কেমন ছিল বিশ্বকাপের প্রথম আসর

বণিক বার্তা অনলাইন

ছবি: ফিফা

নব্বই হাজার দর্শকে মুখর মোন্তেভিদেও-এর স্টেডিয়াম। মুখোমুখি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে। আগেও কয়েক দফা মুখোমুখি হয়েছে দু’দল। তবুও এই খেলার বিশেষত্ব অন্য জায়গায়। ফিফার প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলছে তারা!

এক শতক ধরে সারা বিশ্বে ফুটবল উন্মাদনার আরেক নাম ‘ফিফা বিশ্বকাপ’। আর প্রথম আসরের ফাইনাল অবশ্যই ইতিহাসের অংশ। যার সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই ‌‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ এই মহাকাব্যিক লাইনটি। তবে প্রায় লাখো মানুষের সমবেত হওয়ার প্রেক্ষাপট বুঝতে তাকাতে হবে আরেকটু পেছনে।

ফুটবলের জনপ্রিয়তা বিবেচনায় ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বা ফিফা। কিন্তু শুরুতেই বিশ্বকাপের আয়োজন করা হয়ে ওঠেনি। কিছুটা তোড়জোড় শুরু হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে সেই চেষ্টা থেকে যায় অধরা।

যুদ্ধের পরপরই ১৯১৯ সালে ফ্রেঞ্চ ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জুল রিমেট। ১৯২১ সালে নির্বাচিত হন ফিফার প্রেসিডেন্ট। ফুটবল নিয়ে তার স্বপ্ন ছিল অন্য মাত্রার। সেই আগ্রহকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয় ১৯২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিক ও ১৯২৮ সালের আমস্টারডাম অলিম্পিকের জনপ্রিয়তা।

তখন কেবল ইউরোপ বা আমেরিকা নয়, এশিয়া ও আফ্রিকাতেও জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে ফুটবল। ১৯২৮ সালে উরুগুয়ের সঙ্গে সর্বজনীন কোন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের প্রসঙ্গে কথা বলেন জুল রিমেট। এর আগে দুই অলিম্পিক আসরের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে। ১৯৩০ সালে দেশটির স্বাধীনতা ও সংবিধান প্রণয়নের একশো বছর পূর্ণ হবার কথা। অর্থনৈতিকভাবেও বেশ শক্তিশালী। সবকিছু বিবেচনায় আয়োজক দেশ হিসেবে নির্বাচিত করা হয় উরুগুয়েকে। অংশগ্রহণকারী সকল দেশের খরচ বহনের ঘোষণা দেয় দেশটির ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন।        

কোন বাছাই পর্ব ছিল না এই আসরে। ফিফায় নিবন্ধিত প্রতিটা দেশকেই আহ্বান করা হয়। নিবন্ধনের সময়সীমা রাখা হয় ১৯৩০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, বলিভিয়া, চিলি, মেক্সিকো, প্যারাগুয়ে, পেরু ও যুক্তরাষ্ট্র অংশগ্রহণ করতে সম্মতি জানায়। অর্থনৈতিক মন্দা ও আটলান্টিক মহাসাগরের দীর্ঘ ভ্রমণের জন্য ইউরোপীয় দেশগুলো অনাগ্রহ দেখায়। পরবর্তীতে অবশ্য জুল রিমেটের মধ্যস্থতায় অংশগ্রহণ করতে রাজি হয় বেলজিয়াম, ফ্রান্স, রোমানিয়া ও যুগোস্লাভিয়া।

১৩টি দল নিয়েই শুরু হয় প্রথম বিশ্বকাপের আসর। চারটি গ্রুপে সাজানো হয় তাদের। এক গ্রুপে চারটি এবং বাকি তিনগ্রুপে তিনটি করে দল। ১৯৩০ সালের ১৩ জুলাই দুটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। পোসিতোস স্টেডিয়ামে মেক্সিকোকে ৪-১ গোলে হারায় ফ্রান্স। একই সময় পারকু সেন্ট্রাল স্টেডিয়ামে বেলজিয়ামকে ৩-০ গোলে হারায় যুক্তরাষ্ট্র। এদিন প্রথম গোলকারী হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখান ফ্রান্সের লুসিয়েন লরেন্ট।

ছবি: ফিফা

বিশ্বকাপের অনেক প্রথমই জড়িত এই দুই ম্যাচে। যা-ই হোক, গ্রুপ পর্ব শেষ করে সেমিফাইনালে উত্তীর্ণ হয় আর্জেন্টিনা, যুগোস্লাভিয়া, উরুগুয়ে ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আর্জেন্টিনার খেলাটা ছিল বৃষ্টিভেজা কর্দমাক্ত মাঠে। ম্যাচের পরিস্থিতিও সহিংস হয়ে পড়ে। বড় ব্যবধানে জয় নিয়েই ফেরত আসে আর্জেন্টিনা। অন্যদিকে যুগোস্লাভিয়াকে পরাজিত করে উরুগুয়ে। হোসে পেদ্রো সিয়া করেন হ্যাটট্রিক। ১৯৩৪ সাল থেকে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান নির্ধারণী ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ প্রথম আসরে এমন কোন ম্যাচ হয়নি। যদিও তৃতীয় স্থানে নিজেদের দাবি করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুগোস্লাভিয়া উভয় দেশই বিবৃতি দেয়।

অবশেষে ৩০ জুলাই ফাইনালে মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে। ১৯২৮ সালেও অলিম্পিক ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল তারা। এই ফাইনাল যেন তারই পুনরাবৃত্তি। স্টেডিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ। ২-১ গোলে জয়লাভ করে উরুগুয়ে। দেশের শততম জন্মদিনে তারা বিশ্বকাপের আসরে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ইতিহাসে চিরস্থায়ী নাম পেয়ে যায়। ১৯৫৪ সালেও আরেক দফা চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। আর্জেন্টিনাও চ্যাম্পিয়ন হয় দুইবার।

একে একে চ্যাম্পিয়নের তালিকায় যুক্ত হতে থাকে নতুন নতুন নাম। পরাশক্তি হিসেবে হাজির হয় ব্রাজিল, ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ড, স্পেন ও জার্মানির নাম। শুরু হয় সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের ভিন্ন এক গল্প, যা এখনো প্রবাহমান। প্রতি চার বছর পর মানুষ মেতে ওঠে ফুটবলের উচ্ছ্বাসে।    

ফাইনালে অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দের সর্বশেষ সদস্য মৃত্যুবরণ করেন ২০১০ সালের ৩০ আগস্ট। ফুটবলেরও অনেক পরিবর্তন এসেছে। এক সময় চ্যাম্পিয়নকে দেয়া হতো জুল রিমেট অ্যাওয়ার্ড। ১৯৭০ সালের পর তাও পরিবর্তিত হয়। প্রযুক্তির প্রবাহে বদলে গেছে বলের ধরন ও অফসাইড শনাক্তকরণ পদ্ধতি। কিন্তু বিশ্বকাপের সেই প্রথম আসরের কথা এখনো আপ্লুত করে লাখো মানুষকে।     

ফুটবল হিস্ট্রি, হিস্ট্রি চ্যানেল ও ফিফার ওয়েবসাইট অবলম্বনে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন