বাংলাদেশে ট্যাপেস্ট্রি শিল্পের প্রবর্তক

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পর শিল্পী রশিদ চৌধুরী একজন স্বপ্নদর্শী হিসেবে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডসহ বাংলাদেশে শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার বিচরণ ছিল শিল্পের বহুবিদ শাখায়। তার হাত ধরেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের গোড়াপত্তন। অথচ অভিমান নিয়েই তিনি চট্টগ্রাম চারুকলা ছেড়ে চলে আসেন। বাংলাদেশের ট্যাপেস্ট্রি (তাপিশ্রী) শিল্পের প্রবর্তক রশিদ চৌধুরীকে নিয়ে কথা বলেছেন শিল্পী অধ্যাপক ঢালী আল মামুন

. আপনি চলতি বছরের মার্চে রশিদ চৌধুরীসহ অন্য দুজন শিল্পীর কাজ নিয়ে আধুনিকতার উত্তরাধিকার নামে একটি প্রদর্শনী কিউরেট করেন। এর প্রেক্ষাপট কী ছিল?

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পঞ্চাশ বছর চট্টগ্রামে চারুকলা শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিকতার পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে প্রদর্শনীটি আয়োজিত হয়। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের চারুকলা শিক্ষা সমান্তরালভাবে আধুনিকতাকে ফিরে দেখতে চেয়েছি। সে সূত্রেই চট্টগ্রাম চারুকলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠাতাসহ গোড়ার দিকের তিনজন শিল্পীকে বেছে নেয়া। যারা একই সঙ্গে আমাদের দ্বিতীয় পর্বের আধুনিক শিল্পীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পশ্চিমসহ সারা বিশ্বেই আধুনিকতা-ঔপনিবেশিকতা নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনা সমালোচনা শুরু হয়। আমাদের শিল্পচর্চার ইতিহাসে আধুনিকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। একই সঙ্গে ঔপনিবেশিক ইতিহাস আধুনিকতাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। প্রকারান্তরে তখন ঢাকার যে চারুকলা শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল সেটি একদিক থেকে যেমন ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার বহন করছিল, যা বস্তুত অক্ষিপটনির্ভর বাস্তবতার অনুসরণে। অন্যদিকে একদল শিল্পী এখানের পাশাপাশি ইউরোপ থেকে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করে এসে নতুন ধরনের শিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন রশিদ চৌধুরীর নেতৃত্বে। সে সময় ঢাকা চট্টগ্রামে কী ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ছিল, কতটা পার্থক্য ছিল সেগুলোকে নতুন করে দেখানোর ইচ্ছা এবং তাদের আধুনিকতার সঙ্গে অঞ্চলের কী ধরনের প্রাসঙ্গিকতা তারা তৈরি করেছেন, পূর্বসূরিদের সঙ্গে তাদের কী পার্থক্য, মিল-অমিল থেকে শুরু করে কী ধরনের সামগ্রিক বৈশ্বিক অবস্থার মোকাবেলা করতে হয়েছেগবেষণাধর্মী প্রদর্শনীর মাধ্যমে এসব যাবতীয় বিষয়কে দেখার চেষ্টা করেছি। প্রদর্শনীটি করতে গিয়ে আমাদের মূলত সংগ্রাহকদের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ছিল। রশিদ চৌধুরী নিয়ে গবেষণা করব কিন্তু তার ওপর তথ্য-উপাত্ত খুঁজে পাওয়ার জন্য বাংলাদেশে যেসব প্রতিষ্ঠান আছে তাদের কাছে আর্কাইভ ম্যাটেরিয়াল বলে কিছু নেই। আমাদের পুরোটাই নির্ভর করতে হয়েছে প্রাথমিক অভিজ্ঞতার ওপর। সঙ্গে কিছু তথ্য লেখা আমরা নিজেরা জোগাড় করেছি। আবার তার কাজের যারা সংগ্রাহক ছিলেন তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন, তাই আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রদর্শনীতে তার কাজগুলো আনতে পারিনি।

. বাংলাদেশে শিল্পকলায় রশিদ চৌধুরীর অবদানকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

১৯৪৭ সালের আগে আমাদের এখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প শিক্ষা কেন্দ্র ছিল না। ১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে ঢাকায় শুরু হয় গভর্নমেন্ট আর্ট ইনস্টিটিউট। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবসিডিয়ারি হিসেবে শুরু হয় চারুকলা। পরবর্তী সময়ে ১৯৭০ সালে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণের সুযোগসহ চারুকলা বিভাগ চালু হয়। সেখানে রশিদ চৌধুরী ছিলেন প্রথম শিক্ষক। ঢাকায় তখনো শুধু স্নাতক পর্যন্ত ছিল। উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণের সুবিধার সূত্রপাত চট্টগ্রাম চারুকলা থেকেই। আমি মনে করি বাংলাদেশে জয়নুল আবেদিনের পর রশিদ চৌধুরী একজন স্বপ্নদর্শী হিসেবে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডসহ শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি শুধু নিজেই শিল্পচর্চা করেননি, জনপদ সম্প্রদায় নিয়ে ভেবেছেন, শিল্প শিক্ষা ব্যবস্থাপনার প্রসার করেছেন এবং নতুন মাধ্যমেরও উন্মেষ ঘটিয়েছেন। যা ব্যাপক গবেষণা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আধুনিকতাবাদ পশ্চিমে যেভাবে চর্চিত হয়েছে এবং ষাটের দশকে আমাদের অঞ্চলে যেভাবে আছড়ে পড়েতার মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, বোহেমানিজম এসব অনুষঙ্গ দিয়ে আমাদের কবি, শিল্পীদের নানাভাবে আচ্ছন্ন করে। কিন্তু রশিদ চৌধুরী এখানে খানিকটা ব্যতিক্রম। তিনি

ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাকে ছাড়িয়ে সমষ্টির কথা ভাবছেন, প্রতিষ্ঠান গড়ার চেষ্টা করছেন। তিনি এমন সব মাধ্যমে কাজ করতে চেয়েছেন যেখানে একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রতিফলিত হয়। যেমন ট্যাপেস্ট্রি বা বয়নশিল্প। বয়নশিল্পের ঐতিহ্য আমাদের বহুকালের, এর সঙ্গে তিনি সংযোগ স্থাপন করেন। দেয়ালচিত্র বয়নশিল্পের সঙ্গে জনশিল্পের সম্পর্ক রয়েছে। আধুনিকতাবাদ যেখানে সিঙ্গুলারিটির কথা বলে, সেখানে একজন আধুনিক শিল্পী হয়ে রশিদ চৌধুরী সম্প্রদায়, সমষ্টিগত পন্থাট্যাপেস্ট্রি পল্লীর কথা ভেবেছেন। চারুকলা বিভাগের পর চট্টগ্রাম শহরে চারুকলা কলেজ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্যোক্তার মধ্যে তিনি অন্যতম। তার স্বপ্ন ছিল দুটি প্রতিষ্ঠানকে একত্র করে চট্টগ্রাম শহরে বৃহৎ পূর্ণাঙ্গ চারুকলা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা। এছাড়া চট্টগ্রাম শহরের একটি প্রান্তে হস্তশিল্প পল্লী কক্সবাজারে শিল্প গ্রাম তৈরির স্বপ্নও তিনি দেখতেন। আধুনিক শিল্পী হয়ে তিনি মাল্টিডিসিপ্লিনারি শিল্প চর্চা করেছেনট্যাপেস্ট্রির পাশাপাশি জলরঙ, গোয়াস, টেরাকোটা, ভাস্কর্য নিয়ে কাজ করেছেন।


. ষাটের দশকের শেষ দিকে তিনি তো না গ্রুপ সৃষ্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেনকী ধরনের চিন্তা থেকে গ্রুপটি করা হয়েছিল বলে জানেন?

প্যারিস থেকে ঢাকায় চলে আসার পর ১৯৬৪ সালের দিকে তিনি বুয়েটে স্থাপত্যকলায় খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেছেন। তখন তরুণ কবি-প্রকৌশলী-স্থপতিদের নিয়ে না গ্রুপ সৃষ্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। না নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করা হতো। না শব্দটির সঙ্গে আর্ট মুভমেন্ট দাদাইজমের সম্পর্ক রয়েছে। সবকিছুর মধ্যেই না এবং তা নিয়ে প্রশ্ন করা। তিনি কবিতা লিখতেন, ফরাসি কবিতা অনুবাদও করেছেন। না পত্রিকায়ও তা ছাপা হয়েছে। চট্টগ্রাম চারুকলায় তিনি যে শিক্ষা পাঠ্যক্রম তৈরি করেছিলেন তা ঢাকা চারুকলার থেকে অনেক বেশি স্বাধীন ছিল। অর্থাৎ একজন ব্যক্তির সৃজনশীল প্রক্রিয়া বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক পক্ষে ছিল। জার্মানিতে আধুনিকতাবাদের অন্যতম মুভমেন্ট বাউহাউস; স্থপতি শিল্পীরা এতে যুক্ত ছিলেন। বাউহাউসের কিছু মৌলিক নীতি তিনি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ব্যবহারিক শিল্প সৃজনশীল শিল্পের সীমানা এখানে তুলে দেয়া হয়। কারিগর সৃজনশীল শিল্পের মধ্যে কোনো বৈষম্য নেই। যেমন বয়নশিল্পের মধ্যে কারিগরের প্রয়োজন হয়। বাউহাউসকে তিনি কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন তার প্রতিফলন আমরা পাই। রশিদ চৌধুরী আধুনিকতাবাদকে বোঝার জন্য গভীর গবেষণা প্রয়োজন। যা এখনো হয়ে ওঠেনি।

. ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তান সরকারের দেয়া পুরস্কার বর্জন করেন।

পাকিস্তান সরকারের পুরস্কার ঘোষণার ঘটনায় তিনি ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে যান। একদিকে নিরাপত্তাহীনতা, অন্যদিকে অস্বস্তি। পুরস্কার বর্জন করতে তিনি গোপনে প্যারিস চলে যান। তখন হাবিবুল্লাহ খান তাকে সহযোগিতা করেন। তার সহধর্মিণী সালমা খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। ফরাসি সহধর্মিণী অ্যানি গ্রজি দুই কন্যাকে আগেই পাঠিয়ে দিয়ে কয়েক মাস পর রশিদ চৌধুরীও চলে যান। প্যারিসে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। রশিদ চৌধুরীর ওপর আলাউদ্দিন আল আজাদের জীবনী গ্রন্থমালা লেখা আছে, তিনি তার বন্ধুরা জঁ পল সার্ত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সার্ত্রে যেহেতু চীনা রাজনীতির প্রতি দুর্বল ছিলেন, তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আনার জন্য তারা সাক্ষাৎ করেন।

. চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর রশিদ চৌধুরীকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন?

চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ (তখন বেসরকারি কলেজ) থেকে আমি স্নাতক করি। মনে আছে চারুকলা কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করা আমি ছিলাম একমাত্র ছাত্র। সে সময় আমাদের ধারণা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে শিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে কলেজের পরিমণ্ডল অধিক সহায়ক। কলেজের বিদায়ী অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে রশিদ চৌধুরী ছিলেন। স্নাতক শেষ করে চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। পাশাপাশি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় স্নাতকোত্তর অধ্যয়ন করতে থাকি। কিন্তু আমি যখন এমএ করতে গেলাম তখন অল্প সময়ের মধ্যে রশিদ চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গেলেন। তবে তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় যোগাযোগ ছিল। নানা দিক থেকেই রশিদ চৌধুরী ছিলেন আমাদের প্রেরণা। তার চট্টগ্রামের নাসিরাবাদের নং রোডের বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। কথিত আছে এমন কোনো দিন নেই রশিদ চৌধুরী রেখা ছাড়া ছিলেন।

. শোনা যায় একধরনের অভিমান থেকে তিনি চট্টগ্রাম চারুকলা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন।

১৯৬৫ সালে ঢাকার সরকারি চারু কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে প্রাচ্যকলা বিষয়ের প্রথম শিক্ষক হিসেবে তিনি যোগদান করেন। এক বছর না যেতেই তৎকালীন আইয়ুব সরকারের আইন তৈরি হয়েছিল যে বিদেশী সহধর্মিণী থাকলে সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা যাবে না। হিসেবে তিনি চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তখন তিনি নতুন একটি অনিশ্চয়তায় পড়েন। সে সময় ১৯৬৯ সালে চারুকলা বিভাগ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি এমন হয়েছিল তিনি ছেড়ে আসতে বাধ্য হন। আমি তখন ছাত্র ছিলাম। শুধু এতটুকু বলব, অভিমান নিয়েই তিনি চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে আসেন। অথচ তার হাত দিয়েই বিভাগটি তৈরি হয়েছে। সম্ভবত ঢাকা চারুকলা থেকেও জয়নুল আবেদিনকে চলে যেতে হয়েছিল।

. রশিদ চৌধুরী তার অবদানের বিপরীতে যথাযথ সম্মান পেয়েছেন?

আবুল মনসুরের লেখা রশিদ চৌধুরীর জীবনীমূলক গ্রন্থে একটা চিঠি আছে। ১৯৮৪-৮৬ সালের দিকে, রশিদ চৌধুরী অনেকগুলো কাজের কমিশন প্রাপ্ত হয়েছিলেন, সেখানে অনেক অর্থও রয়েছে কিন্তু তার নিজের চিকিৎসা করার টাকা ছিল না। তখন তিনি জাতির উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লেখেন। চিঠিটি পড়ে আমার ভীষণ অসহায় লাগে। একজন গুণী মানুষকে যথার্থ প্রাপ্যটুকু নিশ্চিত না করতে পারাটা জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা বেদনার জায়গা। ক্ষতও।

সাক্ষাৎকার রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন