স্লিপ অ্যাপনিয়া

সামাজিক উপদ্রবে রূপ নিয়েছে এ রোগ

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। নাক, কান গলা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এর মধ্যে চিকিৎসা সেবায় অনন্য অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি জাতীয় সংসদের একজন সংসদ সদস্য (কুমিল্লা-) দীর্ঘদিন ধরে অধ্যাপনা, চিকিৎসা গবেষণা করছেন। সম্প্রতি স্লিপ অ্যাপনিয়া বা নিদ্রাকালীন শ্বাসব্যাঘাত নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

স্লিপ অ্যাপনিয়া বা নিদ্রাকালীন শ্বাসব্যাঘাত কী এবং কেন হয়?

আমাদের রেসপিরেটরি ট্র্যাককে (শ্বাসনতন্ত্র) সাপোর্ট করে যে মাংসপেশিগুলো রয়েছে, যেমন জিহ্বার মাংস, সেগুলো শিথিল হয়ে যখন আমাদের শ্বাসনালিকে সরু করে ফেলে অথবা আংশিকভাবে ব্লক করে ফেলে, তখনই স্লিপ অ্যাপনিয়া হয়। সাধারণত এটি মাঝে মাঝে শ্বাস সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। আবার যখন আমাদের শরীরে শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, তখন কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে আমাদের সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমকে উদ্দীপ্ত করলে তখন শ্বাস নেয়ার জন্য আমরা লাফিয়ে উঠি। স্লিপ অ্যাপনিয়ার মোটামুটি চারটি লক্ষণ আছে। রোগী উচ্চস্বরে নাক ডাকবে এবং দেখা যাবে হঠাৎ করে কয়েক সেকেন্ডের জন্য বা কোনো কোনো সময় এক-দেড় মিনিটের জন্যও শ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যখন শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, তখন তারা বাতাস পাওয়ার জন্য মানুষ কীভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারবে, সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। সকাল বেলা যখন ঘুম থেকে ওঠার পর মুখ শুকনো হয়ে যায়, দেখা যায় জিহ্বা তালুর সঙ্গে লেগে আছে। এছাড়া আরো কিছু লক্ষণ রয়েছে। সকালে মাথাব্যথা থাকে। ওই যে বললাম, রাত্রিবেলা নাক ডেকে ঘুম হয়। আসলে এটা ঘুম না, ইনসমনিয়া। যেহেতু হালকা ঘুম হয়। দিনের বেলা কর্মক্ষেত্রে, বাসে অথবা যেখানে সুযোগ পাবে, সেখানেই ঘুমিয়ে যাবে। নিদ্রা নিদ্রা ভাব থাকবে। 

স্লিপ অ্যাপনিয়া কি দীর্ঘমেয়াদি কোনো রোগ? কোন ধরনের স্লিপ অ্যাপনিয়া বেশি দেখা যাচ্ছে?

আসলে এটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ না সাময়িক রোগ সেটা বড় কথা না। আগেকার দিনেও মানুষ রকম শ্বাস নিত। পাশের জন তার কাছে ঘুমাতে পারত না। তবে এগুলো নিয়ে কোনো ধরনের সেনসিটিভিটি (সংবেদনশীলতা) ছিল না। কেউ মাথা ঘামাত না। এখন দেখা যাচ্ছে, স্লিপ অ্যাপনিয়ার জন্য বিয়ে ভেঙে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করে দেয় ক্ষতিপূরণ চেয়ে। এখন যেহেতু আমরা স্বাস্থ্যসচেতন হয়ে গেছি, আমি কেন আমার সঙ্গীর নাক ডাকার জন্য ঘুমাতে পারব না, এটা আমরা কেউ সহ্য করি না। স্লিপ অ্যাপনিয়া আর অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া নিয়ে দুটো কথা বলা যেতে পারে। স্লিপ অ্যাপনিয়া বা সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়া হয় আমাদের মস্তিষ্ক থেকে যথাযথ সিগন্যাল দিতে না পারার কারণে। ওই যে মাংসপেশির শিথিল হয়ে যাওয়া শ্বাসনালি সরু হয়ে যাওয়ার কারণে মস্তিষ্ক থেকে যদি সঠিক সিগন্যাল নিতে না পারে, তখন এটি হয়। অর্থাৎ মস্তিষ্কের ওই সিগন্যাল শ্বসনপ্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ায় শ্বাসনালির ওপরের অংশের অবস্ট্রাকশনের জন্য রোগী স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারেন না। স্লিপ অ্যাপনিয়ার প্রধান কারণগুলো শিশুদের জন্য এক রকম আর বয়স্কদের জন্য আরেক রকম। শিশুদের নাকের পেছনে একটা গ্রন্থি আছে, সেটাকে আমরা এডিনয়েড বলি। সেটা যদি খুব বড় হয়ে যায় মুখের টনসিল যদি বড় হয়ে যায় তাহলে এমন হতে পারে। আর প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ওজন স্থূলতার কারণে হয়ে থাকে।

ভুক্তভোগীরা কি স্লিপ অ্যাপনিয়া সম্পর্কে অবগত হয়ে চিকিৎসকের কাছে আসছেন?

অনেকেই স্লিপ অ্যাপনিয়া সম্পর্কে অবগত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসছেন। আবার অনেকেই অন্য রকম সমস্যা নিয়ে আসেন, যেমন ঘুমের মাঝে জিহ্বা আটকে যাওয়া বা ঘুম থেকে উঠলে মাথাব্যথা হওয়া রকম উপসর্গ নিয়ে আসেন। মূলত অনেকেই জানেন না তাদের ঘুমের মাঝে নাক ডাকা অভ্যাস আছে। ঘুমের মধ্যে নাক ডাকার বিষয়টি অনেক সময় স্বজনের মাধ্যমে জেনে তারপর চিকিৎসকের কাছে আসছেন।

এসব রোগী সাধারণত রোগের কোন পর্যায়ে চিকিৎসা নিতে আসছেন?

যেহেতু আমাদের দেশে সাধারণের মধ্যে স্লিপ অ্যাপনিয়া সচেতনতা মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা কম তাই এখানে রোগীরা কিছুটা দেরি করেই আসেন। তাছাড়া চিকিৎসকের কাছে আসার আগে ফি, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি, ওষুধপত্রের খরচ নিয়ে বেশি ভাবনা থেকেও অনেকে দেরিতে এসে থাকেন।

বাংলাদেশে স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা কি বাড়ছে?

আগের চেয়ে এখন রোগীর সংখ্যা বিশেষ করে শহরাঞ্চলে অনেক বেড়েছে। শহরের মানুষের নিশ্চল জীবনযাত্রায় দৈহিক শ্রম শারীরিক চর্চা না থাকার কারণে রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্যের জন্য স্লিপ অ্যাপনিয়া কি উদ্বেগের কারণ নাকি সাধারণ রোগ? এর সঙ্গে কি বংশগতির কোনো সম্পর্ক রয়েছে?

অবশ্যই স্লিপ অ্যাপনিয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগের কারণ। এতে হূদরোগের ঝুঁকি বাড়ে, সড়ক দুর্ঘটনা হয়, আয়ুষ্কাল কমে যায়। এখন সামাজিক উপদ্রবে রূপ নিয়েছে রোগ। তবে এর সঙ্গে বংশগতির সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। আবার যেহেতু স্থূলতার সঙ্গে বংশগতি বা জেনেটিক্সের সম্পর্ক রয়েছে তাই তার সম্ভাবনাকে একদম গণনায় না আনলেও নয়।

বাংলাদেশে স্লিপ অ্যাপনিয়ার বিষয়ে সচেতনতা, কার্যক্রম গবেষণা নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ জানাবেন।

আমি মনে করি শিক্ষা চিকিৎসা যখন পণ্য হয়ে যায় তখন তার গুণগত মান গবেষণা স্থবির হয়ে যায়। আমাদের দেশে চিকিৎসা, পরীক্ষা ওষুধ পদ্ধতি অনেকটাই বাণিজ্যিক রূপ ধারণ করছে যার ফলে গুণগত মানের গবেষণা হচ্ছে না। রোগী দেখেই আমরা অনেক অর্থ পাচ্ছি, গবেষণা করে পুরস্কার বা নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কথা আমরা ভাবছি না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকার সময়ে আমি চেয়েছিলাম ওখানকার অধ্যাপকরা গবেষক হবেন, অধ্যাপনা করবেন। তারা কোনো ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিস করবেন না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ১৯৭০-এর আগে যে আটটা মেডিকেল কলেজ ছিল, সেগুলো পুরোপুরি নন-প্র্যাকটিসিং করে দেয়া উচিত। আমাদের যদি প্র্যাকটিসের তাড়া না থাকে, তাহলে নিজে আরো দুজন রোগীর কাছে যাব, জুনিয়রদের দিয়ে গবেষণা করানোর সুযোগটা পাব। সেই সঙ্গে সরকারি মেডিকেল কলেজের সঙ্গে যদি বেসরকারি রোগ নির্ণয় কেন্দ্র যুক্ত থাকে। তাহলে রোগীদের খরচ এক-তৃতীয়াংশ কমানো যাবে পাশাপাশি ওই লভ্যাংশ দিয়ে চিকিৎসকরা গবেষণা বা নন-প্র্যাকটিসিং অ্যালাউন্স ভাগ করে নিতে পারবেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন