নিম্নমধ্যবিত্ত গ্রাহককে আর্থিক সেবা প্রদানের বড় সুযোগ রয়েছে

দেশের বড় একটি জনগোষ্ঠী এখনো আর্থিক সেবার বাইরে রয়ে গিয়েছে। তাদেরকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় নিয়ে আসতে এনবিএফআইগুলো কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?

বাংলাদেশে প্রায় ৭৮ লাখ কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ (সিএমএসএমই) গ্রাহক রয়েছেন। তার মধ্যে কটেজ মাইক্রো অ্যান্ড স্মলই হচ্ছে ৬৮ লাখ। এদের ৯৮ শতাংশই কোনো ঋণ পায় না। আমাদের এখন অর্থনীতিতে প্রায় ২৫ শতাংশ এসএমইর অবদান। এর মানে হচ্ছে তাদের অবদানের অর্থমূল্য ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। আমাদের অর্থনীতি যখন হাজার বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে, তখন তাদের অবদান বেড়ে ৩৫ শতাংশে দাঁড়াবে। যার অর্থমূল্য হবে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার। ফলে এখানে বড় আকারের একটি জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সেবা প্রদানের সুযোগ রয়েছে এনবিএফআইগুলোর। বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে অতি দরিদ্রদের জন্য একটি বাড়ি, একটি খামার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এটার কিছু সাফল্য রয়েছে। আগে দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল, এখন নিম্নমধ্যবিত্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। নিম্নমধ্যবিত্ত যারা মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় করেন, তারাও বড় একটি জনগোষ্ঠী। তাদেরকে কিন্তু এনজিওরা কোনো সহযোগিতা বা সরকারও কোনো নিরাপত্তা দেবে না। ব্যাংক থেকেও তাদের অর্থায়ন সুবিধা নেয়ার সুযোগ কম। এক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি কাজ করতে পারে, তাহলে অনেক বড় সুযোগ আছে এখানে।

বিশাল জনগোষ্ঠীর আবাসন সুবিধা নিশ্চিতের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে এনবিএফআইগুলোর ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে?

আমরা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর গ্রাহকের জন্য সাশ্রয়ী আবাসন সুবিধা নিশ্চিতে চেষ্টা করছি। এজন্য আমরা আবাসন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে পরিকল্পনা করছি। আবাসন খাতে আইডিএলসি, লংকাবাংলার মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ অগ্রগামী। আমরা চেষ্টা করছি এখন ঢাকা চট্টগ্রামের বাইরে ছোট শহরগুলোয় আবাসনের দিকে নজর দেয়ার। এসব ছোট শহরে বেশির ভাগই এখনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্মিত অবকাঠামো। সেটার জন্য ছোট ছোট অংকের ঋণ দিতে হয়। এতে করে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ডেভেলপারদের সঙ্গে নিয়ে এসব শহরে কীভাবে কম জায়গা ব্যবহার করে বড় বড় ভবন নির্মাণ করা যায় সে পরিকল্পনা করতে হবে। নীতিগতভাবে সরকারের এখানে মনোযোগ দিতে হবে। ব্যক্তি যখন নিজেই কোনো ভবন তৈরি করে, তখন সেটির ভ্যালু এডিশন খুবই কম। বেসরকারি শহর তৈরির ধারণাটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত মফস্বল এলাকাগুলোয় যেটা গড়ে উঠছে সেখানে অন্যান্য নাগরিক সুবিধা পাওয়া যায় না। হাঁটার জায়গা থাকতে হবে, পার্ক থাকতে হবে, বাচ্চাদের খেলার জায়গা থাকতে হবে, প্রাথমিক বিদ্যালয়, সুপার মার্কেট থাকতে হবে। একটা গুড লিভিং কমিউনিটি উন্নয়ন করতে হবে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের এখানে প্রপার্টির রেজিস্ট্রেশন খরচ তুলনামূলক বেশি। কারণে সেকেন্ডারি মার্কেট সেভাবে গড়ে উঠছে না। তাছাড়া ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে অর্থনীতিতে কালো টাকাও তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে পুরনো একটি ফ্ল্যাট বিক্রি করে নতুন একটা কিনতে গেলে নতুনটার জন্যও রেজিস্ট্রেশন খরচ দিতে হচ্ছে, আবার পুরনোটা যখন বিক্রি হবে সেটিরও রেজিস্ট্রেশন করতে হচ্ছে। দুই জায়গায় বড় ধরনের ব্যয় করতে হচ্ছে। জায়গাটায় সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে। ৩০ লাখ, ৪০ লাখ টাকার মধ্যে থাকার ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে কর ছাড় দেয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আয়করের মতো স্ল্যাব করে দেয়া যেতে পারে।

পদ্মা সেতুসহ অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে?

পদ্মা সেতুর কারণে যে ২৩টি জেলার মধ্যে সংযোগ তৈরি হয়েছে সেখানে প্রথমেই নির্মাণ সামগ্রীর চাহিদা বাড়বে। এরপর কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের একটি বড় অংশ দক্ষিণবঙ্গে চলে আসবে। আমাদের দেশে অনেক জিনিস ভারত হয়ে আসে। অনেক কাঁচামালের জন্য ভারত চীনের ওপর আমরা নির্ভরশীল। বর্তমানে চীন থেকে যা আসে তার বেশির ভাগই চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে আসে, কিছু কিছু পায়রা বা মোংলা বন্দর হয়েও আসে। আর ভারত থেকে যা আসে তা বেনাপোল হয়ে আসে। পদ্মা সেতুর কারণে এসব পণ্য পরিবহনে সুবিধা হবে। হালকা প্রকৌশল শিল্পের ক্ষেত্রে আগে থেকেই যশোর পাশের অঞ্চলে একটা উপস্থিতি ছিল। সেটির এখন অনেক ভালোভাবে উন্নয়ন ঘটবে। কারণ এখন তো আর পরিবহনের জন্য পণ্য বানাবে না, শিল্প-কারখানার জন্যও বানাবে। একসময় জুটমিলগুলো সব ছিল খুলনায়। এখন কিন্তু সেগুলো বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এটা আবার আগের মতো করে ফিরে আসবে। ট্যুরিজম ওই এলাকায় অনেক বেশি বাড়বে। যমুনা ব্রিজ হওয়ার পর উত্তরবঙ্গে থেকে যে এগ্রো প্রসেসিং শুরু হয় সেটি প্রশংসনীয়। পদ্মা সেতু হওয়ার পরও আমরা সে রকম কিছু আশা করি। কারণ আগের চেয়ে এখন পণ্য বাজারে নিয়ে আসার কাজটি সহজ হয়েছে। আগের চেয়ে এখন অনেক কম সময় লাগবে। বড় বাণিজ্য গোষ্ঠীগুলোও এখন পদ্মা সেতুর ওই পাড়ে আগ্রহী হবে।

দেশের এনবিএফআইগুলো বর্তমানে কেমন করছে?

এসএমই, শিল্পায়ন, কৃষি, আবাসনসহ বিভিন্ন খাতে এনবিএফআইগুলো কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, সাপ্লাই চেইন ফাইন্যান্স স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোর জন্য আবাসন খাতে অর্থায়নের ক্ষেত্রে আমাদের এনবিএফআইগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে এর রেসপন্স টাইম বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর চেয়ে ভালো। অনেক সময় আমাদের কর্মীরাই গ্রাহকের কাছে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরির ক্ষেত্রে সহায়তা করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকের এসব কাগজ ট্রান্সলেট তৈরির কারিগরি সক্ষমতা থাকে না। এটা করা হয় কাজটা দ্রুত করার জন্য। বর্তমানে ডিজিটালাইজেশনের কারণে কাজগুলো অনেক সহজ হবে। একটা ছোট এসএমইকে অর্থায়ন করতে এখন যে পরিমাণ ইন্টারভেনশন করতে হয়, সেটি ধীরে ধীরে একটু সহজ হবে। আইপিডিসিসহ অন্য এনবিএফআইগুলো এক্ষেত্রে সার্বিকভাবে এগিয়ে আছে, কারণ ফ্যাক্টরিং বা ওয়ার্কঅর্ডার ফাইন্যান্স ফর এসএমইর দিন দিন চাহিদা বাড়ছে।

ঢাকার পর প্রথমবারের মতো যশোরে এনবিএফআই মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচিতি বাড়াতে এটি কী ভূমিকা রাখবে?

আমাদের সবচেয়ে বড় যে সীমাবদ্ধতা ছিল, শুধু কয়েকটা প্রতিষ্ঠান ঢাকার বাইরে এসএমই আবাসন খাতে অর্থায়নের সঙ্গে যুক্ত আছি। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই ঢাকা চট্টগ্রামভিত্তিক বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুক্ত। এনবিএফআইয়ের ছোট বাজারটা ধরার সুযোগ রয়েছে। এখানে আরো সুনির্দ্দিষ্টভাবে কাজ করা প্রয়োজন। এনবিএফআইয়ের পরিচিতি ঢাকা-চট্টগ্রামের বাইরে খুবই কম। আমাদের এখানে অবদান রাখার অনেক বড় সুযোগ আছে। মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, মানুষকে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানানোর বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের যশোরে বর্তমানে ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাচ্ছে। পদ্মা সেতু হওয়ার পর ওই অঞ্চলের আর্থিক কার্যক্রম জিডিপিতে শতাংশ অবদান রাখবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে। নতুন বিনিয়োগ ছাড়া এটি সম্ভব নয়। তাই এনবিএফআইগুলো যদি এখানে কার্যক্রম বাড়ায় তাহলে সেটি অনেক কাজে দেবে। এটা প্রতিটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য ভালো একটা সুযোগ এসএমইভিত্তিক অর্থায়নের জন্য প্রস্তুত হওয়া। এখন আমাদের যে পরিমাণ সুযোগ আছে, সেক্ষেত্রে একযোগে কাজ করলে অনেক ভালো হবে। ওই অঞ্চলে যে ব্যবসায়ীরা আছেন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যারা আছেন, তারা যদি এগিয়ে আসেন তাহলে এটার একটা ইতিবাচক প্রভাব তৈরি হবে। গ্রাহকের সঙ্গে আলোচনা, স্থানীয় পর্যায়ে প্রচার-প্রচারণা চালালে আমাদের ওপর মানুষের আস্থা বাড়বে, মানুষের জানাশোনা বাড়বে, আমরাও মার্কেট সম্পর্কে অনেক বেশি জানতে পারব। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে ভূমিকা থাকে সেটা আমরা অনেক ভালোভাবে করতে পারব। ব্যবসায়িকভাবেও আমরা ভালো করতে পারব। আমার মনে হয়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলভিত্তিক আমাদের কার্যক্রম আগামী ১০ বছরে আরো অনেক বেশি হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন