সংশোধিত আইনের খসড়া অনুমোদন

বিইআরসির পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুতের দাম ঠিক করবে সরকারও

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) পাশাপাশি এখন থেকে সরকারও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করতে পারবে। এজন্য বিইআরসি আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২২-এর খসড়া নীতিগত চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। আইনটির সংশোধন প্রস্তাব জাতীয় সংসদে পাস হলে বিশেষ পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্য সমন্বয়ে সরকার নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। সরকার চাইলে প্রয়োজন অনুযায়ী গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াতে কমাতে পারবে।

গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে অনুমোদন দেয়া হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম প্রস্তাব অনুমোদনের বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান।

সচিব বলেন, জ্বালানি খনিজ সম্পদ বিভাগের বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২২-এর খসড়ার নীতিগত/চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আইন অনুযায়ী, বিইআরসিকে ৯০ দিনের মধ্যে শুনানি করে সিদ্ধান্ত দিতে হয়। তবে অনেক সময় তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়। সে সময়ের কথা বিবেচনা করেই সংশোধন।

বিইআরসির কাজ স্বাভাবিক নিয়মে চলবে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরো বলেন, তবে বিশেষ ব্যবস্থায় সরকার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ বা সমন্বয়ের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে পারবে। যদি এমন কোনো পরিবেশ বা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যেখানে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন, তাহলে তাত্ক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারবে সরকার।

বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিইআরসি আইনের মূল্যসংক্রান্ত অধ্যায়ের ৩৪ ধারার সঙ্গে যুক্ত হবে। ধারার সংশোধনীতেই বিশেষ পরিস্থিতিতে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণে সরকারের সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে।

বিইআরসি আইন, ২০০৩ মূল্যসংক্রান্ত অধ্যায়ের ধারা ৩৪ মোতাবেক সরকারের সঙ্গে আলোচনাক্রমে প্রণীত নীতিমালা পদ্ধতি অনুসরণে পাইকারি খুচরা বিদ্যুৎ উৎপাদন, এনার্জি সঞ্চালন, মজুদকরণ, বিপণন, সরবরাহ, বিতরণ, ভোক্তা পর্যায়ের মূল্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নির্ধারণ করে থাকে। আইনে আরো বলা হয়েছে, কমিশন লাইসেন্সি এবং অন্যান্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে শুনানি দেয়ার পর ট্যারিফ বা মূল্য নির্ধারণ করবে (৩৪-এর উপধারা )

বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্য নির্ধারণে সরকার ক্ষমতা পাওয়ার মাধ্যমে বিইআরসিকে নিষ্ক্রিয় করা হচ্ছে বলে মনে করছেন জ্বালানিসংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, আইন সংশোধন জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক . শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, আইন সংশোধনের মাধ্যমে আদতে বিইআরসিকে নিষ্ক্রিয় করা হলো। গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণে একটা পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা পাচ্ছিল। যেখানে লাইসেন্সিদের জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেত, ভোক্তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হচ্ছিল। কোথাও লুণ্ঠনমূলক ব্যয় হচ্ছে কিনা তা চিহ্নিত করা হচ্ছিল। সেই সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুতে ভর্তুকি কমানোর পথও দেখানো হচ্ছিল। আইন সংশোধন করার ফলে এসব কিছুই আর হবে না। আমি মনে করি, আইন সংশোধন জনস্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম নির্ধারণে সরকারের ধরনের ক্ষমতা পাওয়ার মাধ্যমে ভোক্তার কাছে জবাবদিহিতার কোনো পথ থাকল না বলে মনে করেন আরেক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক তামিম। তিনি বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণে ভোক্তার কথা বলার সুযোগ রাখার লক্ষ্যে বিইআরসি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এখন সরকার কাজের দায়িত্ব পেলে জনগণের জবাবদিহিতার আর কোনো সুযোগ থাকবে না। ধরনের আইন সংশোধনের মাধ্যমে মূলত পেছনের দিকে ফিরে যাওয়া হচ্ছে।

বিইআরসি মূল্যসংক্রান্ত আইন সংশোধনে মন্ত্রিসভার -সংক্রান্ত সারসংক্ষেপে বলা হয়, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে সৃষ্ট বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুৎ, গ্যাস তেলের মূল্য সমন্বয় করা প্রয়োজন। অর্থনীতির গতিকে চলমান রাখার সঙ্গে নিয়মিত দ্রুততম সময়ে মূল্য সমন্বয়ের লক্ষ্যে বিইআরসির পাশাপাশি সরকারেরও ক্ষমতা সংরক্ষণের জন্য আইনটি সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। লক্ষ্যে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩-এর ধারা ৩৪-এর উপধারা () সংশোধন এবং ধারা সন্নিবেশিত করার প্রস্তাব করা হয়।

বিদ্যমান আইনে বিদ্যুৎ, গ্যাস জ্বালানির দাম বিইআরসি ৯০ দিন সময় নিয়ে নির্ধারণ করে। প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি উল্লেখ করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, বিইআরসিকে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেটি দীর্ঘমেয়াদি। তাত্ক্ষণিকভাবে প্রয়োজন হলে বা বিশেষ কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সেই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় না গিয়ে, সরকার যেন দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে, সেজন্যই আইনটি সংশোধন করা হচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে কমিশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানান, কমিশন একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করে আসছিল। এখন সরকার যদি নির্ধারণী ক্ষমতা পায়, সেক্ষেত্রে কমিশনের কাজে নিষ্ক্রিয়তার আশঙ্কা দেখা দেবে।

প্রসঙ্গত, দেশে গ্যাস-বিদ্যুৎ পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের মূল্য নির্ধারণীর ক্ষমতা বিইআরসির। কমিশন প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর থেকে একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশে গ্যাস বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ হয়। যদিও পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যগুলোর মূল্য নির্ধারণ হতো মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে।

বিদ্যুতের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল বলছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে অনেক সময় বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা জরুরি হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে আইন সংশোধন ইতিবাচক।

সংস্থাটির মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম সমন্বয় করতে পারে। বিইআরসি আইনে এতদিন সুযোগ ছিল না। এখন যদি ধরনের সংশোধনী এনে সুযোগ তৈরি করা হয়, তাহলে তাত্ক্ষণিক সংকটে হয়তো সহায়তা পাওয়া যেতে পারে।

বেসরকারিভাবে জ্বালানি তেল আমদানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে: ফুয়েলসহ অন্যান্য জ্বালানি বেসরকারি খাতে আমদানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মন্ত্রিসভার গতকাল অনুষ্ঠিত বৈঠকের বড় একটি অংশজুড়ে ছিল বিষয়টি। শিগগিরই বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বৈঠক-পরবর্তী ব্রিফিংয়ে তথ্য জানান।

তিনি বলেন, ফুয়েলসহ অন্যান্য জ্বালানি বেসরকারি খাতে আমদানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এখন বিপিসি ছাড়া আর কেউ কিন্তু ফুয়েল বিপণন করতে পারে না। সাধারণত অপরিশোধিত জ্বালানি তেল যখন পরিশোধন করা হয়, তখন ৪১-৪২ শতাংশ পরিশোধন করা হয়। পরিশোধিত জ্বালানি তেল বিপণনের জন্য বিপিসির কাছে দিয়ে দেয়া যেতে পারে। অথবা বেসরকারি আমদানিকারকরা সরাসরি বাজারজাত করতে পারে কিনা সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। এক্ষেত্রে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল যারা আমদানি করবে, তারা বিটুমিনসহ অন্যান্য যেসব বাইপ্রডাক্ট তৈরি হয়, সেগুলো হয় স্থানীয় বাজারে বিক্রি করবে অথবা বাইরে রফতানি করবে। আজকে দুটি বিষয় আলোচনা হয়েছে। এর একটি হলো আমদানিকারকরা বিপিসির কাছে বিক্রি করে দিতে পারে অথবা বিপিসি তাদের অন্য কোনো মেকানিজম করে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করে করবে। বেসরকারি খাত যদি আনে এবং পরিশোধন করে, সেক্ষেত্রে ৪১-৪২ শতাংশ পরিশোধিত জ্বালানি তেল বিপিসির কাছে বিক্রি করে দেবে। অথবা আইন পরিবর্তন করে তাদেরও বাজারে বিক্রির অনুমতি দেয়া হবে। সেক্ষেত্রে বিএসটিআইকে ভোক্তার জন্য পরিশোধিত জ্বালানি তেলের মান নিশ্চিত করতে হবে। বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি, এটিকে আলোচনায় রাখতে বলা হয়েছে। দ্রুত বিষয়ে সিদ্ধান্তে যাওয়া হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন