বাংলাদেশের গ্রামগুলোয় অনেক কিছু ঘটছে। আগের একটি কলামে আমি একে গ্রামীণ বাংলাদেশের রূপান্তরের দ্বিতীয় ধাপ নামে আখ্যা দিয়েছিলাম, যা ঘটেছে ২০০০-২০২০ সালের মধ্যে। এর আগে গ্রামীণ রূপান্তরের প্রথম ধাপ ঘটেছিল স্বাধীনতার পরের তিন দশকে। গ্রামীণ রূপান্তরের দ্বিতীয় ধাপ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা পেতে চাইলে ও এর জটিল প্রকৃতি বুঝতে চাইলে আমাদের প্রয়োজন নতুন ধরনের গবেষণা পদ্ধতি। এ বিষয়ে আমি বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ভেতর দিয়ে আমার সাম্প্রতিক সড়কপথের সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে চাই।
সনাতনী দ্বৈত ধারণার অসাড়তা
মাগুরার অন্তর্গত শিবরামপুর
গ্রামে শওকত নামের একজন কৃষক আমাকে
ড্রাগন ফল চাষের পদ্ধতি
ব্যাখ্যা করছিলেন।
ড্রাগন ফল একটি ভীনদেশী
ফল, যার উত্পত্তি মধ্য আমেরিকায়। ২০১৩-১৪ সালের
দিকে বাংলাদেশে
প্রথম এটির চাষ শুরু হয়। এ ফলটি জন্মায়
লতানো ফণীমনসাজাতীয় গাছে, যা ধীরে ধীরে নিজের
শেকড় বিস্তৃত
করে এবং আগেই স্থাপন
করে রাখা কংক্রিটের পোস্ট
বেয়ে উঠতে থাকে। কংক্রিটের
পোস্টটির ওপরের
অংশে একটি টায়ার বসানো
হয়, যার মাঝখানের অংশে দিয়ে গাছের
সবুজ শাখা-প্রশাখা বাইরে
বের হয়ে এসে চতুর্পাশে
ঝুলে থাকে।
স্বাদ
এবং স্বাস্থ্যগুণের কল্যাণে ড্রাগন ফল বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়
হয়ে উঠেছে।
২০২০ সালে ড্রাগন ফলের শীর্ষ রফতানিকারক
দেশ থাইল্যান্ড
এ ফল রফতানি করে ১ দশমিক
২ বিলিয়ন
ডলার আয় করে। এ তালিকায় ভিয়েতনামের
অবস্থান থাইল্যান্ডের কাছাকাছি। একই বছর বাংলাদেশের কৃষক ৮ হাজার
৬৬০ টন ড্রাগন ফল উৎপাদন করেন, যা এর আগের বছরের
ফলনের দ্বিগুণ।
ঝিনাইদহকে ধরা হয় এ ফলের বাণিজ্যিক
চাষাবাদের কেন্দ্র,
যেখানে বাংলাদেশের
মোট ফলনের
শতকরা ৩৯ ভাগ উৎপাদিত
হয়। অন্য জেলাগুলোর মধ্যে
যশোর, নাটোর
এবং বান্দরবান
জেলা এ ফলের প্রধান
উৎপাদক। ড্রাগন
ফল আগামীতে
বৈশ্বিক বাজারে
বাংলাদেশের অন্যতম
প্রধান লক্ষ হতে চলেছে।
এর চাষ করতে প্রয়োজন
একটি কংক্রিটের
পোস্ট, যা গ্রামীণ কুটির
শিল্পের একটি পণ্য। আবার এ গাছের
দরকার হয় রিসাইকেলড টায়ার,
যা একই সঙ্গে পরিবহন
শিল্প এবং রিসাইকেলিং শিল্পের
সঙ্গে যুক্ত।
আমরা ড্রাগন ফল চাষের আর্থসামাজিক প্রভাব গবেষণা করে কীভাবে গ্রামীণ রূপান্তরকে বুঝতে পারি? ড্রাগন ফল চাষকে শুধু কৃষি কাজ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা সম্ভব নয়। কৃষি এবং অকৃষি কাজের মধ্যকার সনাতনী বিভাজন ড্রাগন ফলের মতো কৃষি-শিল্পের মিশেলে চাষকৃত ফসলের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাছাড়া এটা চাষ করছে কারা? কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতে, ড্রাগন ফল চাষীদের সিংহভাগই শিক্ষিত এবং তরুণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফলের অর্ডারগুলো অনলাইনে বা সেলফোনের মাধ্যমে নেয়া হয় এবং কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ক্রেতাকে পৌঁছে দেয়া হয়। এ ফলের উৎপাদনপদ্ধতি এবং বাজারজাতের পুরো প্রক্রিয়া একটি নতুন গ্রামীণ ব্যবস্থার প্রমাণ দেয়।
সংক্ষেপে ড্রাগন ফলের বাণিজ্যিক চাষ একটি গ্রামীণ নব্য-আধুনিকতার প্রতিফলন, যা গ্রামীণ রূপান্তরের প্রথম ধাপের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রচলিত গবেষণা পদ্ধতি দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। কৃষি এবং অকৃষির দ্বৈত ধারণার বাইরে আমাদের নতুন পরিভাষার প্রয়োজন, যা আমাদের ড্রাগন ফল উৎপাদনের মতো কাজগুলোয় বিভিন্ন বাজার ও সামাজিক শক্তির জটিল প্রতিচ্ছেদ সম্পর্কে ধারণা দেবে।
রেমিট্যান্স প্রভাবের উন্নতি
গ্রামীণ জীবনে রেমিট্যান্সের পরিবর্তনশীল ভূমিকা বিবেচনা করুন। আমি যশোর-কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামের মানুষের কাছ থেকে রেমিট্যান্স অর্থনীতি এবং তাদের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে মতামত শুনেছি, আমার মনে হয়েছে যে রেমিট্যান্স গবেষণায় আরো উন্নত এবং সূক্ষ্ম অনুসন্ধানের প্রয়োজন। মানুষজন আমাকে বলেছে, কীভাবে পারস্পরিক যোগাযোগ এবং সামষ্টিক চেতনা একটি গ্রাম
বা গ্রামপুঞ্জের তরুণদের একই গন্তব্যে যেতে প্রভাবিত করেছে। সে গন্তব্য জেদ্দা, মাস্কট বা রোম যাই হোক না কেন!
কুষ্টিয়ার
মিরপুর উপজেলায়
এমন একটি
গ্রাম রয়েছে
যেখান থেকে
তরুণরা বিপুল
সংখ্যায় সৌদি
আরবে গিয়েছে।
গত জুনে
আমি ফ্রান্সের
দক্ষিণে আলবি
নামক একটি
ছোট মধ্যযুগীয়
শহরে একদল
বাংলাদেশী তরুণের
সঙ্গে দেখা
করি, যাদের
প্রায় সবাই
সিলেটের একটি
গ্রাম এবং শরীয়তপুরের অন্য
একটি গ্রাম
থেকে গিয়েছে।
তারা তাদের
ভবিষ্যৎ এবং তাদের মাতৃভূমির
সঙ্গে সম্পর্ক
বিষয়ে আমাকে
যা বলেছে
তা আমি মধ্যপ্রাচ্যের অভিবাসীদের কাছ থেকে যা শুনেছি তার থেকে কাঠামোগতভাবে ভিন্ন।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, স্থানীয় অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স প্রবেশের পাশাপাশি, আমাদের অভিবাসী কর্মীরা কী ধরনের মূল্যবোধ দেশে নিয়ে আসে এবং বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে এ মূল্যবোধের প্রভাব কি? এসব মূল্যবোধ তাদের ব্যবসায়িক বিনিয়োগকে কীভাবে প্রভাবিত করে? এসব বিনিয়োগের কারণে পরিবেশগত ও গ্রামীণ সামাজিক বন্ধনের ওপর কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়?
গ্রামীণ রূপান্তরের প্রথম ধাপে রেমিট্যান্সের ভূমিকা বোঝার জন্য অনেক গবেষণা করা হয়েছে। আশি এবং নব্বইয়ের দশকে নব্য-উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতি এবং বিশ্বায়ন উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমের জন্য এক ব্যাপক বৈশ্বিক চাহিদা তৈরি করেছিল। যার ফলে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশের কর্মীরাও বিদেশে, প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান শ্রমবাজারে নতুন সম্ভাবনা খুঁজে পায় এবং দেশে টাকা পাঠাতে শুরু করে।
রেমিট্যান্স গ্রামীণ রূপান্তরের প্রথম
ধাপে এত শক্তিশালী প্রভাবক
ছিল না যা দ্বিতীয়
ধাপে হয়েছে।
১৯৮০ সালে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয় ছিল ৩৩৯ মিলিয়ন ডলার।
এ আয় ১৯৯৩ সালে প্রথমবারের মতো ১ বিলিয়ন
ডলারের মাইলফলক
অতিক্রম করে। জিডিপিতে রেমিট্যান্সের অবদান ছিল ১৯৮০ সালে ১ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ১৯৯০ সালে ২ দশমিক ৫৮ এবং ২০০০ সালে এ অবদান ছিল ৪ দশমিক
১৬ শতাংশ।
গ্রামীণ রূপান্তরের
দ্বিতীয় ধাপে রেমিট্যান্স জাতীয়
অর্থনীতির একটি মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। রেমিট্যান্সের পরিমাণ
২০০১ সালে ২ বিলিয়ন
ডলার এবং ২০১০ সালে ১০ বিলিয়ন
ডলার অতিক্রম
করে। রেমিট্যান্স প্রবাহ ২০২১ সালে প্রথমবারের মতো ২০ বিলিয়ন
ডলারের সীমানা
অতিক্রম করে, যা একটি নতুন মাত্রা।
দারিদ্র্য হ্রাস, পুষ্টি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো সূচকগুলোর বাইরেও বাংলাদেশের গ্রামীণ সামাজিক কাঠামোয় রেমিট্যান্সের যে প্রভাব রয়েছে সে বিষয়ে আমাদের নতুন ধারার প্রশ্ন উত্থাপন জরুরি। অভিবাসীরা যেসব দেশে যাচ্ছেন সেসব দেশের স্থানীয় প্রভাবগুলো কী ধরনের? ইউরোপের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্যের রেমিট্যান্স প্রবাহ থেকে সৃষ্ট বিনিয়োগের ধরন কি? যারা ইউরোপে যান তাদের জন্য সেসব দেশে সামাজিক গতিশীলতা এবং নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ রয়েছে, কিন্তু যারা সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে যান তাদের জন্য এ ধরনের সুযোগ খুব কমই। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, পশ্চিমা দেশে বাংলাদেশের অভিবাসীরা পাশ্চাত্যের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, মূল্যবোধ ও উদ্যোক্তা-মানসিকতাকে কীভাবে রেমিট্যান্স অর্থের দেশীয় বিনিয়োগে সংযুক্ত করছেন? তার বিপরীতে মধ্যপ্রাচ্যের অভিবাসীরা তাদের অর্থনৈতিক বিনিয়োগে কী ধরনের উদ্যোক্তা-মানসিকতা ধারণ করছেন?
গ্রামীণ জীবনে মোবাইল প্রযুক্তির প্রভাব
মোবাইল প্রযুক্তি গ্রামীণ
রূপান্তরের দ্বিতীয়
ধাপের একটি বাস্তবতা। বাংলাদেশের
সেলফোন বাজারের
তথ্য-উপাত্ত
এ দাবিকে
সমর্থন করে। ১৯৯৭ সালে গ্রামীণফোন, একটেল
এবং সেবা টেলিকম চালু করা হয়েছিল।
২০০২ সালে মোবাইল সংযোগের
সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিটক ২০১২ সালে দেশের প্রথম
থ্রিজি নেটওয়ার্ক
চালু করে এবং পরের বছরই এক কোটি সংযোগের
লক্ষ্য পূরণ করে। ২০১৭ সালে সেলফোন
ব্যবহারকারীর সংখ্যা
মোট জনসংখ্যার
৫০ শতাংশ
ছাড়িয়ে গিয়েছে,
তার পরের বছর চালু করা হয় ফোরজি পরিসেবা।
এখন দেশের
গ্রামাঞ্চলে সেলফোন
ছাড়া একজন মানুষও খুঁজে
পাওয়া প্রায়
অসম্ভব।
মোবাইল ইন্টারনেট, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া, গ্রামীণ বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের বুনন কীভাবে বদলে দিচ্ছে? কীভাবে ফেসবুক এবং টিকটক গ্রামীণ তরুণদের চিন্তাধারাকে পরিবর্তন করছে? (বাংলাদেশে ৪৪ দশমিক ৭
মিলিয়ন ফেসবুক ব্যবহারকারী আছে, যা দেশের জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ। স্ট্যাটিস্টার মতে, ভারতের জন্য এ সংখ্যা ২৩ শতাংশ)। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সাম্প্রতিক জরিপ অনুসারে, ৯২ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারের একটি সেলফোন আছে এবং ৩৩ শতাংশ প্রতিদিন মোবাইলভিত্তিক ইন্টারনেট ব্যবহার করে।
আমি গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের মোবাইল ইন্টারনেটের মাধ্যমে
পোলট্রি ফিডের
মূল্যবিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করতে দেখেছি। কিন্তু
এটাও দেখেছি,
কিছু গ্রামীণ
যুবককে চায়ের
স্টলে মোবাইলভিত্তিক জুয়ায় লিপ্ত রয়েছে।
সেলফোনভিত্তিক নাগরিক
সাংবাদিকতা নারী ও শিশুদের
প্রতি সহিংসতার
বিরুদ্ধে একটি বড় প্রতিবন্ধক
হিসেবে আবির্ভূত
হয়েছে। মোবাইল
ভিডিওগুলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার
ঘটনায় অপরাধীদের
ধরতে সাহায্য
করেছে, অন্যদিকে
অপরাধীরা সেগুলেকে
অল্পবয়সী স্কুলছাত্রীদের ব্ল্যাকমেইল করতেও ব্যবহার
করেছে। গ্রামীণ
জীবনে সেলফোনের
প্রভাবের এ বৈপরীত্যকে গবেষণার
আওতায় আনতে হবে। গবেষকদের
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি
এবং কৃষি উৎপাদনশীলতার একমুখী
ধারণার বাইরে
যেতে হবে। তাদের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পরস্পরবিরোধী পরিণতি
এবং গ্রামীণ
এলাকার ওপর এর প্রভাবের
দিকে বস্তুনিষ্ঠ
মনোযোগ দিতে হবে।
গ্রামীণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান
বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায়
একবার গেলেই
যে কেউ একমত হবেন যে সেখানে
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর
উত্থান ঘটেছে,
যদিও সব অঞ্চলে তা একই রকম নয়। শহুরে
মধ্যবিত্তের মতোই গ্রামীণ মধ্যবিত্তের মাঝে ইলেকট্রনিকস (যেমন টেলিভিশন) এবং অ্যাপ্লায়েন্সের (যেমন ফ্রিজ) চাহিদা
রয়েছে। একই সঙ্গে গ্রামীণ
মধ্যবিত্ত নগর মধ্যবিত্তের মতো সম্পদ প্রদর্শন
করার একটি গোপন ইচ্ছা
পোষণ করে। গ্রামে গেলে প্রায়ই দেখা যায়, সবুজ এবং বিস্তীর্ণ
ধানখেতের বুক চিরে উঠছে কৌলিন্যপ্রত্যাশী রঙচঙা
অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং,
যা গ্রামীণ
মধ্যবিত্তের উত্থানের
একটি প্রকট
চিত্র।
আমি একটি বৃহৎ গ্রামীণ কনভেনশন সেন্টার পরিদর্শন করছিলাম যেখানে একটি বিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী বিয়ে অনুষ্ঠিত হতো বাড়ির উঠোনে টাঙানো শামিয়ানার নিচে, আজ যা চলে গেছে
শহরের আদলে তৈরি গ্রামীণ কনভেনশন সেন্টারে। এ ধরনের সেন্টারের প্রায়ই দেখা মেলে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। গ্রামীণ মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক সক্ষমতা পরিমাপের আরেকটি মানদণ্ড হলো গ্রামাঞ্চলে শহরসুলভ বিজ্ঞাপনের বিস্তৃতি। ব্যক্তিগত বসতবাড়ি আর বাজারের দেয়ালে আজ শোভা পায় ‘স্মার্ট’ লুঙ্গি, টুথপেস্ট, সেলফোন, সিলিং ফ্যান, নুডলস, টেলিভিশন, দেয়ালের রঙ আর পানির ট্যাংক থেকে শুরু করে অগণিত পণ্যের রঙিন আর বাহারি বিজ্ঞাপন।
কিন্তু এর মাঝেও আমি শহুরে মধ্যবিত্ত এবং গ্রামীণ মধ্যবিত্ত শ্রেণী দুটোর মধ্যে একটি বিশেষ পার্থক্য লক্ষ করেছি। গ্রামীণ মধ্যবিত্ত সমাজ একদিকে ক্রমবর্ধমান ভোগবাদী মানসিকতা এবং আরেকদিকে কৃষিজমির প্রতি আনুগত্য, এ দ্বিমুখী সংকটের মাঝে আটকে পড়েছে। একদিকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, সামাজিক গতিশীলতা, বস্তুবাদ এবং ক্ষণস্থায়ী কর্মজীবনের মধ্যে নিহিত মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ ধীরে ধীরে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। অন্যদিকে জীবিকার উৎস হিসেবে এবং বংশানুক্রমিক পরিচয় হিসেবে ভূমির প্রতি এক ধরনের সহজাত শ্রদ্ধার ব্যাপারও আছে। অনেক গ্রামীণ পরিবারের সঙ্গে আলাপের পর আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আধুনিক জীবনযাত্রার গতিশীলতা এবং পৈতৃক ভিটার প্রতি টান, এ দুটির টানাপড়েন আর শক্তিশালী বৈপরীত্য কীভাবে একটি উদীয়মান শ্রেণীর পরিচয়ের রাজনীতি গ্রামীণ জীবনবোধকে প্রভাবিত করছে তা জানা খুবই জরুরি।
পূর্ববাংলায় কৃষির ইতিহাস এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দীর্ঘ ছায়ার প্রেক্ষাপটে, এ দ্বিধাদ্বন্দ্ব শহুরে মধ্যবিত্তের থেকে একেবারেই আলাদা, যদিও শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীরও গ্রামের জমির সঙ্গে একটি সম্পর্ক রয়েছে। ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহর ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে—‘শহুরে শ্রেণীর সংস্কৃতির জগৎ কঠোরভাবে মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল, যা গ্রামীণ ভূমির চর্বি দ্বারা পরিপুষ্ট হলেও তা কৃষক জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল।’ আমার পিতা নিজেও তার পেশাগত চাকরির মাধ্যমে শহরে তার পরিবারকে লালনপালন
করেছেন, কিন্তু তিনি গ্রামে তার উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এবং অর্জিত জমি থেকেও আয় করেছেন। এটি শহুরে অনুপস্থিত জমিদারত্বের একটি প্রচলিত ঘটনা।
কিন্তু আজকের ক্রমবর্ধমান গ্রামীণ মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিজের জমির সঙ্গে সহাবস্থান করছে। এ জমি একই সঙ্গে একটি সম্পদ এবং একটি বোঝা। সম্পদ, কারণ এটি কোনো না কোনোভাবে জীবিকা উপার্জন অব্যাহত রাখে। বোঝা, কারণ কৃষকের সন্তানেরা জমি ও কৃষির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকাকে তাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে প্রবেশের পথে বাধা হিসেবে দেখে। এটি গ্রামীণ বাংলাদেশে যে ‘ব্যক্তিত্ব বিপ্লব’ ঘটে গিয়েছে বলা হয় তার আরেকটি উল্টো দিক। গ্রামজুড়ে কৃষিশ্রমের অপ্রতুলতা আজকের বাস্তবতা, যদিও কৃষির যান্ত্রিকীকরণ, উচ্চফলনশীল জাতের উদ্ভাবন এবং বাণিজ্যিক কৃষি মোট কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করছে।
আমি বিশ্বাস করি, আমরা এখনো গ্রামীণ রূপান্তরের দ্বিতীয় ধাপকে সম্পূর্ণরূপে বুঝতে পারিনি, যা বিভিন্ন মাত্রায় এবং বিস্তৃত আঞ্চলিক বৈচিত্র্যে ঘটে চলেছে। এটা ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদের নতুন গবেষণা পদ্ধতি দরকার। একে প্রথম ধাপের রূপান্তরের দৃষ্টিতে দেখলে চলবে না। আমাদের ডিসিপ্লিনভিত্তিক সীমাবদ্ধতার বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে নতুন ধারার গবেষণার প্রয়োজনে। গ্রামীণ রূপান্তর ২ দশমিক শূন্য বুঝতে হলে দরকার মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি গবেষণা।
উপরন্তু আমাদের প্রয়োজন নতুন প্রজন্মের বহুমুখী গবেষণা অ্যাজেন্ডা যা মাঠপর্যায়ের গবেষণার পাশাপাশি ‘এমপিরিকাল’ নিশ্চয়তাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে। ‘কোয়ান্টিটেটিভ অ্যানালাইসিস’ ঐতিহাসিকভাবে আমাদের বস্তনিষ্ঠ গবেষণাকে শক্তি জুগিয়েছে, যার যৌক্তিকতা তথ্য ও গাণিতিক প্রমাণ দ্বারা যাচাই করা গিয়েছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নই শেষ কথা নয়, আর অমর্ত্য সেনের উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যক্তির মুক্তি—এ ধারণাগুলোকে যদি গ্রহণ করি, তাহলে আমরা দেখতে পাব যে গ্রামীণ রূপান্তরের দ্বিতীয় ধাপ সহজাতভাবেই বহুমুখী, পরস্পরবিরোধী এবং একক লক্ষগামী নয়। উন্নয়ন মানেই যে সবাই একই লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছে তা কিন্তু নয়।
কুষ্টিয়ার কাতলমারী গ্রামের একজন কৃষক আমাকে বলেছিলেন, ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া সমষ্টিগত উন্নয়নের সংজ্ঞার দাসত্ব না করে নিজের যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু কাজ করার স্বাধীনতাকেই মূল্য দিতে বেশি পছন্দ করেন তিনি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি জাতীয় উন্নতির চরকায় তেল দেয়ার চেয়ে নিজের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং নিজে যা হতে চান তাতেই গর্বিত অনুভব করেন। নব্য কৃষকের মন বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করি। কুষ্টিয়া জেলার একটি স্থানে, আমার সহকর্মী স্থপতি ফয়সাল কবিরের সঙ্গে একটি গ্রামীণ রাস্তায় গাড়িতে যাওয়ার সময়, আমি হঠাৎ একটি বাস্তব জীবন-নাটকের মুখোমুখি হই। তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নামলাম। এটি দেখার মতো একটি দৃশ্য ছিল: আনুমানিক ২০ বছর বয়সের দুটি মেয়ে, আত্মবিশ্বাসী, মনোযোগী ও স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় সাইকেলে প্যাডেল চালিয়ে যাচ্ছিল। একজনের পরনে ছিল হিজাব, অন্যজনের খোলা চুল, সুন্দরভাবে ক্লিপে আটকানো, তার কাছে ছিল একটি ব্যাকপ্যাক। আমি আমার সহকর্মী ও গাড়িচালককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এ মেয়েরা কোথায় যাচ্ছে। দুজনেই আমাকে বলেছিলেন, তারা সম্ভবত এনজিও কর্মী, তাদের গ্রামীণ কার্যালয়ের পথে সাইকেলে চলছে।
দৃষ্টিসীমানা থেকে হারিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমি ভাবছিলাম আসলে তারা কোথায় যাচ্ছে। তারা ছুটে যাচ্ছে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের দিকে।
ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ: স্থপতি, স্থাপত্য ইতিহাসবিদ,
নগরবিদ এবং গবেষক; ওয়াশিংটন
ডিসির ক্যাথলিক
ইউনিভার্সিটি অব আমেরিকার অধ্যাপক
ও ব্র্যাক
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার
ফর ইনক্লুসিভ
আর্কিটেকচার অ্যান্ড
আরবানিজমের নির্বাহী
পরিচালক