ম্যারাডোনা, মেসির দেশে ফুটবলের বেড়ে ওঠা

আহমেদ দীন রুমি

ঊনিশ শতকের শেষ দিক। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, উত্তর আয়রল্যান্ড নেদারল্যান্ডসের পরই পঞ্চম দেশ হিসেবে ফুটবলের সংস্কৃতি আর্জেন্টিনায় প্রবেশ করে। ১৮৬৭ সালে দুই পক্ষে আটজন করে ১৬ জন ব্রিটিশ খেলোয়াড়ের মধ্যে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। তাকে প্রথম ম্যাচ হিসেবে স্বীকার করে নেয়া যায়।

 

তবে সময়ের ফুটবল খেলার নিয়মকানুন অনেক দিক দিয়েই অন্যরকম ছিল। ১৮৮০ সালে অনুষ্ঠিত ফুটবল ম্যাচ খেলার রীতিতে নতুনত্ব আসে। পরিবর্তন আসে আগ্রহেও। খেলা দেখার জন্য হাজার খানেক মানুষ উপস্থিত ছিল সেই ম্যাচে। আনুষ্ঠানিকভাবে আর্জেন্টিনায় ফুটবলের যাত্রা আলেকজান্ডার ওয়াটসনের মাধ্যমে। তিনিই ১৮৯১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন অ্যাসোসিয়েশন আর্জেন্টিনা ফুটবল লিগ। পাঁচটি ক্লাব ছিল এর অধীনে। তাদের মধ্য থেকে চ্যাম্পিয়ন নির্বাচন করার জন্য আয়োজিত হয় টুর্নামেন্ট। যদিও প্রথম আসরের পরই মাঠে মারা যায় এই উদ্যোগ। তবে ফুটবলের আগ্রহ কমেনি। বিদ্যমান দলের পাশাপাশি ব্রিটিশ নাগরিকদের দ্বারাই বিভিন্ন স্থানে নির্মিত হয় ছোটখাটো নতুন দল। পুরাতন সেই ক্লাবের মধ্যে রোজারিও সেন্ট্রাল কুইলমেসের মতো কয়েকটি ক্লাব এখনো বিদ্যমান।

 

যা- হোক, ১৮৯৩ সালে আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শুরু হয় নতুন মহাকাব্য রচনার পালা। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পরতে থাকে ফুটবলের জনপ্রিয়তা।

 

কোনো দেশের সংস্কৃতির প্রসঙ্গ উঠলেই মাথায় আসে সে দেশের শিল্পকলা, স্থাপত্য, রান্নাবান্না, সংগীতসহ অনেক কিছুই। আর্জেন্টিনার জন্য তা ফুটবল। যদিও ফুটবল সেখানকার জাতীয় খেলা না। আর্জেন্টিনার জাতীয় খেলার নাম পাতো। ঘোড়ার পিঠে বসে বাস্কেট বল আর পোলো খেলার মতো কিছুটা। অথচ বর্তমানে আর্জেন্টিনা থেকে এক হাজারের বেশি খেলোয়াড় ইউরোপের বিভিন্ন ফুটবল ক্লাবে খেলেন। দেশে কেবল নিবন্ধিত ফুটবলারের সংখ্যা লাখ ৩০ হাজার। নারী পুরুষ মিলিয়ে অনিবন্ধিত ফুটবল খেলোয়াড় ২৭ লাখের বেশি। এই পরিসংখ্যান আর্জেন্টিনার মানুষের মাঝে ফুটবলের অবস্থান তুলে ধরে।

 

১৮৯৩ সালের পর ফুটবল দল আর অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিপুল গতিতে বাড়তে থাকল জনপ্রিয়তা। বিশ শতকের শুরুর দিকে আর্জেন্টিনায় বৃদ্ধি পায় ইউরোপীয় অভিবাসী স্রোত। পাল্লা দিয়ে বাড়ে ফুটবলের প্রতি ঝোঁক। তবে এই ফুটবল সংস্কৃতি তখনো ছিল কেবল নতুন পুরাতন অভিবাসী ইউরোপীয়দের মাঝেই। স্থানীয় ক্রেওল জনগনকে কোনো ক্লাবে সুযোগ দেয়া হতো না। ফলে স্থানীয়রা নিজেদের মতো করেই ক্লাব প্রতিষ্ঠিত করেছে পরবর্তীতে।

 

১৯০৪ সালের পর থেকে ইউরোপীয় ক্লাবগুলো ফুটবল খেলতে লাতিন আমেরিকা সফর শুরু করে। ক্রমে সেখানে যেতে শুরুর করে চেলসি এবং সাউদাম্পটনের মতো বিখ্যাত সব ক্লাব। তাদের মধ্যে থাকা ব্রিটিশ খেলোয়াড়দের দক্ষতা আর্জেন্টিনার নাগরিকদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। নির্ধারণ করেছে ফুটবলের ভবিষ্যত নির্মাণের পথ। তার প্রমাণ পাওয়া যায় মাত্র কয়েক বছর পরেই। ১৯০৭ সালে আর্জেন্টিনায় প্রতিষ্ঠিত ক্লাবের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০০-তে। এতোগুলো ক্লাবকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য এগিয়ে এলো আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। ম্যাচ পরিচালনা আরো সহজ হলো। সহজ হলো সারা দেশকে বিভোর করার রাস্তাও।

 

আর্জেন্টিনার প্রথম জয় করা ট্রফি কোপা লিপটন। ১৯০৬-১৯০৯ টানা চার বছর চ্যাম্পিয়ন হয় দেশটি। ১৯১৬ সালে প্রথমবারের মতো কোপা আমরিকায় অংশগ্রহণ করলেও চ্যাম্পিয়ন শিরোপা লাভ করে ১৯২১ সালে। এখন পর্যন্ত ১৫ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আর্জেন্টিনা। ১৯৩০ সাল থেকে শুরু হয় বিশ্বকাপ আসর। ১৯৭৮ সালে এবং ১৯৮৬ সালের আসরে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে নাম লেখায় দেশটি। ১৯৭৭ সাল থেকে ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপের যাত্রা। আর্জেন্টিনা ১৯৭৯ সালে অর্থাত্ দ্বিতীয় আসরেই নেয় চ্যাম্পিয়ন খেতাব। তখন ম্যারাডোনা অনূর্ধ্ব-২০ দলে খেলতেন। এখন পর্যন্ত ছয়বার শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা জয় করেছে দলটি।

 

যে দেশে কেবল খেলোয়াড় ২৭ লাখ, সেখানে সমর্থকের সংখ্যা কত হতে পারে! মূলত ফুটবল আর্জেন্টিনার সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে গেছে। সামরিক শাসক ব্যবহার করেছে নিজের স্বার্থে, জাতীয় নেতারা ব্যবহার করেছেন দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে। এখনো বিশ্বকাপের সময় অধিকাংশ মানুষ টেলিভিশন নিয়ে বসে থাকে। আর্জেন্টিনার জয়ে রাস্তা-ঘাট ফেটে পড়ে উল্লাসে। বাচ্চারা সেখানে ম্যারাডোনার গল্প শুনে বেড়ে ওঠে। ফুটবলের সঙ্গে আর্জেন্টিনার যোগাযোগ অন্য মাত্রার।

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন