অভিমত

অর্থনীতিতে ডলার সংকটের প্রভাব

মো. তানজিল হোসেন

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে কারণ আমদানি রফতানি বাণিজ্য ইউএস ডলারের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। একটি দেশে ডলারের দাম নির্ভর করে মূলত ডলারের চাহিদা জোগানের ওপর। ডলারের চাহিদা যদি জোগানের চেয়ে বেশি হয় তবে ডলারের দাম বাড়বে। আর ডলারের চাহিদা যদি জোগানের চেয়ে কম হয় তবে ডলারের দাম কমবে। ইদানীং আমাদের দেশে ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছে। ডলারের জোগান আসে মূলত রফতানি বাণিজ্যের আয়, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের রফতানি আয় রেমিট্যান্স থেকে। আর ডলারের চাহিদা হয় পণ্যসামগ্রী সেবা, শিল্পের কাঁচামাল যন্ত্রপাতি ক্রয়, বিদেশে শিক্ষা চিকিৎসার খরচ মেটাতে। সেপ্টেম্বরে রফতানি আয় কমেছে দশমিক ২৫ শতাংশ এবং রফতানি কমেছে ১০ দশমিক ৮৪, কিন্তু জুলাইয়ে আমদানি খরচ ব্যয় বেড়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে। টাকার মান কমে যাচ্ছে এবং আমদানীকৃত পণ্যের মূল্য বেড়ে যাচ্ছে ফলে ভোজ্যতেল, আমদানীকৃত ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। অন্যদিকে জনসাধারণের আয় না বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের ভোগ কমাতে হচ্ছে, এতে জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। রফতানি আয় রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার কারণগুলো কী কী তা খুঁজে বের করতে রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো, প্রবাসীকল্যাণ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তদন্ত কমিটি করে কারণ অনুসন্ধানের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা অতি শিগগিরই গ্রহণ করতে হবে।

যেমন করোনা-পরবর্তী পাট পাটজাত পণ্যের রফতানি আয় স্বাধীনতা-পরবর্তী সবচেয়ে বেশি বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু বছরে আমরা দেখতে পেলাম পাটচাষীরা কাঁচাপাটের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না আবার কাঁচাপাট জাগ দেয়ার জন্য আগে নদীনালা, খালবিলে পানি থাকত কিন্তু বর্তমানে নদীনালায় পাট জাক দেয়ার জন্য যথেষ্ট পানি পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কৃত্রিম খাল কেটে পানি সংরক্ষণ করে সেখানে পাট জাগ দেয়া হচ্ছে। ফলে পাটের উৎপাদন খরচ বেড়ে গিয়ে পাটচাষীদের মুনাফা কমে যাচ্ছে। কারণে ভবিষ্যতে পাটের উৎপাদন কমবে এবং পাট পাটজাত পণ্যের রফতানি আয় কমবে। তাই সমস্যাগুলো এখন থেকেই সমাধান করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে পাট পাটজাত পণ্যের রফতানি আয় না কমে। এভাবে রফতানি পণ্যগুলোর রফতানিতে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। তাছাড়া বিদেশে টাকা পাচার বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের একটি অন্যতম প্রধান কারণ। আইনের শাসন শক্তিশালী করে অর্থনৈতিক গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে যাতে বিদেশে টাকা পাচার না করতে পারে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে পারে সে বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

 রফতানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েস আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েস এর মাধ্যমে ডলারসংশ্লিষ্ট বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হচ্ছে কিনা কর্তৃপক্ষকে সজাগ থাকতে হবে। তাছাড়া যে পণ্যের রফতানি কমেছে তার কারণ কি খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের রফতানি বাণিজ্যের মূল সমস্যা আমরা প্রচলিত কিছু পণ্য যেমনতৈরি পোশাক, ওষুধ, কাঁচা চামড়া, চা, পাটসহ কিছু পণ্য রফতানি করি, আমাদের রফতানি পণ্যের ক্ষেত্রে কৃষি পণ্য বেশি। পাশের দেশ ভারত কম্পিউটার সফটওয়ার রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, আমাদের জনশক্তিকে দক্ষ করে আমরা কম্পিউটার সফটওয়ার তৈরি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। বর্তমানে পণ্যের রফতানি আয় অত্যন্ত নগণ্য। আয় ব্যাপকভাবে বাড়তে হবে। কৃষিপণ্যের রফতানি করি বেশি পরিমাণ কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয় কম, কারণ কৃষিপণ্যের দাম তুলনামূলক কম হয়। আমাদের অধিক পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে হলে অবশ্যই শিল্প পণ্যের রফতানির ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। ইদানীং বাংলাদেশের ওয়ালটন কিছু পণ্য যেমনটেলিভিশন, বাইসাইকেল রফতানি করছে। এভাবে আরো বেশি দেশীয় কোম্পানি তৈরি করতে হবে, যারা শিল্প পণ্য রফতানি করতে পারে। এজন্য সরকারকে কার্যকর নীতিসহায়তা প্রণোদনা প্রদান করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানোর জন্য রফতানি আয় রফতানি বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপের পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদি কিছু সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে সরকার গ্রহণ করেছে যেমন সরকারি কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করা। আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশ চলে যায় বিদেশে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পিত উন্নয়ন অনিয়ম দূর করতে পারলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় সম্ভব হবে, যা ডলারের চাহিদা কমিয়ে ডলারের মূল্যহ্রাস করতে ভূমিকা পালন করবে।

রিজার্ভ সংকটের একটি সম্ভাব্য সমাধান হলো আইএমএফের ঋণ গ্রহণ। প্রায় এক বছর যাবৎ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে। তবে ঋণ প্রদানের আগে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ঋণখেলাপি বিষয়ে আইএমএফের রিজার্ভেশন রয়েছে। ঋণ পেলে ডলার সংকট আপাতত মোকাবেলা করতে পারলেও ২০২৩ সাল থেকে ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশকে যথেষ্ট চাপের মুখে পড়তে হবে। তাই সে বিষয়েও প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে।

 রফতানি বাণিজ্যের আয় রফতানি কমে যাওয়ার পরিপেক্ষিতে বিদেশে বাংলাদেশী মিশনে কূটনীতিকদের সেসব দেশের সরকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আমাদের রফতানি পণ্যের গুণাগুণ তুলে ধরে রফতানি পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির মাধ্যমে রফতানি আয় বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের সর্বাধিক রফতানি আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের কূটনৈতিক মিশনগুলোকে সে দেশে কর্মরত শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে এবং এসব দেশে আরো বেশি শ্রমিক নেয়ার জন্য সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিদেশে অধিক শ্রমিক নিয়ে যেতে পারলে রফতানি বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কমবে।

 

মো. তানজিল হোসেন: সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন