বর্তমান সরকারের অন্যতম
লক্ষ্য ক্যাশলেস
সোসাইটি গড়ে
তোলা। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন
ধরনের পেমেন্ট
ব্যবস্থা চালু
করা হয়েছে।
ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডের
পাশাপাশি মোবাইল
ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসও
প্রত্যন্ত অঞ্চলে
ব্যাংকিং সেবা
পৌঁছে দিচ্ছে।
এজেন্ট ব্যাংকিং
থেকে শুরু
করে নতুন
নতুন ব্যাংকিং
সেবা সম্প্রসারিত হচ্ছে। তার পরও
ব্যাংকের বাইরে
থেকে যাচ্ছে
বিপুল পরিমাণ
অর্থ, যা সরকারের হিসাবের
আওতায় আসছে
না। ফলে
অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গতকাল
বণিক বার্তায়
প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিপুল
পরিমাণ নগদ
অর্থের বড় অংশ অবৈধ
অর্থে পরিণত
হয়েছে। এ অর্থ দেশের
বাইরে পাচারের
পাশাপাশি ব্যবহার
হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত লেনদেনে। এতে জমি,
ফ্ল্যাটসহ স্থাবর
সম্পত্তির দাম
অস্বাভাবিক বাড়ছে।
সরকারও বছরের
পর বছর
অপ্রদর্শিত ও অবৈধ অর্থ
বৈধ করার
সুযোগ দিয়ে
চলছে।
স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন
সরকার অন্তত
২০ বার
কালো টাকা
বৈধ করার
সুযোগ দিয়েছে।
কিন্তু ১৮০
কোটি টাকার
বেশি সাদা
করা হয়নি।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটেও
বিদেশে অর্জিত
স্থাবর সম্পত্তি
দেশে না আনলে এর ওপর ১৫ শতাংশ, অস্থাবর
সম্পত্তির ক্ষেত্রে
১০ এবং
নগদ অর্থের
ওপর ৭ শতাংশ কর দিয়ে অর্থ
বৈধ করার
সুযোগ দেয়া
হয়েছে। এখন
পর্যন্ত কালো
টাকা বিনিয়োগ
জমি, বাড়ি
ও ফ্ল্যাট
কেনার মধ্যেই
সীমাবদ্ধ ছিল।
এখন কালো
টাকার গন্তব্য
মূলত অন্য
দেশ। সুইস
ব্যাংকে আমানত
করা হয়, কানাডা বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আংশিকভাবে বা ট্যাক্স
হেভেন হিসেবে
পরিচিত অন্যান্য
দেশে, কোম্পানি
গঠন বা সম্পত্তি কেনার
জন্য পাঠানো
হয়। বিভিন্ন
দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি,
দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, গ্রুপ অব কোম্পানি
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, থাইল্যান্ড, আবুধাবি, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে প্রচুর
বিনিয়োগ করে।
তুরস্ক সম্প্রতি
সেকেন্ড হোম
প্রকল্প চালু
করেছে। বাংলাদেশের অন্তত ২০০ বিত্তবান
অর্থ পাচারকারী এ প্রকল্পের মাধ্যমে
তুরস্কের নাগরিকত্ব গ্রহণের জন্য আবেদন
করেছে। আরো
অনেক দেশ
পরোক্ষভাবে পাচারকৃত
অর্থকে স্বাগত
জানাচ্ছে। কানাডার
বেগমপাড়ায় বাংলাদেশীদের ব্যাপক উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একবার প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন,
কানাডার বেগমপাড়ায় যেসব বাংলাদেশীর বাড়ি
রয়েছে, তাদের
বেশির ভাগই
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মকর্তা অথবা
বর্তমান কর্মকর্তা। তারা নানা উপায়ে
বিস্তর অর্থকড়ি
সঞ্চয় করে
কানাডায় বাড়ি
ক্রয় করেছে।
ফ্রেডরিক স্লাইডারের মতে, বাংলাদেশে কালো
টাকার পরিমাণ
জিডিপির প্রায়
২৮ শতাংশ।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল
মুহিতের উদ্যোগে
২০১১ সালে
অর্থ মন্ত্রণালয় একটি জরিপ চালায়।
‘বাংলাদেশের অপ্রকাশিত অর্থনীতির আকার: একটি
অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ’
শীর্ষক জরিপ
অনুযায়ী, বাংলাদেশে কালো টাকার হার
জিডিপির সর্বনিম্ন ৪৬ শতাংশ থেকে
সর্বোচ্চ ৮১ শতাংশ পর্যন্ত
(১৯৭৩-২০১০)। তত্ত্বাবধায়ক সরকার
অর্থ উদ্ধারের
জন্য একটি
মার্কিন সংস্থা
ফায়ারফক্সকে নিয়োগ
করেছিল। কিন্তু
কোনো সমাধান
ছাড়াই শেষ
হয়ে যায়
এ প্রচেষ্টা।
মানি
লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিশ্বের
অনেক দেশ
নগদ অর্থের
লেনদেনের পরিমাণ
কমিয়ে ডিজিটাল
লেনদেনে বেশি
উৎসাহিত করছে।
আন্তর্জাতিকভাবে মানি
লন্ডারিং প্রতিরোধ
কার্যক্রম তদারককারী সংস্থাগুলোও এ নীতি
গ্রহণ করতে
সদস্য দেশগুলোকে উৎসাহিত করছে। এ কারণে বাংলাদেশেও নগদ অর্থের লেনদেন
কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। ২০১৭ সালে
ভারতে জাল
ও কালো
টাকার বিস্তার
ঠেকাতে মোদি
সরকার বড় অংকের নোট
ডিমনিটাইজ করেছিল।
এর ফলে
ভারতে ডিজিটাল
লেনদেনের বেশ
প্রসার ঘটে।
তবে বাংলাদেশের মতো ভারতেও দৈনন্দিন
লেনদেনের সিংহভাগ
এখনো সম্পন্ন
হয় নগদ
অর্থে। সারা
দেশে লাখ
লাখ মুদি
ও মনিহারি
দোকান, হোটেল,
রেস্তোরাঁ, ফার্মেসি
রয়েছে, রয়েছে
স্কুল-কলেজ,
বাস, ট্রেন,
লঞ্চ পরিবহন
ও কল-কারখানা। এসব
প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে
লেনদেন সবটাই
প্রায় নগদনির্ভর। সহজ, সাশ্রয়ী বিকল্প,
প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর ঘাটতি ও বিকাশমান
ডিজিটাল পরিশোধ
ব্যবস্থা সম্পর্কে
যথাযথ ধারণার
অভাব এবং
মানুষের দীর্ঘকালীন অভ্যাস এর মূল
কারণ। নগদ
লেনদেনে ঝুঁকি
ও ঝামেলা
থেকে নিস্তারের উপায়গুলো সামনে আসছে
এবং প্রযুক্তির কল্যাণে বিকল্পেরও উদ্ভব
ও ব্যবহার
শুরু হয়েছে।
উন্নত দেশগুলোয়
নগদের ব্যবহার
ক্রমে হ্রাস
পাচ্ছে। নগদ
অর্থে সব থেকে কম লেনদেন হয় সুইডেনে। সুইডেনের
প্রাপ্তবয়স্ক ৯৯ ভাগ মানুষ
লেনদেনের জন্য
প্রিপেইড কার্ড
বা ডিজিটাল
অন্য মাধ্যম
ব্যবহার করে
এবং সার্বিক
অর্থনৈতিক লেনদেনের
প্রায় ৬০ ভাগ নিষ্পন্ন
হয় ডিজিটাল
পদ্ধতিতে। ক্যাশ
লেনদেনে অনিচ্ছুক
দেশের তালিকায়
দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে
রয়েছে কানাডা
ও যুক্তরাজ্য। বাংলাদেশে ক্যাশবিহীন লেনদেন
শুরু হয়েছে।
এর মাত্রা
আরো বাড়াতে
হবে। নগদ
লেনদেন কমিয়ে
আনা গেলে
অবৈধ অর্থের
পরিমাণও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, নির্দিষ্ট একটি অংকের বেশি লেনদেন হলেই তা অনলাইন বা ডিজিটাল পদ্ধতিতে করতে হবে। ওই অংকের নিচে হলে নগদ আকারে করা যাবে। এখন নির্দিষ্ট অংকটি ঠিক করার ব্যাপারে একটি কমিটি কাজ করছে। ওই অংক নির্ধারিত হলে এর বেশি অর্থ অনলাইনের মাধ্যমে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট, এটিএম বুথ, মোবাইল ব্যাংকিংসহ অনুমোদিত বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে স্থানান্তর করা যাবে। তবে সব ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট খাতের বিধি মেনে করতে হবে। বর্তমানে নগদ লেনদেন করার সর্বোচ্চ কোনো সীমা নেই। ফলে যেকোনো অংকের অর্থই নগদ লেনদেন করা যায়। এ কারণে বড় অংকের লেনদেন হলে নগদ টাকার চাহিদা বেড়ে যায়। নগদ লেনদেনে হিসাবের স্বচ্ছতা কম, দুর্নীতির শঙ্কা বেশি। নগদ ব্যবসার টাকা সরিয়ে ফেলা বা বেহাত হওয়া সহজ। ফলে আয়-ব্যয়ের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। এতে মালিকের ক্ষতি হয়, কর্মচারীদের প্রতি অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়, সরকার রাজস্ববঞ্চিত হয়। অনেক ক্ষেত্রেই নগদ লেনদেনের কোনো রেকর্ড থাকে না; সে কারণে অনৈতিক এবং ঘুস ও কালো টাকার লেনদেনের প্রধান মাধ্যম নগদ অর্থ। এর রাশ টেনে ধরা জরুরি।
বড় অংকের বাণিজ্যিক লেনদেন নিষ্পত্তিতে ইলেকট্রনিক ব্যাংক ব্যবস্থার বড় ভূমিকা রয়েছে।
সময়ের প্রয়োজনে
দৈনন্দিন জীবনের
খুচরা লেনদেন
ব্যবস্থারও দ্রুত
ডিজিটাল
রূপান্তর প্রয়োজন। গৃহস্থালি কেনাকাটা, টিউশন ফি, শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, জ্বালানি
তেলের মূল্য,
সেবা বিল,
পরিবহন ভাড়া,
খেলা বা সিনেমার টিকিটের
মূল্য ইত্যাদি
খুব সহজেই
ডিজিটাল মাধ্যমে
পরিশোধের ব্যবস্থা
করা যায়।
সরকার, বাংলাদেশ
ব্যাংক, আর্থিক
সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট সবার
সমন্বিত উদ্যোগ
এসব প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের বিদ্যমান ব্যবস্থাকে ভিন্ন মাত্রা দিতে
পারে। সরকার
বলছে, আধুনিক
প্রযুক্তির কল্যাণে
বৃহৎ পরিসরে
দায়দেনা নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে
একটি দক্ষ,
সাশ্রয়ী ও দ্রুতগতির পরিশোধ
ব্যবস্থা গড়ে
উঠেছে। টাকার
অংক নির্বিশেষে যেকোনো চেক নিষ্পত্তিতে এখন আর খুব
একটা সময়ক্ষেপণ হয় না। সরকারি
সব কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা, কোম্পানির লভ্যাংশ
পরিশোধ হচ্ছে
ইলেকট্রনিক ফান্ড
ট্রান্সফার (ইএফটি)
পদ্ধতিতে। গ্রাহক
দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ব্যাংকের
এটিএম বুথ
ব্যবহার করতে
পারছে। আরটিজিএস
ব্যবস্থায় দু-এক সেকেন্ডের মধ্যে বড় অংকের
লেনদেন নিষ্পত্তি হয়। ইএফটি, আরটিজিএস
ব্যবস্থায় ক্রমে
অপ্রয়োজনীয় হয়ে
পড়ছে চেক,
ব্যাংক ড্রাফট
বা পে-অর্ডারের মতো
কাগুজে আদেশগুলো। ব্যাংক, করপোরেট হাউজ
এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বড় লেনদেন তাত্ক্ষণিক মেটাতে আরটিজিএস ব্যবস্থা
ক্রম জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
সাধারণ
মানুষ অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বগতির কারণে
জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ে ভুগছে, যে বোঝা তাদের
জন্য অসহনীয়।
জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির ফলে অতিরিক্ত খরচের
বোঝা তাদের
আর্থিক অবস্থা
অসহনীয় করে
তুলেছে। অবৈধ
আর্থিক প্রবাহ
বন্ধ, দেশ
থেকে অন্য
দেশে অর্থ
বা মূলধনের
অবৈধ স্থানান্তর বন্ধ, জর্জরিত দুর্নীতিগ্রস্ত কালো অর্থনীতির মূলোৎপাটনের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে
পরিস্থিতি সামাল
দেয়া উচিত
সরকারের। সাধারণ
মানুষের একটাই
স্বপ্ন সহজ-সরল জীবনযাপন। দরিদ্র এবং নিম্ন
আয়ের মানুষ,
মধ্যবিত্ত শ্রেণী
মুদ্রাস্ফীতি এবং
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির
কারণে বেঁচে
থাকার জন্য
তাদের দৈনন্দিন
চাহিদা মেটাতে
কঠিন সংগ্রাম
করছে। দুর্নীতি,
ঘুস ও অন্যান্য অপরাধের
অর্থসহ চুরি
হওয়া সম্পদ
অবিলম্বে দেশে
ফেরত আনতে
হবে। অবশ্যই
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ফৌজদারি এবং
আর্থিক জরিমানা
আরোপ করতে
হবে, যারা
এ ধরনের
অর্থ এবং
সম্পদ গ্রহণ,
প্রেরণ এবং
ব্যবহার করে।
দুর্নীতি ও অন্য মধ্যস্থতাকারীদের অবশ্যই নিবিড়ভাবে নিয়ন্ত্রিত, পর্যবেক্ষণ এবং জবাবদিহি
করতে হবে।
অবৈধ আর্থিক
প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ও নিরীক্ষণের জন্য
প্রতিষ্ঠিত সব সরকারি এবং
বেসরকারি সংস্থাকে
তদন্ত প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
কালো অর্থনীতি
ও অবৈধ
আর্থিক প্রবাহের
সঙ্গে মোকাবেলাকারী বিভিন্ন সরকারি এবং
বেসরকারি সংস্থার
কাজের সমন্বয়
ও তত্ত্বাবধানের জন্য একটি ব্যবস্থা
স্থাপন করা
উচিত।