শিল্পকলা স্বদেশ বিদেশ

রশিদ চৌধুরী

সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দেশী-বিদেশী শব্দটা সম্প্রতি খুব চালু হয়েছে। কাউকে দেশী বলে উৎসাহিত এবং বিদেশী বলে একটু তাচ্ছিল্যের ইঙ্গিত সমালোচনায় স্থান পাচ্ছে। প্রবণতা একটি ভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। তা শিল্পকলাকে তার সামাজিক প্রয়োজন থেকে সরিয়ে নিয়ে শুধু ব্যক্তিস্বার্থের প্রয়োজনে ব্যবহূত হতে পারে বলেই আমরা শঙ্কিত। আমাদের দেশে যে ধরনের শিল্পচর্চা চলছে তার প্রধান প্রধান মাধ্যম উপকরণ সম্পূর্ণভাবে বিদেশী, সেই সঙ্গে বিষয়বস্তুর চূড়ান্ত রূপদান করা হচ্ছে ইউরোপীয় রোমান্টিক ভাবধারায়। তার মাঝেই কোথাও ছিটেফোঁটা দেশীয় ডিজাইন ঐতিহ্যবাহী মূর্তির ভাবভঙ্গি আকার-ইঙ্গিত সংযোগ করে শিল্পকর্মে দেশীয় প্রভাবের গুণকীর্তন করা হয়। যদিও বা সেই শিল্পকর্ম পুরোপুরি আধুনিক অব্যয় চিত্র হয়, সেখানে বাহ্যিক কিছু খুঁজে না পেলে প্রাচ্যের মানসিকতার গন্ধে তাকে দেশীয় বলে চালানোর প্রবণতা দেখা যায়। আসলে প্রবণতাই যে বিদেশী রোমান্টিকতার মূলমন্ত্র সেদিকে আমরা মোটেই দৃষ্টি রাখছি না। এখানে বলা বাহুল্য যে রোমান্টিকতার ক্রমসামন্ত সভ্যতার শেষভাগে ধনতন্ত্রের সংঘাতে লালিত হয়ে প্রসার লাভ করেছে পুঁজি বিনিয়োগ, সমাজে যে কারণে প্রকটভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বতন্ত্রতায় সে বিশ্বাসী।

 

আলোচনা দুভাগে ভাগ করব। প্রথমত, শিল্পকলা, দ্বিতীয়ত, দেশী-বিদেশী। শিল্পকলা প্রশ্নে এর স্বরূপ সম্পর্কে চিরন্তন সত্যটাই আরেকবার স্মরণ করা যাক। যে অর্থনৈতিক কাঠামোয় সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, সেই সমাজের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডেই তৈরি হয় অপসংস্কৃতি। আর শিল্পকলা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। একটি দেশ তার ভৌগোলিক সীমারেখার মাঝে বিশেষ আদর্শের প্রভাবে হয়, ব্যবস্থাই সংস্কৃতি। আর আদর্শেরই বাহক হয় শিল্পকর্ম। অনাদিকাল থেকে সমাজে শিল্পকর্মের ব্যবহার নিয়মেই চলছে। বিভিন্ন সমাজে শিল্পমাধ্যম, বিষয়বস্তু তার আঙ্গিকতায় পরিবর্তন ঘটেছে সামাজিক-অর্থনৈতিক আদর্শের পরিবর্তন-পরিবর্ধনে। একই ভৌগোলিক পরিবেশে যুগে যুগে যে বিভিন্ন শিল্প নিদর্শন আমরা পাই তার কারণও ঠিক একই। প্রাগৈতিহাসিক মানবকুল থেকে শুরু করে আজ অবধি যত সমাজ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, তার অর্থনৈতিক আদর্শের পরিপূর্ণ ছাপ সেই সময়ের শিল্পকলায় সুস্পষ্ট। তাই একটি দেশের জন্য প্রয়োজন যেমন অর্থনীতি, তেমনি অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে সমাজে শিল্পকলার প্রয়োজন অপরিহার্য।

 

এখন আসা যাক দেশী-বিদেশী প্রশ্নে। দেশ বলতে শুধু মানচিত্র নয়, বরং সেই মানচিত্রটিই চিরন্তন নয়। অর্থনৈতিক রাজনৈতিক কারণে তা পাল্টেছে। অর্থাৎ তার নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখা চিরকাল একভাবে সর্বত্র পাওয়া যায়নি। তাই একই দেশে বিভিন্ন সমাজ ব্যবস্থা যুগে যুগে চালু হয়েছে, সেই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের জন্য পূর্বাপরের শিল্পকলায় তারতম্যও ঘটেছে। ধরা যাক সাম্প্রতিক কালের একটি সমাজ ব্যবস্থা, যেমন যুক্তরাষ্ট্র। এখানে ৪০০ বছরের ইতিহাসে আদিম সমাজ ব্যবস্থার প্রচলন ছিল, যাদের আমেরিকান-ইন্ডিয়ান বলা হয়। এদের জীবনযাত্রা সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের শিল্পকর্মও ছিল ভিন্ন ধরনের। অর্থনৈতিক কারণে দেশ জয় করেছে ভিনদেশীরা, উপনিবেশ কায়েম করেছে। বহিরাগতরা নিজেদের ঐতিহ্যগত কৃষ্টি সংস্কৃতি ঔপনিবেশিক জীবনযাত্রার সঙ্গে প্রসার প্রচার দুটোই ঘটিয়েছে। ২০০ বছরেরও আগে সেখানে অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক পটভূমিরও পরিবর্তন হয়েছে, নতুন সমাজ ব্যবস্থা চালু হয়েছে। দেশের সাম্প্রতিক জীবনযাত্রা, আচার-ব্যবহারে পূর্বপুরুষের আদিম মাটির গন্ধ আর সেখানে পাওয়া যায় না। সেখানে জন্ম নিয়েছে এক নতুন ধরনের সংস্কৃতির, যাকে আজ আমরা আমেরিকান আর্ট, মিউজিক, সাহিত্য ইত্যাদি নামে শনাক্ত করছি। এমনিভাবে, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এমনকি এশীয় দেশগুলোতেও অনেক উদাহরণ দেখতে পাওয়া যাবে। 

 

তাই বলা উচিত, দেশীয় সংস্কৃতি বলতে নির্দিষ্ট কোনো ব্যাপার নেই, যা ঘটে তা তার অর্থনৈতিক কাঠামোর মাঝে। যাকে ঐতিহ্য বলা হয়, তা শুধু ইতিহাস, বর্তমান নয়। ঐতিহ্য একক কিছু নয়, বিভিন্ন বিস্তৃত। সূত্রে বর্তমানে জাপানের সাংসৃ্কতির জীবনে যে মজার ব্যাপারটি ঘটছে তা দুই ধরনের। একটি দেশীয় প্রভাবে প্রভাবান্বিত, অন্যটি মূলত বিদেশী ধারায়। জাপানের ঐতিহ্য প্রাচীন যুগে চীন দেশের প্রভাবে গড়ে উঠেছিল। পরবর্তী সামন্ত যুগে তা ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক ভৌগোলিক কারণে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্ররূপে বিকশিত হয়েছে। শিল্প, সাহিত্য, দৈনন্দিন জীবন, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান আলাদা হয়ে গড়ে উঠেছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে সামন্ত যুগের অবসান বাহ্যিকভাবে না ঘটলেও পাশ্চাত্য ধনতন্ত্রের প্রভাবে তাদের সংস্কৃতি নতুন রোমান্টিকতার দিকে সম্প্রসারণ হচ্ছে। কিন্তু সহজেই এখানে দুটি ধারার সংমিশ্রণ ঘটছে না শুধু একটি কারণে; তাদের ভৌগোলিক সীমারেখার নিহিত সবল অর্থনৈতিক কাঠামোর জন্য।

 

মোটকথা অর্থনৈতিক পরিবেশ কতটুকু সবল দুর্বল তারই ওপর নির্ভর করে শিল্পকলায় দেশ-বিদেশের প্রভাব। এখন আমাদের দেশের কথায় আসা যাক। বর্তমানে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক স্বরূপ কী বা ভৌগোলিক সীমারেখায় তা কতটুকু আবদ্ধ? যদি তা বিদেশী প্রভাবমুক্ত না হয়, তাহলে শিল্প-সংস্কৃতি আলাদা হবে? সেই সঙ্গে সবল দুর্বলের মাঝে রোগমুক্ত রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। প্রশ্নে আমাদের শিল্পকলায় দেশী-বিদেশী প্রভাবের মীমাংসা পাওয়া সম্ভব। যদি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির স্বরূপ আমরা দেখতে চাই, তবে আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো আমাদের ভৌগোলিক সীমানায় সুদৃঢ় করতে হবে। তা যদি জনগণের অর্থনীতি হয়, শিল্প-সাহিত্য তাহলে জনগণেরই হবে। নইলে রোমান্টিকতার আবরণে ব্যক্তিকেন্দ্রিক আত্মানুভূতির বহিঃপ্রকাশ হয়ে শুধু এক শ্রেণীস্বার্থের কালচারই হবে। তা দেশী-বিদেশী কোনোটাই নয়। শব্দ শুধুই রোমান্টিকতা।


 

১৯৮১ সালে চারুকলা কলেজের বার্ষিক প্রদর্শনীতে প্রকাশিত প্রবন্ধটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো। 

কৃতজ্ঞতা: বেঙ্গল ফাউন্ডেশন শিল্পী ঢালী আল মামুন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন