বড় হচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিধি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিশ্বব্যাপী বন্ড ইক্যুইটির বাজার সৃষ্টিতে অনবদ্য অবদান রাখছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) খাত। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বিতরণের মাধ্যমে শিল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আবাসন খাতের বিকাশ, অবকাঠামো উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে খাতটি। লিজ ফাইন্যান্স, কমার্শিয়াল পেপার, সিকিউরাটাইজেশনসহ আধুনিক আর্থিক সেবা উদ্ভাবনের পাশাপাশি পুঁজিবাজারকে প্রাণোদীপ্ত রাখার দায়িত্বও পালন করছে খাত। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে প্রত্যাশা অনুযায়ী এনবিএফআই খাতের বিকাশ হয়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।

গত বছরের জুন শেষে দেশের এনবিএফআইগুলোতে আমানতকারীদের হিসাব সংখ্যা ছিল লাখ ৮২ হাজার ৬৪১। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে চলতি বছরের জুনে এসে হিসাব সংখ্যা উন্নীত হয়েছে লাখ ৪৬ হাজার ৭০৬-এ। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ২০০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

পরিসংখ্যান বলছে, এনবিএফআইগুলোর আমানতকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে চলতি বছরে। চলতি ২০২২ সালের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) আমানতের হিসাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭১ শতাংশ। আর পরের তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) ৫২ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সব মিলিয়ে মাত্র এক বছরে এনবিএফআইগুলোতে লাখ ৬৪ হাজার ৬৫ নতুন আমানতকারী যুক্ত হয়েছেন।

এনবিএফআইয়ের আমানতকারীদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী। জুন পর্যন্ত লাখ ৫৬ হাজার ৬০৮ জন নারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে হিসাব খুলেছেন। আবার নারী উদ্যোক্তাদের গড়ে তোলা হাজার ৩৪০টি প্রতিষ্ঠানও হিসাব খুলেছে এনবিএফআইয়ে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট আমানতকারীর ২৯ শতাংশ এখন নারীদের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে অনেক ব্যাংকের চেয়েও বড় শক্তিশালী এনবিএফআই রয়েছে। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অপকীর্তির কারণে পুরো খাত নিয়ে কিছুটা সংশয় তৈরি হয়েছিল। তবে ধীরে ধীরে সংশয় কেটে যেতে শুরু করেছে। গত এক বছরে এনবিএফআই খাত ভালো প্রবৃদ্ধি পেয়েছে।

বিষয়ে এনবিএফআইগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) প্রেসিডেন্ট আইপিডিসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মমিনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমানে নিম্ন মধ্যবিত্ত গ্রাহকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তাদের অধিকাংশই সেভাবে আর্থিক সেবার আওতায় এখনো আসেননি। ফলে বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনার মাধ্যমে এনবিএফআইগুলোর ঋণ পোর্টফোলিওকে আরো বিস্তৃত করার বড় ধরনের সুযোগ রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা জরিপের ফলাফল বলছে, সারা বিশ্বে ব্যাংকের তুলনায় অর্থনীতিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ শক্তিশালী হচ্ছে। গত শতাব্দীর আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকের জামানতবিহীন ঋণের হার ছিল ৩০ শতাংশ। বর্তমানে ধরনের ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। বাজারভিত্তিক অর্থায়ন, বন্ড কমার্শিয়াল পেপারের মাধ্যমে বাজার দখলে নিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট ঋণের ৬৫ শতাংশই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক মন্দা-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ব্যাংকের ভূমিকা আরো দুর্বল হয়েছে। দেশটির ৮০ শতাংশ করপোরেট বিদেশী বন্ডের মালিকানা চলে গেছে মিউচুয়াল ফান্ড, বীমা কোম্পানি এবং পেনশন তহবিলগুলোর হাতে।

একইভাবে ব্যাংকের ভূমিকা দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিমত্তা বাড়ছে ইউরোপেও। গবেষণা প্রতিষ্ঠানব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টস’-এর গবেষণা বলছে, বর্তমানে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ৫০ শতাংশ হিসাবই নিয়ন্ত্রণ করছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা এনবিএফআইগুলো।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের অর্থনীতিতেও কার্যকর ভূমিকা রাখছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার কাছ থেকে নিবন্ধন নিয়ে দেশটিতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে হাজার ৫০৭টি এনবিএফআই। ভারতের শীর্ষস্থানীয় একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলো বাজাজ ফাইন্যান্স লিমিটেড। শুধু প্রতিষ্ঠানই ২০২০-২১ অর্থবছরে নিট মুনাফা করেছে হাজার ৪১৯ কোটি রুপি। লাখ ৩৮ হাজার কোটি রুপিতে গিয়ে ঠেকেছে প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের আকার। প্রতি বছর অন্তত হাজার কোটি রুপি নিট মুনাফা অর্জন করে ভারতে এমন এনবিএফআইয়ের সংখ্যাও কয়েক ডজন।

বাংলাদেশেও শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন লংকাবাংলা ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা শাহরিয়ার। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ঋণ পোর্টফোলিওর বৈচিত্র্যের পাশাপাশি পুঁজিবাজারের জন্য শক্তিশালী অঙ্গপ্রতিষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে লংকাবাংলা ফাইন্যান্স এরই মধ্যে দেশের আর্থিক খাতে জায়গা করে নিয়েছে। আরো কিছু এনবিএফআইয়ের অবস্থান অনেক ব্যাংকের চেয়েও শক্তিশালী। এনবিএফআই খাত এখন পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশে বন্ড মার্কেটের বিকাশও শুরু হয়েছে। আশা করছি, আগামীতে দেশের এনবিএফআই খাত শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড়াবে।

দেশের মোট ৩৪টি এনবিএফআইয়ের মধ্যে পাঁচটি জনগণের কাছ থেকে কোনো আমানত সংগ্রহ করে না। সরকারি খাতের তিনটির পাশাপাশি বিদেশী দুটি এনবিএফআইও তালিকায় রয়েছে। চলতি বছরের জুন শেষে এনবিএফআইগুলোতে জমাকৃত মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৮৬ কোটি টাকা। একই সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণকৃত ঋণ স্থিতির পরিমাণ ৬৯ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাসে এনবিএফআইগুলো থেকে হাজার ৮৩৯ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এনবিএফআইগুলোর ঋণগ্রহীতার সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। গত বছরের জুনে ঋণগ্রহীতার সংখ্যা ছিল লাখ ৮৬ হাজার ৪৯৯। চলতি বছরের জুন শেষে সংখ্যা লাখ ১৯ হাজার ৬৭৫- উন্নীত হয়েছে।

শিল্প, বাণিজ্য ভোক্তা ঋণকে প্রাধান্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে দেশের এনবিএফআইগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এনবিএফআইগুলো সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে শিল্প খাতে। মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩৯ শতাংশ শিল্প খাতে বিতরণ করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। টাকার অংকে শিল্প খাতে বিতরণ করা ঋণের বর্তমান স্থিতি ২৬ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। শিল্পের প্রায় প্রতিটি খাতেই বিনিয়োগ রয়েছে এনবিএফআইয়ের। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে হাজার কোটি, টেক্সটাইলে হাজার ৩৪০ কোটি, পাট পাটজাত পণ্যে ২৮০ কোটি, খাদ্য উৎপাদন শিল্পে হাজার ৯৫০ কোটি, প্লাস্টিক শিল্পে ৬৯০ কোটি, চামড়া চামড়া পণ্য উৎপাদন শিল্পে ২৮০ কোটি, ইস্পাত শিল্পে হাজার ৩৮০ কোটি, ফার্মাসিউটিক্যালসে হাজার ৬১০ কোটি, সিমেন্ট শিল্পে হাজার ৫৭০ কোটি, টেলিকমিউনিকেশন আইটিতে হাজার ১২০ কোটি, কাগজ মুদ্রণ শিল্পে হাজার ২৫০ কোটি, গ্লাস সিরামিক শিল্পে ৮১০ কোটি, জাহাজ নির্মাণ শিল্পে ৪৪০ কোটি, ইলেকট্রনিকস ইলেকট্রিক্যাল পণ্যে ৮০০ কোটি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি স্যানিটারি সেবায় হাজার ৫৫০ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে এনবিএফআইয়ের।

এনবিএফআইয়ের বিতরণকৃত ঋণের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাত হলো ট্রেড অ্যান্ড কমার্স। খাতে মোট ঋণের ২২ শতাংশের বেশি বিতরণ হয়েছে। ট্রেড অ্যান্ড কমার্স খাতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ১৫ হাজার ২৮৩ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এছাড়া ভোক্তা ঋণে ১০ হাজার ৬৪০ কোটি, নির্মাণ খাতে হাজার ৯৩৩ কোটি, যানবাহনে হাজার ৬৭৪ কোটি, কৃষিতে ৫২৩ কোটি এবং অন্যান্য খাতে হাজার ১১০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে।

বিশ্বব্যাপী এখন লেনদেনের বড় মাধ্যম হলো ক্রেডিট কার্ড। ১৯৯৭ সাল থেকে গ্রাহকদের ক্রেডিট কার্ড সেবা দিয়ে আসছে শীর্ষস্থানীয় এনবিএফআই লংকাবাংলা ফাইন্যান্স লিমিটেড। জনপ্রিয়তার দিক থেকে লংকাবাংলার ক্রেডিট কার্ড তুঙ্গে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির লক্ষাধিক গ্রাহক ক্রেডিট কার্ড সেবা উপভোগ করছেন। নেতৃস্থানীয় ব্যাংকগুলোর ক্রেডিট কার্ডের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে লংকাবাংলা।

এনবিএফআইয়ের সংখ্যা ৩৪ হলেও সারা দেশে এগুলো বিস্তৃত হয়নি। চলতি বছরের জুন পর্যন্তও সবকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শাখা সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩০১-এ। এর মধ্যে ১৭১টি শাখার অবস্থান ঢাকায়। এছাড়া এনবিএফআইগুলোর চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৫, রাজশাহীতে ২০, সিলেটে ১৯, ময়মনসিংহে ১৯, খুলনায় ১৬, রংপুরে বরিশালে ৫টি শাখা রয়েছে। তবে এনবিএফআইগুলো নিজেদের কার্যক্রম বাড়ানোর জন্য এরই মধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে।

১৯৯৩ সালের আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। আইন অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হলো বাংলাদেশ ব্যাংক। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতিপ্রণয়ন বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুটি বিভাগ রয়েছে। যদিও বিভাগ দুটির সক্ষমতা কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন বহুদিনের। পিকে হালদার কেলেঙ্কারির ঘটনা উন্মোচিত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট দুটি বিভাগ ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দ্রুততম সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণ, সঞ্চিতি সংরক্ষণ, শ্রেণীকরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন জারি করা হয়। সংস্কারকৃত নীতিমালাগুলো কার্যকর হলে খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণশৃঙ্খলা ফিরে আসবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন