ডলার সংকটে বিপত্তিতে বিএসসি

আবু তাহের

অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে বিদেশ থেকে ভাড়া করা জাহাজ ব্যবহার করে থাকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এসব জাহাজের ভাড়া পরিশোধ করা হয় মূলত বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) মাধ্যমে। এজন্য এতদিন ডলারে বিএসসির পাওনা পরিশোধ করে এসেছে বিপিসি। কিন্তু ডলারের বর্তমান সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তুলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বিপিসি এখন বিএসসিকে জাহাজের ভাড়ার অর্থ পরিশোধ করছে বাংলাদেশী টাকায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশী জাহাজ মালিকদের পাওনা ভাড়া ডলারে সময়মতো পরিশোধ করা নিয়ে বিপত্তিতে পড়েছে বিএসসি।

সঠিক সময়ে জাহাজ ভাড়া পরিশোধে বিলম্ব হলে বিএসসিকে প্রতিদিনের জন্য অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করতে হয়। সংস্থাটির আশঙ্কা, পরিস্থিতি বজায় থাকলে সংস্থাটি সামনের দিনগুলোয় বিপুল পরিমাণ আর্থিক লোকসানের সম্মুখীন হতে হবে। এছাড়া বিদেশী জাহাজ মালিকরাও পরিবহন চুক্তি বাতিলের মতো পদক্ষেপ নিলে তা দেশের জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থাকে বিঘ্নের কারণ হয়ে দেখা দেবে।

বিষয়ে গত ২৩ নভেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর একটি চিঠি দিয়েছে বিএসসি। করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর এসএম মনিরুজ্জামান স্বাক্ষরিত ওই চিঠির ভাষ্য অনুযায়ী, বিপিসি সাধারণত চার্টারকৃত বিদেশী মাদার ট্যাংকার জাহাজের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আমদানি করেছে। এতদিন পর্যন্ত এসব নৌযানের ভাড়া হিসেবে বিপিসির সরবরাহকৃত বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশী জাহাজ মালিকদের পরিশোধ করেছে বিএসসি। কিন্তু সম্প্রতি বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আপত্তি জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিপিসি এখন বিএসসিকে বৈদেশিক মুদ্রার পরিবর্তে স্থানীয় মুদ্রায় জ্বালানি তেলবাহী জাহাজের ভাড়া পরিশোধ করছে। এতে ডলারে বিদেশী জাহাজের ভাড়া পরিশোধ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে বিএসসি।

চিঠির তথ্য অনুযায়ী, নিউইয়র্কভিত্তিক ফায়ারমন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড শিপিং এলএলসি এবং নরভিক এনার্জি নেভিগেশন এলএলসি নামে দুটি পরিবহন কোম্পানির কাছ থেকে ভাড়াকৃত জাহাজে জ্বালানি তেল আমদানি করেছিল বিপিসি। জাহাজ ভাড়া বাবদ দুই কোম্পানির পাওনা ৮১ লাখ ডলারের কিছু বেশি। ভাড়া পরিশোধের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের (আইবিবিএল) চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখায় সুপারিশ তাগাদাপত্র দেয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাহাজ ভাড়া পরিশোধের জন্য ইসলামী ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ডলারের সরবরাহ চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি চাহিদাপত্রও পাঠানো হয়। এর সঙ্গে বিএসসির পক্ষ থেকেও বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর একটি চিঠি পাঠানো হয়। এছাড়া সংস্থাটির একটি প্রতিনিধি দল গত ১৬ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগে গিয়ে জাহাজ ভাড়া পরিশোধের বিষয়ে মৌখিকভাবেও অনুরোধ জানায়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক আইবিবিএল বিষয়ে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি।

বকেয়া জাহাজ ভাড়ার মধ্যে প্রায় ৪০ লাখ ডলার এরই মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে বলে জানালেন ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, শিপিং করপোরেশনের চাহিদা অনুযায়ী ৪০ লাখ ডলার এরই মধ্যে জাহাজের ভাড়া বাবদ পরিশোধ করে দেয়া হয়েছে। বাকি ডলারও শিগগিরই পরিশোধ করে দেয়া হবে।

ব্যাংক খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশী জাহাজে জ্বালানি তেল পরিবহন বিপিসির নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ। এভাবে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য থেকে নিয়মিতভাবে জ্বালানি তেল আমদানি করা হয় বাবদ বিদেশী জাহাজের ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু দেশে চলমান ডলার সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় মুদ্রার বিপরীতে ডলার কিনে কত দিন ধরনের কার্যক্রম চালু রাখা যাবে, সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে।

বিষয়ে ইসলামী ব্যাংক সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের বক্তব্য হলো, বিপিসির আমদানি কার্যক্রম চালু রাখতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা প্রয়োজন। স্থানীয় মুদ্রায় বিল পরিশোধ করে এর বিপরীতে ডলার কিনে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটির আমদানি কার্যক্রম চালু রাখতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহযোগিতা ছাড়া আমদানি কার্যক্রম চালু রাখা বর্তমান ডলার সংকটের পরিস্থিতিতে বেশ চ্যালেঞ্জিং।

বিষয়টি নিয়ে জানতে বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর এসএম মনিরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

বিদেশী জাহাজ মালিকদের সঙ্গে বিএসসির চুক্তি অনুযায়ী কার্গো খালাসের ১৪ দিনের মধ্যে ফ্রেইট বা জাহাজ ভাড়া পরিশোধের বাধ্যবাধকতা আছে। সঠিক সময়ে জাহাজ ভাড়া পরিশোধে বিলম্ব হলে বিএসসিকে প্রতিদিনের জন্য অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করতে হয়। এক্ষেত্রে বিএসসি বিপুল পরিমাণ আর্থিক লোকসানের সম্মুখীন হওয়ার পাশাপাশি ফ্রেইট চুক্তি বাতিল এবং রাষ্ট্রীয় জ্বালানি তেল পরিবহনকারী জাহাজ বিদেশী বন্দরে আটকা পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়, যা গোটা জাতীয় জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থাকে বিঘ্নিত করতে পারে বলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে দেয়া বিএসসির চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে আরো বলা হয়, ধরনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে জ্বালানি তেল পরিবহনকারী জাহাজগুলো বাংলাদেশ জ্বালানি পরিবহনে রাজি না হলে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের পরিশোধনাগার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিঘ্নিত হতে পারে পরিশোধিত জ্বালানি তেল উৎপাদন সরবরাহ ব্যবস্থাপনা। সেক্ষেত্রে জ্বালানি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ার উপক্রম হওয়ার পাশাপাশি জ্বালানি বাজারে অস্থিতিশীলতায় সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা তৈরি হতে পারে।

বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, তারা একটি চিঠি পাঠিয়ে বিষয়ে বিপিসির কাছে সহযোগিতা চেয়েছে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করব। কারণ তাদের পেমেন্ট জটিলতায় ঝামেলা হলে সেখানে বিপিসির জ্বালানি তেল আমদানিতে প্রভাব পড়বে। জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ আমাদের কাছে যে পরিমাণ ডলার ছিল, তা দিয়ে হয়তো কিছুটা সহযোগিতা করা যেত, তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে সেটি এখন আর করা যাবে না।

বিপিসি জ্বালানি বিভাগসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। এছাড়া ৪০ লাখ টন ডিজেল আমদানি করা হয়। বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল আসে বিদেশী জাহাজে করে। এজন্য বিপিসিকে বছরে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়।

বিদেশী জাহাজে করে জ্বালানি তেল আমদানিতে বিপিসির বিপুল অংকের বিদেশী মুদ্রা ব্যয়ের বিষয়টি সরকারেরও দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এরই মধ্যে বিপিসির জ্বালানি তেল আমদানিতে বিদেশীর পাশাপাশি দেশী জাহাজও ব্যবহার করার বিষয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় নীতিগত সিদ্ধান্তও হয়।

সভায় সিদ্ধান্ত হয়, বিপিসি সরকারি সংস্থা বিএসসির বহরে থাকা তিনটি জাহাজ তেল আমদানির জন্য ব্যবহার করবে। ব্যবহারের বিষয়টি ঠিক করতে দুই পক্ষ বৈঠক করবে। আগামী জানুয়ারি থেকে বিএসসির জাহাজ ব্যবহার শুরু হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন