বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এবিবির বৈঠক

বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তাদের সনদ যাচাইয়ের নির্দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ যাচাইয়ের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সনদ পাঠিয়ে তা যাচাই করতে বলা হয়েছে। অনেকেই জাল সনদ ব্যবহার করে ব্যাংকে চাকরি করছেন, এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সনদ যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

গতকাল বিকালে দেশের সবকটি তফসিলি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের নিয়ে ব্যাংকার্স সভা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকে। সভাসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ওই সভায় দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য পরিস্থিতিসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে রমজানের আগে ভোগ্যপণ্যের আমদানি নিশ্চিত করা, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো, ব্যাংকারদের জন্য নতুন হাসপাতাল নির্মাণ, ব্যাংকে আমানত জমা উত্তোলনে গ্রাহক হয়রানি বন্ধ করাসহ সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ব্যাংক পরিচালনায় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর পরিচালনা পর্ষদের অনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের বিষয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সতর্কবার্তা দেয়া হয়।

গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় দেশের প্রায় সবকটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের চার ডেপুটি গভর্নরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এতে অংশ নেন।

বৈঠকে অংশ নেয়া বেসরকারি ব্যাংকের এক শীর্ষ নির্বাহী জানান, অভিযোগ উঠেছে যে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকে অনেকেই জাল সনদ ব্যবহার করে চাকরি করছেন। এর আগেও এমন অভিযোগ উঠেছিল এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলো তদন্ত করে অনেককে চাকরিচ্যুতও করে। কিন্তু এর পরও অনেকে এখনো জাল সনদ দিয়ে চাকরি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সে কারণেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাইয়ের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এছাড়া গতকালের বৈঠকে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের পরিবারের জন্য একটি নতুন হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকগুলোকে কোটি, দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যাংকগুলোকে কোটি এবং বাকি ব্যাংকগুলোকে কোটি টাকা করে অনুদান দিতে বলা হয়েছে। রাজধানীতে নতুন হাসপাতাল নির্মাণের বিষয়টি তদারক করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এক্ষেত্রে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।

২০২৩ সালের মার্চে রমজান মাস শুরু হলে বাজারে ভোগ্যপণ্যের যাতে কোনো সংকট না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশও দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ছোলা, তেল, ডালসহ প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আমদানির এলসি খোলার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কোনো ব্যাংক এলসি দায় পরিশোধ করতে অপারগ হলে সেটিও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে বলা হয়েছে।

এর আগে ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে দেশের সব ব্যাংককে রেমিট্যান্স রফতানি আয়ে ডলারের দর নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে রেমিট্যান্সের সর্বোচ্চ দর নির্ধারণ করা হয়েছে ডলারপ্রতি ১০৭ টাকা। ব্যাংকগুলোকে এক্সচেঞ্জ হাউজ থেকে রেমিট্যান্স ক্রয়ে দর মেনে চলতে গতকাল নির্দেশ দেয়া হয়। রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ করতে ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব অ্যাপ তৈরির পরামর্শও দেয়া হয়।

সভায় জানানো হয়, দেশের ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকা জমা দিতে গিয়ে গ্রাহকরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অভিযোগ এসেছে। আবার আতঙ্কিত গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে আমানতের অর্থ তুলতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলেও জানা গিয়েছে। পরিপ্রেক্ষিতে আমানত জমা উত্তোলনে গ্রাহকরা যাতে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হন, সেটি নিশ্চিত করতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো গ্রাহক ব্যাংকে টাকা তুলতে গিয়ে যাতে খালি হাতে না ফেরেন সেটিও নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।

ব্যাংক নির্বাহীদের কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে কৃষি খাতেও নিজস্ব নেটওয়ার্কে ঋণ বাড়ানোর জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। বৈঠকে অংশ নেয়া একাধিক ব্যাংক নির্বাহী জানান, ব্যাংক পরিচালনায় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর পরিচালনা পর্ষদের অনৈতিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে হুঁশিয়ারি বার্তা দেয়া হয়। কোনো ব্যাংকের এমডির স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হলে সেটি বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে বলা হয়েছে। ভোক্তাঋণের সুদহার ১২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যাবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে ব্যাংক নির্বাহীরা জানিয়েছেন।

ব্যাংকার্স সভা শেষে এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ভোক্তাঋণের সর্বোচ্চ সুদের হার মৌখিকভাবে ১২ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করার অনুমতি দিয়েছিল। এরই মধ্যে আমরা সেটি বাস্তবায়নও করেছি।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন ব্যাংকের অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক অনিয়মের বিষয়গুলো তদন্ত করছে। নিয়মের ব্যত্যয় বা অনিয়ম পেলে নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নেবে।

এক প্রশ্নের জবাবে সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, মাস খানেক আগে আমানতকারীরা টাকা উঠিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু বিশ্বাসের সেই সংকট এখন কেটে গিয়েছে। আমানতকারীরা পুনরায় ব্যাংকে টাকা রাখতে আসছেন। আমদানি কমে আসায় দেশের বাণিজ্য ঘাটতি অনেকটাই কমে এসেছে। ডলারসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকট কেটে যাবে বলে তিনি আশাবাদী।

তবে বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক নবনিযুক্ত মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ভোক্তা ঋণের সুদহার বাড়ানোর বিষয়ে কোনো মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়নি। ঋণের সর্বোচ্চ শতাংশ সুদের বিষয়টি প্রজ্ঞাপন জারি করে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। ভোক্তাঋণের সুদহার বাড়ানো হলে প্রয়োজনে আবারো প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।

তিনি বলেন, এবিবির সভার মূল বিষয়বস্তু ছিল আগামী রমজানকেন্দ্রিক আমদানি-রফতানি স্বাভাবিক রাখা। ছোলা, ডালসহ প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে যে ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন, বাংলাদেশ ব্যাংক সব ধরনের সহযোগিতা করবে। দেশে যাতে কোনো খাদ্যসংকট তৈরি না হয়, সেজন্য কৃষিঋণ বৃদ্ধির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যেসব ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না, তাদের টাকা অন্য ব্যাংকের মাধ্যমে হলেও কৃষকের কাছে পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এক প্রশ্নের উত্তরে মেজবাউল হক বলেন, টাকা জমা দিতে গেলে আমানতকারীরা ব্যাংকারদের জবাবদিহির শিকার হচ্ছেন। তাই অন্তত ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা দিতে যাওয়া কোনো গ্রাহককে অতিরিক্ত প্রশ্নের মুখোমুখি না করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। হুন্ডি বন্ধের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে। এর মাধ্যমে যাতে দেশ থেকে কোনো টাকা পাচার না হয়, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি অব্যাহত রয়েছে।

ইসলামী ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের একটি অন্যতম বৃহত্তম ব্যাংক। এখানে গ্রাহকদের আমানতের পূর্ণ নিশ্চয়তা রয়েছে। সেখানে কোনো দুর্নীতি হয়েছে কিনা সেটি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তদন্ত করা হচ্ছে। পরিদর্শন শেষ হলে বিষয়টি সম্পর্কে জানানো হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন