চট্টগ্রামের ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট

ঋণপত্র খুলতে না পেরে বিড়ম্বনায় ভারী শিল্প খাত

সুজিত সাহা, চট্টগ্রাম ব্যুরো

দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ভারী শিল্প খাতের অন্যতম কেন্দ্র বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। অর্ধেকেরও বেশি ভোগ্যপণ্য আমদানি হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে ডলার সংকট, টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়াসহ ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট সৃষ্টি হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। জ্বালানি সংকটের কারণে এমনিতেই উৎপাদন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এর পাশাপাশি চাহিদামতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারা নগদ অর্থ সরবরাহে ব্যাংকের ধীরগতির কারণে শিল্প-কারখানার উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।

চট্টগ্রামভিত্তিক বেশ কয়েকটি ভারী শিল্প গ্রুপের মালিক কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকার ব্যাংকগুলোর এলসি সংকটসহ নগদ অর্থপ্রবাহের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তারা বলছেন, ঋণপত্র খুলতে ব্যবসায়ীদের বিড়ম্বনা না কাটলে অচিরেই অনেক শিল্প-কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এরই মধ্যে ভারী শিল্পের অনেক কারখানা মালিক তাদের উৎপাদন ১০-২০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছেন। মজুদ কাঁচামাল দিয়ে ফিনিশড পণ্য উৎপাদন অব্যাহত থাকলেও স্ক্র্যাপ গলিয়ে বিলেট কিংবা অ্যাঙ্গেল নির্মাণের প্লান্টের উৎপাদন কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে কোম্পানিগুলো।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একসময় ভারী শিল্পের একেকটি এলসি ভ্যালু মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত উঠে যেত। বর্তমানে ১০ হাজার ডলারের বেশি এলসি খুলতে বাধা দিচ্ছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ছোট আকারে এলসি খোলার তথ্য ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। প্রধান কার্যালয় থেকে সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়। এর পরই আমদানি প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন আমদানিকারকরা।

একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, এখন এলসি খুলতে স্থানীয় কার্যালয়ে আবেদনের পর লবিং করতে ঢাকায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ধরনা দিতে হচ্ছে। তাছাড়া ডিসেম্বর ক্লোজিংয়ের কারণেও ব্যাংকগুলোর সংকট তীব্র হয়েছে বলে মনে করছেন তারা। অন্যদিকে, তারল্য সংকটের বিষয়টি সরাসরি স্বীকার না করলেও ডিসেম্বর ক্লোজিংজনিত পরিস্থিতিতে আমানত উত্তোলনে আসা গ্রাহকদের ধরনভেদে দীর্ঘসূত্রতায় পড়তে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।

দেশের শীর্ষস্থানীয় ইস্পাতপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড (বিএসআরএম) ২০২১ সালে ১৫ লাখ টন সমপরিমাণ রড উৎপাদন বিক্রি করেছিল। নানা সংকটের কারণে চলতি বছর প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৫ লাখ টন। বাজারে রডের চাহিদা থাকলেও উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছে বিএসআরএম। এরই মধ্যে রোলিং প্লান্টের ১০ শতাংশ উৎপাদন কমিয়ে দেয়া হয়েছে। বিলেট-অ্যাঙ্গেলসহ অন্যান্য প্লান্টের উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয়  ইস্পাত প্রতিষ্ঠানটি।

একই অবস্থা চট্টগ্রামভিত্তিক মোস্তফা হাকিম গ্রুপের এইচএম স্টিলেরও। কয়েক মাস ধরে চলা জ্বালানি সংকটের কারণে উৎপাদন তিন শিফটের বদলে দুই শিফটে নামিয়ে আনা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকে চেষ্টা করেও কাঙ্ক্ষিত এলসি খুলতে বেগ পেতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে। একসময় মাসে অন্তত পাঁচটি এলসি খুললেও বর্তমানে সেটি সর্বোচ্চ তিনটিতে দাঁড়িয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধাররা বলছেন, ভারী শিল্প-কারখানাগুলোয় এমনিতে কয়েক মাসের মজুদ থাকে। কিন্তু যেহেতু সংকট দীর্ঘায়িত হচ্ছে, আমদানি কমে যাচ্ছে। তাই ভবিষ্যতে পণ্য উৎপাদনে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হতে পারে।

জানা গেছে, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, জুবিলী রোডসহ বিভিন্ন ব্যবসাঘন এলাকার ব্যাংকের শাখাগুলোতে নগদ অর্থের সংকট রয়েছে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে নগদ টাকা তুলতে গেলে সাধারণ গ্রাহকদেরও অনেক সময় ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাদেরই একজন জজ আদালতের আইনজীবী হেলাল উদ্দিন শিকদার। গত ২২ নভেম্বর চট্টগ্রামে বেসরকারি ব্যাংকের একটি শাখায় টাকা তুলতে যান তিনি। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে অনুরোধ করে যে একান্ত প্রয়োজন না হলে পরবর্তী কার্যদিবসে চেক নগদায়ন করতে। এর পরিপ্র্রেক্ষিতে পরদিন গিয়ে তিনি কাঙ্ক্ষিত পরিমাণের অর্থ উত্তোলন করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রামের পূবালী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যাংকের প্রধান শাখাগুলোতে তারল্য সংকট সেভাবে নেই। তবে সপ্তাহের মাঝামাঝি সময়ে বড় পরিমাণের নগদ অর্থ উত্তোলনে কেউ এলে সাময়িক সংকট তৈরি হয়। গ্রাহকদের বুঝিয়ে সেটি পরবর্তী কার্যদিবসে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে গ্রাহকের একান্তই প্রয়োজন হলে যেকোনো উপায়ে অর্থ সরবরাহ অব্যাহত রাখা হয়।

তবে মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ সরওয়ার আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যাংকগুলোতে এলসি সংকট থাকলেও এখন পর্যন্ত নগদ অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হয়নি তাদের। কারণ ব্যাংকগুলো বড় গ্রাহকদের জন্য যেকোনোভাবে অর্থ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করে। তাছাড়া করপোরেট গ্রাহকরা নগদ অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে আগেই ব্যাংকগুলোতে জানিয়ে রাখে। আবার অনেক শিল্প গ্রুপের বেতন-ভাতা দেয়ার জন্য বড় অংকের অর্থ উত্তোলনের সময় সম্পর্কে ব্যাংকগুলো আগে থেকেই অবগত থাকে। সে অনুযায়ী তারা ব্যবস্থা নিয়ে রাখে।

দেশে ভোগ্যপণ্যের প্রধান বাজার খাতুনগঞ্জের একটি বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, খাতুনগঞ্জে গ্রাহকরা চলতি হিসাব থেকে বড় আকারের লেনদেন করেন। ট্রেডিং ডিও ব্যবসার কারণে বাজারের ব্যাংকগুলোতে নগদ অর্থ লেনদেনের হারও বেশি। সম্প্রতি নগদ অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে সপ্তাহের মাঝামাঝি দিনগুলোয় কিছুটা সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। তবে বড় গ্রাহকদের ক্ষেত্রে সাধারণত সমস্যা হয় না। আগাম প্রস্তুতি না থাকলেও যেকোনোভাবেই হোক না কেন, বড় গ্রাহকদের সন্তুষ্ট রাখতে চেষ্টা করা হয়।

আরডিএম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিজিএমইএর সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, পরিস্থিতি ধাপে ধাপে অবনতির দিকে যাচ্ছে। নন-বন্ডেড প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছোটগুলো এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো সংকটের মধ্যে পড়েছে। আগামীতে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোও সংকটে পড়বে। ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটের বিষয়টি সরাসরি স্বীকার না করলেও তাদের বিভিন্ন কার্যক্রমে তা ধরা পড়ছে। বিশেষত ব্যাংকগুলোতে বড় অংকের নগদ অর্থ উত্তোলনের সময় ধীরগতিতে নগদায়ন প্রক্রিয়াই বলে দেয় যে ব্যাংকে সংকট দেখা দিয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন