সংসদীয় সাবকমিটির প্রতিবেদন

পাঁচ ব্যাংক ও অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতায় খেলাপি ঋণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

পাঁচটি ব্যাংক -ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গ্রাহক নির্বাচন থেকে শুরু করে ঋণ বিতরণ, ঋণ আদায়সহ প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার বিষয়টি উঠে এসেছে সংসদীয় সাবকমিটির প্রতিবেদনে। প্রতিষ্ঠান পাঁচটি হচ্ছে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স লিমিটেড প্রিমিয়াম লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেড। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে জামানত নেই, আবার অনেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয়েছেন। একই ব্যক্তি বিভিন্ন নামে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েও খেলাপি হয়েছেন।

জাতীয় সংসদে অনুমিত হিসাব-সম্পর্কিত কমিটির গঠন করা সাবকমিটি প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের ব্যাপারে আর্থিক অনিয়ম তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে গতকাল একটি প্রতিবেদন সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করে। প্রতিবেদনে ১৪টি সুপারিশ উঠে এসেছে।

সংসদীয় সাবকমিটির সভাপতি ছিলেন ওয়াসিকা আয়শা খান এমপি, সদস্য ছিলেন আহসান আদেলুর রহমান এমপি খাদিজাতুল আনোয়ার এমপি। প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঁচ ব্যাংক -ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উপাত্ত আলোচনার সাপেক্ষে সাবকমিটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে গ্রাহক নির্বাচন থেকে শুরু করে ঋণ বিতরণ, ঋণ আদায় অগ্রগতি পর্যালোচনাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের দায়দায়িত্বহীনতা, দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থাই ঋণখেলাপি হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে সাবকমিটির সভাপতি ওয়াসিকা আয়শা খান বণিক বার্তাকে বলেন, কমিটির বৈঠকে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। গতকালের বৈঠকে প্রতিবেদনটি নিয়ে আলোচনা হয়নি। সংসদীয় কমিটির বৈঠকে আলোচনার ভিত্তিতে সাবকমিটির সুপারিশ চূড়ান্ত করে তা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো হবে।

সাবকমিটির ১৪টি সুপারিশের মধ্যে রয়েছে নতুন ঋণ প্রদানে নো ইউর কাস্টমারের (কেওয়াইসি) ওপর ব্যাংকগুলোকে জোর দিতে হবে এবং নতুন ঋণ প্রদানে সংশ্লিষ্ট আইন বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার বা গাইডলাইন, বিধিবিধান পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট কর্তব্যরত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। বৃহৎ অংকের ঋণ বা বিনিয়োগ বা লিজ প্রদানকালে প্রকল্পের লাভ, গ্রাহকের ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা, ঋণগ্রহীতার নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী নিয়মিতভাবে পর্যালোচনা করে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃক যথাযথভাবে যাচাই নিশ্চিত করতে হবে। বৃহৎ অংকের ঋণ বা বিনিয়োগ বা লিজের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত রাখা রক্ষিত জামানতের মান, গুণাগুণ বাজারমূল্য সঠিকভাবে নির্ণয় বা যাচাই নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনে নতুন করে জামানত দিয়ে আবৃত করা।

সুপারিশে বলা হয়েছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি দ্রুত চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে মামলাসহ কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। এর জন্য ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, পরিচালন এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কার্যকর শক্তিশালী করতে হবে। ব্যাংকগুলোকে তাদের মানবসম্পদ উন্নয়নের ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে গ্রাহকসেবায় নিয়োজিত কর্মকর্তা কর্মচারী ব্যাংকের সেবা নিয়মাবলি সম্পর্কে যথেষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়। ব্যাংকগুলোকে আধুনিক কোর ব্যাংকিং সলিউশন স্কোর কার্ড, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট সলিউশন ব্যবহার করতে হবে। সেই সঙ্গে দৈনিক এমআইএস রিপোর্টিংয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। লোন রিকভারি টিম তৈরির ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে আরো মনোযোগী হতে হবে। বিরোধ নিষ্পত্তি হার বাড়ানো এবং টক্সিক পোর্টফোলিও কমানোর জন্য সক্রিয় আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিচালনা পর্ষদের ঋণ প্রদানের ক্ষমতা সীমিত করতে হবে এবং ডিউ ডিলিজেন্স নিশ্চিত করতে হবে। সিআইবি রিপোর্টের তথ্যকে অবজ্ঞা করে যাতে কাউকে ঋণ না দেয়া হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি রিপোর্ট এনআইডি সংযুক্তকরণ প্রজেক্টটি দ্রুত বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন। এতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পারসোনাল গ্যারান্টারের সার্বিক আর্থিক অবস্থার খোঁজ নিতে পারবে এবং ব্যাড লোনের ঝুঁকি কমাতে পারবে। একই কারণে টিআইএন সংযুক্তকরণ জরুরি। এসএমই সেক্টরে যেহেতু বৃহৎ অংকের ঋণগ্রহীতাদের থেকে খেলাপি হওয়ার প্রবণতা কম, সেহেতু সেক্টরে ঋণ কার্যক্রম প্রস্তাবিত পলিসি করা প্রয়োজন। ক্রেডিট রেটিংয়ে পরিবর্তনের মাধ্যমে কার্যরত সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য রেটিং ব্যবস্থার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

প্রতিটি ঋণ প্রদান প্রক্রিয়া, জামানত মূল্যায়ন এবং সংশ্লিষ্ট দলিলাদি যথাযথভাবে ব্যাংকের দক্ষ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে যাচাই-বাছাই এমনভাবে করতে হবে, যেন ভবিষ্যতে দায়দায়িত্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রে অধিকতর বস্তুনিষ্ঠ হয় এবং একই সঙ্গে নিয়মিত পরিবীক্ষণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োজিত করা হয়। একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন নামে অন্যান্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পুনরায় ঋণ নেয়ার ফলে ঋণের অপব্যবহার প্রবণতা বাড়ছে। আন্তঃব্যাংক সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে অধিকতর যাচাই-বাছাই করে ঋণ প্রদান করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১০ কোটি টাকা বা তদূর্ধ্ব ২৭ জন খেলাপির হাজার ৪৪ দশমিক ৪০ কোটি টাকা বকেয়ার বিপরীতে চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত কোনো আদায় নেই, যাকে অত্যন্ত হতাশাজনক এবং দুর্বল ব্যাংকের পরিচায়ক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এপ্রিল পর্যন্ত .৮৬ শতাংশ খেলাপি ঋণের বিপরীতে ১০ কোটি বা তদূর্ধ্ব ঋণ রয়েছে .২৮ শতাংশ, যাতে বড় ঋণগ্রহীতাদের খেলাপি হওয়ার প্রবণতা বেশি। ২০২১ সালে মোট আদায়কৃত ৪০.৮০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে ১০ কোটি তদূর্ধ্ব খেলাপি গ্রাহকের বিপরীতে আদায় মাত্র .৫৮ কোটি টাকা, যা মোট আদায়ের ১৩.৬৮ শতাংশ। ডিসেম্বর ২০২০ সালে ১০ কোটি তদূর্ধ্ব খেলাপি সংখ্যা ছিল ৩১টি, ২০২২ সালের আগস্টে এসে তা ২৭টি হয়েছে।

প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেড সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণ পোর্টফোলিও হাজার ২৯৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে শ্রেণীকৃত ঋণ ৬৬০ কোটি টাকা, যা ৫০ শতাংশের বেশি। এটি যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিদর্শন রিপোর্ট অনুযায়ী ২৮২ কোটি টাকা সঞ্চিতি সংরক্ষিত আছে। সঞ্চিতি ঘাটতি সমন্বয়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময় প্রার্থনা করা হলে তা মঞ্জুর করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। টাস্কফোর্স নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘাটতি আদায়ের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেডের দাখিলকৃত তথ্য অনুযায়ী ৩০ এপ্রিল ২০২২ তারিখ পর্যন্ত তাদের মোট খেলাপি ঋণের সংখ্যা ২৬টি এবং প্রতিটি ঋণের বকেয়া স্থিতিই ১০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে।

প্রতিবেদনে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান সম্পর্কে বলা হয়, ব্যাংকটি ১৯৯৪ সাল থেকে বাংলাদেশে পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে চারটি শাখা ঢাকা, গুলশান, চট্টগ্রাম, সিলেটের মাধ্যমে কার্যক্রম চালু রয়েছে। ব্যাংকের মোট মূলধন ৪২৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৭৮ শতাংশ মন্দ ঋণ। খেলাপিদের বেশির ভাগই ২০০৬ বা ২০০৭ সালে ঋণ নিয়েছিল। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের সংখ্যাই বেশি, ঋণ আদায়ের জন্য আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে অর্থঋণ আদালতে ৮৮টি এনআই অ্যাক্টে ৫৭টি মামলা চলমান রয়েছে।

ন্যাশনাল ফাইন্যান্স সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি ২০০১ সালে লাইসেন্স পায়, পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালে মালিকানা পরিবর্তিত হয়ে নতুনভাবে কার্যক্রম শুরু করে। খেলাপিদের বেশির ভাগই ২০১৪-১৫ সালে ঋণ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এসব গ্রাহক ২০০৬ থেকে ২০০৭ সালে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছে বলে কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। তাই বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে রিপোর্ট প্রদানের জন্য কমিটি নির্দেশনা প্রদান করে। প্রতিষ্ঠানের মোট সম্পদ ৬২৭ কোটি টাকা এবং এডি রেশিও  ১০০ শতাংশের কাছাকাছি। প্রতিষ্ঠানটির মন্দ ঋণের পরিমাণ ১৮ শতাংশ। তারা মূলত করপোরেট ফাইন্যান্স করলেও শ্রেণীকৃত ঋণ বেড়ে যাওয়ায় আপাতত করপোরেট ফাইন্যান্স বন্ধ রয়েছে। ন্যাশনাল ফাইন্যান্স লিমিটেডের দাখিলকৃত তথ্য অনুযায়ী তাদের ৩০ এপ্রিল ২০২২ তারিখ পর্যন্ত মোট খেলাপি ঋণের সংখ্যা ২২টি এবং এর মধ্যে ১০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে খেলাপি ঋণের সংখ্যা পাঁচটি।

সোনালী ব্যাংক সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকের হাজার ২২৮টি শাখা রয়েছে, যার মধ্যে দুটি শাখা রয়েছে ভারতে, ১০টি বুথ রয়েছে আমেরিকায়, সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেড নামে একটি পৃথক ব্যাংক রয়েছে লন্ডনে। এছাড়া সৌদি আরবে তিনটি এমএসবি রয়েছে, যা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করে।

সোনালী ব্যাংকের বর্তমান আমানত প্রায় লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আমানত। মোট মূলধন লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ রয়েছে এবং বাকি টাকা বিনিয়োগ। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮০ ৯০ দশকের কিছু ঋণ দেয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ঋণগুলো আদায় না হওয়ায় শ্রেণীকৃত ঋণের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে কিছু গ্রাহক ইচ্ছাকৃত খেলাপি। বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের শ্রেণীকৃত ঋণ আছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের প্রকৃত অবস্থা যথেষ্ট উদ্বেগজনক বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। অনেক ঋণের বিপরীতে জামানত নেই। ব্যাংকটির বড় খেলাপিদের থেকে বার্ষিক আদায়ের হার শতাংশেরও কম।

ব্যাংকটির অনেক ঋণের অনুকূলে জামানত নেই আর যেগুলোর জামানত আছে সেগুলো বিক্রির প্রক্রিয়াও জটিল। সিআইবিতে গ্রাহকদের তথ্য আপগ্রেড না থাকায় অনেক গ্রাহককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাছাড়া ঋণ অনুমোদন বিতরণ কর্তৃপক্ষ একই ব্যক্তি হওয়ায় স্বচ্ছতা থাকছে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন