তারা। জেলায় জেলায় গুদামে সার পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে ঠিকাদারদের অনিয়ম, সার মজুদ রেখে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে অসাধু ডিলাররা অতিরিক্ত মূল্য আদায় করে আসছেন। সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাদের কারণে চাষীরা সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বিভিন্ন সময় অভিযোগ এলেও মূল অপরাধীদের আইনের আওতায় না আনতে পারা খুবই দুঃখজনক। এতে বারবার দুষ্টচক্রের ফাঁদে আটকা পড়ছে দেশের কৃষি খাত। খেত-খামারে সঠিক সময়ে পরিমাণমতো সার দিতে না পারলে ভালো ফসল ওঠানো যাবে না। বাজারে ঘুরে ঘুরে কৃষক সার না পেয়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, সন্দেহ নেই। অসাধু সার ব্যবসায়ী ডিলারদের অপতত্পরতা ঠেকাতে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। অবিলম্বে সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্টদের দৃশ্যমান কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে কৃষকের কাছে ন্যায্যমূল্যে প্রয়োজনীয় সার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে উৎপাদন কমার কারণে চরম খাদ্য ঘাটতিতে পড়বে দেশ। এখনই কৃষকের দুর্ভোগ কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া না হলে অনেক কৃষক আগামীতে শস্য আবাদে উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারেন। কাজেই সার সংকট সমাধানে মজুদ বাড়ানোর পাশাপাশি এর ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা কাটানোর জন্য সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

কৃষক যাতে সময়মতো প্রয়োজনীয় পরিমাণে সার সংগ্রহ করতে পারেন সেজন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশে সারের মজুদের সামান্যতম সমস্যা নেই। গুদামে পর্যাপ্ত সার মজুদ রয়েছে। পাইপলাইনে যা রয়েছে, তাতে আগামী বছরের জুলাই পর্যন্ত সারের মজুদ থাকবে। আইনশৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা তত্পর রয়েছেন। শাস্তির কথাও বলা হয়েছে। তবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে সমস্যার সাময়িক সমাধান করা গেলেও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য চাহিদামাফিক সারের আমদানি আগে থেকেই ঠিক করে মৌসুম শুরুর আগেই মজুদ করে রাখা জরুরি। স্থানীয় উৎপাদন সরবরাহ চেইন যাতে সঠিক থাকে, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। স্থানীয় ডিলার চাহিদামাফিক যাতে সার পায়, সেদিকে বেশ গুরুত্ব দেয়া উচিত। সে সঙ্গে খুচরা পর্যায়ে সারের সরবরাহ বা বিক্রি ব্যবস্থাপনা যাতে ঠিক থাকে, সেদিকে বেশি নজর বাড়ানো দরকার। মাঠ পর্যায়ে সারের মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা, ফসলের ভরা মৌসুম শুরু হওয়ার আগে সারের মজুদ ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। সার আমদানিতে প্রশাসনিক কোনো জটিলতা থাকলে তা আগে থেকেই দূর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সমস্যা আগামীতে নাও হতে পারে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) অধীনে আটটি সার কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি ইউরিয়া কারখানা। একটি টিএসপি সার কারখানা এবং একটি ডিএপি কমপ্লেক্স। সার কারখানাগুলোর যন্ত্রপাতি যদি আধুনিক করা হয় তবে আমদানির অর্ধেক ব্যয় হবে উৎপাদনে। পলাশ ঘোড়াশালের কারখানা দুটি আধুনিকীকরণের কাজ শেষ হলে উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সারের জোগান নিশ্চিত করা না হলে কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচই কেবল বাড়বে না, একই সঙ্গে উৎপাদনও হ্রাস পাবে।

ঢাকায় বৈঠক করে সারের অভাব নেই বলে মৌখিক আশ্বাস দিলেই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ মিলবে না। যেসব ডিলার সার সরবরাহে কারচুপি করছেন, বেশি দাম নিচ্ছেন বা মাপে কম দিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কোথাও কোথাও সে ব্যবস্থা নেয়াও হচ্ছে বটে। কিন্তু যেখানে সারের সরবরাহই নেই, সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত কী করবেন? মন্ত্রী-সচিবের বক্তব্য অনুযায়ী যদি সারের ঘাটতিই না থাকে, তাহলে কৃষক বিক্ষোভ করবেন কেন? সরকারকে সমস্যা অস্বীকার না করে এর গভীরতা বুঝতে হবে। সময়মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সার এমন একটি উৎপাদন উপকরণ, যা চাষের সময় চলে যাওয়ার পর পাওয়া গেলে তা কৃষকের কোনো কাজে লাগবে না। সরবরাহ কেন কম হচ্ছে, সে প্রশ্নের জবাবও সংশ্লিষ্টদের দিতে হবে। সরকার নিয়োজিত ডিলার নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী দলীয় লোকদেরই ডিলারশিপ দেয়া হয়; অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে ডিলারশিপ বাতিল হওয়ার পরও তারা বহালতবিয়তে আছেন। সার নিয়ে কারসাজি কিংবা বেশি দাম নেয়ার বিরুদ্ধে সরকার ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়েছে। কয়েকজনকে শাস্তিও দিয়েছেন সে আদালত, কিন্তু সারের সরবরাহ না বাড়ালে এসব ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে খুব সুবিধা পাওয়া যাবে না। ঢাকায় বসে বক্তব্য না দিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের উচিত সরেজমিন মাঠ পরিদর্শন করা। এতে কৃষক যেমন আশ্বস্ত হবেন, তেমনি অসাধু ডিলাররাও সতর্ক হবেন। নিয়মিত সারের বাজার তদারকির পাশাপাশি এর সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন